শারমীন শরীফ : অভিজাত বংশের মেয়ে হয়েও কিশোরী ছায়া বসুর চোখে পরতো সমাজের ধনী-গরীব বৈষম্য এবং তাঁর সেই কিশোরী মনে এই ভাবনা একটি গভীর রেখাপাত ঘটায়। তাঁর এই কষ্টবোধ থেকেই ধীরে ধীরে ভালবাসার জন্ম নেয় সমাজের জন্য, মানুষের জন্য কিছু করার আকাঙ্ক্ষা। সেই সত্যকেই সামনে রেখে ছায়া বসু বাম আদর্শে নিজেকে সম্পৃক্ত করে নেন।
ছায়া বসু ১৩৪৭ সালের শ্রাবণ মাসে পৈত্রিক নিবাস ময়মনসিংহ জেলার, মুক্তাগাছা থানার শশা গ্রামে জন্মগ্রহন করেন।
বাবা গোবিন্দ চন্দ্র দাস ছিলেন জমিদার বংশের ছেলে, মা শৈলবালা একজন গৃহিণী। বাবা-মার চার ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে ছায়া বসু দ্বিতীয় সন্তান ছিলেন। অত্যন্ত ধনাঢ্য পরিবারের জন্মগ্রহণ করায় বাড়িতে সৌখিনতার ছাপ ছিল সেই সাথে ছিল সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল। জ্যাঠাতো ভাইয়েরা তবলা-খোল বাজাতেন। বাড়িতে গ্রামোফোন থাকায় ভাই-বোনরা সংগীতের প্রতি আকৃষ্ট হন। ছায়া বসু নিজেও গান করতেন। প্রায়শঃই বাবা বাড়িতে নাটকের দল নিয়ে আসতেন নাটক প্রদর্শনের জন্য,তিনি ছিলেন একজন প্রগতিশীল মানুষ। বাবা গোবিন্দ চন্দ্র দাস পরোক্ষভাবে নিজেও একজন বামপন্থী ছিলেন। তিনি গ্রামে স্কুল ও লাইব্রেরীর জন্য ১০ কাঠা জমি প্রদান করেছিলেন। এ ছাড়াও এলাকার গরিব লোকজনের জন্য খাবার, পুকুরের মাছ, স্কুলের ছাত্রদের ব্? বেতনসহ কাপড় বিলিয়ে দিতেন। বাবারে উদারতা ছায়া বসুকে খুব প্রভাবিত করেছে।
স্কুল থেকে প্রাইমারি পাস করেন। পরে তিনি কলকাতায় বড় বোনের কাছে থেকে দু বছর পড়াশোনা করেন। এর মধ্যে ১৯৫৮ তাঁর বিয়ে হয়ে যায় জমিদার বংশের ছেলে কমরেড জ্যোতিষ বসুর সাথে। বিয়ের পরে ছায়া বসু দুবার প্রস্তুতি নিয়েও তাঁর আর এস এস সি পরীক্ষা দেয়া হয়ে ওঠেনি।
ছায়া বসুর পরিবার সবাই পরিপূর্ণভাবে প্রগতিশীল আদর্শের অনুসারী ছিলেন। তাই তাঁদের বাড়িতে প্রগতিশীল নেতাকর্মীদের আসা যাওয়া ছিল একটি নৈমত্তিক ঘটনা। বিয়ের পর স্বামীর সাহচর্য শুরু হয় তাঁর রাজনৈতিক জীবন কারণ স্বামীর পরিবারও ছিল প্রগতিশীল রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতি অনুরক্ত। শাশুড়ি লাবণ্যপ্রভা বসু কংগ্রেস করতেন। পরবর্তীকালে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সাথে জড়িত হন এবং পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার সদস্যপদ লাভ করেন। বিয়ের পর শাশুড়ির সাথে পার্লামেন্টে যান তিনি। গাইতে ভালবাসতেন বলে শাশুড়ি তাকে গানের ওস্তাদ রেখে গান শেখাতেন। ছায়া বসুন স্বামীর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সক্রিয় হন আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ হয়ে। প্রচন্ড সাহসী হওয়ায় পার্টির কাগজপত্র লুকিয়ে রাখা, বিভিন্ন জনের সাথে চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগ স্থাপন, তথ্যসহ খবরাখবর সংগ্রহের দায়িত্ব তার উপরে এসে পড়তো। এর পরিণতিতে তাঁর জীবনে নেমে আসে বিপর্যয়। স্বামীর সাথে ছায়া বসুর নামেও ওয়ারেন্ট বের হয়। ফলে কোলের শিশুসন্তানকে নিয়ে ওয়ারেন্ট মাথায় নিয়ে আত্মগোপন করে থাকতে হয় প্রায় আড়াই বছর। স্বামীসহ অন্যান্য নেতারা গ্রেফতার হন ১৯৬১ সালে এবং একটানা আট বছর কারাবন্দি থাকেন।
এমন অবস্থায় তাঁকে ছদ্মবেশে আত্মগোপন করতে হয়। রাতে বোরখা পরিহিত অবস্থায় শাখা খুলে ও সিঁদুর মুছে গ্রামের বাড়ির গরীব বধু সেজে পার্টির খবরাখবর আদান-প্রদান করতেন তিনি তিনি। একবার নরন্তি যাওয়ার জন্য শিশু ছেলেকে কোলে করে ট্রেনে উঠলে পুলিশ তাঁকে জিজ্ঞাসা শুরু করে। তিনি আঞ্চলিক ভাষায় ফকিরের অভিনয় করে পুলিশের সন্দেহ থেকে নিজেকে মুক্ত করেন। স্টেশনে ধরণী নামে একজনের কাছে পার্টির কিছু কাগজ দেয়ার কথা কিন্তু অনেক রাত হয়ে যায় স্টেশনে পৌঁছাতে। হলে নির্দিষ্ট জায়গায় তাকে না পেয়ে ছেলে এবং পোটলা-পুটলি নিয়ে গ্রামের দিকে হাঁটা শুরু করেন তিনি। পথে ধরণীবাবু তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন অতঃপর ধরণী বাবুকে কাগজপত্র গুছিয়ে দেন এবং যে বাড়িতে তাঁর থাকার কথা সেই বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হন। যে নির্দিষ্ট বাড়িটিতে তিনি এসেছিলেন সেখানে তাঁর দীর্ঘকালীন থাকবার কথা ছিল কিন্তু আর দিনের মাথায় পুলিশ বাড়ির রেইড করলে সেখান থেকে তিনি মঙ্গল বাবুর বাড়িতে চলে যান। কিন্তু পুলিশের ভয়ে সেখানে তাঁকে রাখায় অসম্মতি জানানো হয়। পরে আরেক বাড়ি গিয়ে ছদ্মবেশে সেই বাড়ির কাজের মেয়ে হিসেবে থাকেন দীর্ঘদিন। তিনি চন্দ্রঘোনা, বাজিতপুর, নালিতা বাড়ি, ঈশ্বরগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ সহ আরো অনেক জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছেন পার্টির কাজে। আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকার সময় বড় মেয়ের জন্ম হয় এক বাড়িতে। সেই বাড়িতে খরের বিছানায় শিশুসন্তান সহ থাকতে হয়েছে পাঁচ দিন প্রায় না খেয়ে। এছাড়াও যে বাড়িতেই গেছেন, পার্টি নির্দেশে তাঁকে পরিচয় গোপন রাখতে হয়েছে ফলে অনেক বাড়িতেই তাকে কাজের লোক হিসেবেই থাকতে হয়েছে।
তাঁদের নামে ওয়ারেন্ট চলাকালীন আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় তৎকালীন সরকার তাদের ময়মনসিংহের বাড়ি ঘর সিজ করে নিলামে বিক্রি করে দেয়। পরবর্তী সময়ে একটি ভাঙা ঘরে অত্যন্ত বিপর্যস্ত অবস্থায় তাঁদের করতে হয়। পার্টির অফিস ঘর না থাকায় তাঁদের বাসায় পার্টির সমস্ত কাজ হতো। কমরেড মনিসিংহ রবি নিয়োগী, অজয় রায়, সুকুমার ভাওয়াল, মন্মথ দে, খোকারায়, বরুণ রায়, অনিমা সিংহ, কমরেড আলতাফ আলী, মজরণ্নেছা, রাজিয়া খাতুন, মালতি দাস, কমলা চট্টোপাধ্যায় সহ পার্টির অন্যান্য নেতৃবৃন্দ তাঁদের বাসায় নিয়মিত যেতেন এবং গোপনে সভা করতেন। দীর্ঘদিন আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকার পরে ছায়া বসু সিদ্ধান্ত নেন বাড়ি যাবার। তখন জ্যাঠার সাথে যোগাযোগ করলে তিনি তাঁকে আশ্রয় দিতে অসম্মতি জানান। এরপর অনেক কষ্টে বাবার বাড়িতে ওঠলে মা তাকে ঘরে লুকিয়ে রাখেন এবং এভাবে তাঁর আত্মগোপন অবস্থার করুণ জীবনের সমাপ্তি ঘটে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় বাবার বাড়ি চলে যান। সেখানে গোপনে এলাকার ছেলেদের সংগঠিত করে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করে তোলেন এবং তাদের জন্য খাবার দাবার ও কাপড় চোপড় সংগ্রহ ও সরবরাহ করেন। এলাকায় তাঁর দাপট ছিল অন্যরকম। এলাকার মেয়েরা তার আশ্রয় থাকতো। রাজাকাররা তাদের নিতে আসলে অত্যন্ত শক্ত হাতে তিনি তা প্রতিহত করতেন। স্বামী পার্টির নির্দেশে চলে যান ভারতে, সেখান থেকে লোক মারফত চিঠি পাঠিয়ে ছায়া বসুকেও ভারতে যাবার জন্য অনুরোধ করেন কিন্তু ছায়া বসু এর তীব্র বিরোধিতা করেন এবং অভিমান করেন। চিঠি লিখে স্বামীকে জানিয়ে দেন যে তিনি দেশে বসেই কাজ করবেন।
দেশে স্বাধীন হবার পরে শুরু হয় অর্থনৈতিক সংকট। ১৯৮১
সালে ছায়া বসুর স্বামী পরলোকগমন করেন। তারপর থেকে দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে তিনি তিনি অত্যন্ত অমানবিক জীবন যাপন করেছেন। সহায় সম্বলহীন জেদি একরোখা এবং সাহসী এই সংগ্রামী নারী অতি কষ্টে এ অবস্থার মোকাবেলা করেছেন দিনের পর দিন। তিনি বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ময়মনসিংহ জেলা শাখার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্য ছিলেন।