গর্ডন লাইটফুট

অনলাইন ডেস্ক : গত ১ মে, সোমবার সন্ধ্যায় কানাডার লোকসংগীতের আইকন খ্যাত সংগীতশিল্পী গর্ডন লাইটফুট টরেন্টোতে একটি হাসপাতালে মারা গেছেন। মৃত্যুর সময়ে লাইটফুটের বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর। তাঁর মৃত্যুতে গভীরভাবে শোক জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। প্রধানমন্ত্রী টুইট করে বলেন, আমাদের দেশের অন্যতম সেরা গায়ক ও গীতিকারকে আমরা হারালাম। গর্ডন লাইটফুট তাঁর সংগীতে আমাদের দেশের চেতনা ধারণ করেছিলেন এবং এটি করার মাধ্যমে তিনি কানাডার সাউন্ডস্কেপকে আকার দিতে সহায়তা করেছিলেন। তাঁর সংগীত ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে।

গর্ডন লাইটফুট ১৯৩৮ সালের ১৭ই নভেম্বর অন্টারিও’র ওরিলিয়াতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা-মাতা স্কটিশ বংশোভ‚ত গর্ডন লাইটফুল সিনিয়র ও জেসি ভিক ট্রিল লাইটফুট স্থানীয়ভাবে নিজেদের ড্রাই ক্লিনিং এর ব্যবসা পরিচালনা করতেন। শিশুকালে শিল্পী লাইটফুটের সঙ্গীত প্রতিভার পরিচয় পেয়ে তাঁর মা তাঁকে সঙ্গীত বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দেন। চতুর্থ গ্রেড এর ছাত্র থাকা অবস্থায় তিনি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন শুরু করেন এবং দর্শকদের প্রশংসা অর্জন করেন। স্থানীয় রেডিওতে এবং আঞ্চলিক সঙ্গীত উৎসবে শৈশবেই পারফর্ম করতেন লাইটফুট। তাঁর প্রথম গান ‘দ্য হুলা হুপ সং’ লিখেছিলেন ১৯৫৫ সালে উচ্চ বিদ্যালয়ে থাকাকালীন। উচ্চ বিদ্যালয় থেকে স্নাতক হওয়ার পর লাইটফুট ‘ওয়েস্টলেক কলেজ অফ মিউজিক’ এ পড়ার জন্য লস অ্যাঞ্জেলেসে চলে আসেন। তিনি ১৯৫৯ সালে কানাডায় ফিরে আসেন এবং টরন্টোতে বিভিন্ন ধরনের চাকরি করেন।

নিজে গান গাওয়া ছাড়াও গর্ডন লাইটফুট ২০০টিরও বেশি গান লিখছেন। তাঁর লেখা অনেক গানই গেয়েছেন বব ডিলান, এলভিস প্রিসলি ও বারবারা স্ট্রেইসান্ডের মতো বিশ্বের বিখ্যাত শিল্পীরা। তাঁর কয়েকটি বিখ্যাত গানের মধ্যে রয়েছে ‘দ্য রেক অব দ্য এডমন্ড ফিটজেরাল্ড’ ও ‘ইফ ইউ কোল্ড রিড মাই মাইন্ড’। লাইটফুট তাঁর ক্যারিয়ারে পাঁচটি গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেন। এ ছাড়া বছরের শ্রেষ্ঠ আন্তর্জাতিক অ্যালবামের জন্য ১৭ বার জুনো পুরস্কার অর্জন করেন তিনি। এ ছাড়াও অসংখ্যবার গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন।

১৯৬০-এর দশকে বব ডিলানের সঙ্গীত দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে লাইটফুট টরন্টোর ক্রমবর্ধমান লোকজ দৃশ্যের অংশ হয়ে ওঠেন। তিনি তাঁর গান লেখার বিকাশ ঘটান এবং প্রথম অ্যালবামের কাজ শুরু করেন। লাইটফুট ১৯৬৬ সালে প্রথম লাইম লাইটে আসেন। তাঁর অনেক বিখ্যাত গানের মধ্যে অন্যতম হল, বিউটিফুল, সানডাউন, ডন কুইক্সোট, কেয়ার ফ্রি হাইওয়ে, রেনি ডে পিপল এবং দ্য রেক অফ দ্য এডমন্ড ফিটজেরাল্ড। ১৯৭০ এবং ৮০ এর দশকের শেষের দিকে লোকগানের পতন সত্তে¡ও লাইটফুট তাঁর স্বাতন্ত্র্যসূচক সঙ্গীত তৈরি করে চলেছিলেন। এমনকি তিনি অভিনয়ের দিকেও ঝুঁকে পড়েছিলেন। ব্রুস ডার্ন এবং হেলেন শেভারের সাথে হ্যারি ট্রেসি ছবিতে অভিনয় করেছিলেন তিনি।

১৯৮৭ সালে লাইটফুট মাইকেল ম্যাসারের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করে খবেের শিরোনাম হন, যিনি দ্য গ্রেটেস্ট লাভ অফ অল গানটি রচনা করেছিলেন। হুইটনি হিউস্টন রেকর্ড করার পর গানটি ব্যাপক হিট হয়ে ওঠে। লাইটফুট দাবি করেছে ম্যাসার তার গানে ”ইফ ইউ কুড রিড মাই মাইন্ড” থেকে ২৪ টি মেলোডি চুরি করেছে। ম্যাসার প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়ার পর মামলাটি আদালতের বাইরে নিষ্পত্তি করা হয়েছিল।

তাঁর দীর্ঘ কর্মজীবনে লাইটফুট বেশ কিছু অসুস্থতাকে জয় করেছিলেন। যার মধ্যে রয়েছে মুখের পক্ষাঘাত এবং তাঁর প্রথম দিকের কর্মব্যস্ততার বছরগুলোতে মদ্যপানে আসক্তি। তিনি ১৯৮০ এর দশকে আসক্তিকে পরাজিত করেছিলেন। ২০০২ সালের সেপ্টেম্বরে যখন খবর ছড়িয়ে পড়ে যে লাইটফুটকে তীব্র পেটে ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ঠিক তখনই তাঁর অরিলিয়াতে একটি কনসার্ট করার কথা ছিলো। গায়ক তার পেটে একটি ফেটে যাওয়া ধমনীতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। কয়েক রাউন্ড অস্ত্রোপচারের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল তাকে এবং ছয় সপ্তাহ ধরে কোমায় ছিলেন। হাসপাতালে তিন মাস থাকার পর লাইটফুট একটি নতুন স্টুডিও অ্যালবাম সম্পূর্ণ করার এবং মঞ্চে ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তার প্রত্যাবর্তনের দিকে এগিয়ে যেতে কাজ করে যাচ্ছিলেন। তিনি ২০০৩ সালে হারমনি অ্যালবামটি প্রকাশ করেন এবং সেই বছরই মারিপোসা ফেস্টিভ্যালে মঞ্চে পারফর্মের মধ্য দিয়ে প্রত্যাবর্তন করেন।

যদিও তিনি ২০০৬ সালে একটি ছোট স্ট্রোকের শিকার হন। যার ফলে সাময?িকভাবে তাঁর বাম হাতের কিছু আঙ্গুল অকেজো হয়ে পড়ে। তবে তিনি নিয়মিত গিটারের অনুশিলন চালিয়ে যান।

বব ডিলানসহ অনেক শিল্পী লাইটফুটের সঙ্গীত রেকর্ড করেছেন। লাইটফুট ২০০৮ সালে আরকানসাস ডেমোক্র্যাট গেজেট সংবাদপত্রকে বলেছিলেন, আমি কখনোই আমার এমন কোনো গানের কভার শুনিনি যা আমি পছন্দ করি না। লাইটফুট কানাডিয়ান সঙ্গীত ও সংস্কৃতিতে তাঁর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ অনেক সম্মাননা পেয়েছেন। সেখানে কভার অ্যালবাম, সম্মানসূচক ডিগ্রি, একটি ডাকটিকিট এমনকি তার নামে তৈরি একটি গিটারও ছিল।

তিনি ১৯৯৭ সালে গভর্নর জেনারেল এর পারফর্মিং আর্টস পুরস্কার জিতেছিলেন এবং ২০০৩ সালে কানাডার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা পদক ‘দ্য অর্ডার অব কানাডা’ পেয়েছিলেন। ১৯৮৬ সালের জুনো অ্যাওয়ার্ডের অনুষ্ঠানে ডিলান মঞ্চে রসিকতা করে বলেন, ‘আমি জানি তাঁকে (লাইটফুট) আগেও এই পুরস্কারের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে এবং তিনি কখনোই এটি গ্রহণ করেননি কারণ তিনি চেয়েছিলেন যে আমি তাকে এটি দেওয়ার জন্য এখানে আসি। তিনি বিরল প্রতিভার একজন।’

গর্ডন লাইটফুট এর মৃত্যুতে কানাডায় শোকের ছায়া নেমে আসে।