ফরিদ আহমেদ : সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্ম হয়েছিলো শুভব্রতের। বিক্রমপল্লী নামের এক বিরাট রাজ্যের যুবরাজ ছিলো সে। পিতা নম্রব্রতের অবর্তমানে রাজা হয়ে রাজকীয় আয়েস আর অপরিমেয় ভোগের এক জীবন কাটানোর সুযোগ ছিলো তার। বিচিত্র কোনো এক অস্বাভাবিকতায় সেই সুযোগকে প্রত্যাখ্যান করে শুভব্রত। বিক্রমপল্লীর রাজা নয়, বিধাতার রাজ্যের রাজাধিরাজ হবার আগ্রহ জন্মায় তার। আগ্রহটা বিচিত্র এবং বিপদজনক। বিচিত্র এবং বিপদজনক এই কারণে যে, এই বিধাতা কে, আদৌ বিধাতা বলে কেউ আছে কিনা, সে সম্পর্কেই শুভব্রতের সঠিক কোনো ধারণা ছিলো না শুরুতে।

কিশোর বয়সে তার বাবা তাকে নিয়ে গিয়েছিলো বিক্রমপল্লীর রাজধানী রাজগৃহে। উদ্দেশ্য ছিলো রাজকার্যের সাথে তাকে পরিচিত করানো, রাজকার্যের উপযোগী করে গড়ে তোলা। সেখানেই একদল নগ্ন মানুষ শুভব্রতের মধ্যে আবিষ্কার করে তাদের ত্রাতাকে। যে ত্রাতা বহুত্ববাদী ধর্মকে বাতিল করে প্রতিষ্ঠা করবে এক দেবতার, এক বিধাতার ধর্মকে। যে বিধাতার কথা, যে ধর্মের কথা আগে কেউ কখনো শোনেনি। বহুত্ববাদী ধর্মের মতো এটা সহনশীল নয়, বরং একাধিপত্যবাদী এক অসহনশীল ধর্ম। অসহনশীল মানসিকতার কারণে সেটা উচ্ছেদ করবে বা করার চেষ্টা করবে বাদ বাকি সকল ধর্মকে। প্রতিষ্ঠা করবে সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিধর এবং সর্বজয়ী বিধাতার একক ধর্মরাজ্য।

নগ্নরা তাকে আহ্বান জানায় তাদের ত্রাতা হবার জন্য। শুরুতে সেই আহ্বানকে অনুধাবন করতে অসুবিধা হয় শুভব্রতের। এই আহ্বান কি সত্যি নাকি তার বিচলিত মনের বিভ্রান্তি, সেটা নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত থাকে সে। কারণ, মূর্ছারোগে আক্রান্ত হয় সে। ফলে, কোনটা সত্য আর কোনটা অসত্য, কোনটা বাস্তব আর কোনটা অবাস্তব সেই ভেদাভেদ সে ভুলে যেতে থাকে বিশেষ বিশেষ সময়ে।
একটু বড় হবার পরে তার জীবনে আসে নবযৌবনবতী পঞ্চ নারী। এরা পরস্পরের ভগিনী। তবে, একই সাথে তারা শুভব্রতের পত্নী হিসাবে মনোনীত হয় তার মনোরঞ্জনের জন্য। পঞ্চ ভগিনীর জ্যেষ্ঠা জন পরম গুণী, পাণ্ডিত্যে ভরপুর। নাম পারমিতা। পারমিতাই শুভব্রতের অস্পষ্ট ভাবনাকে পুষ্ট করে তুলতে থাকে পরোক্ষে। তার পদক্ষেপকে নিয়ন্ত্রিত করে নিয়ে যেতে থাকে একটা নির্দিষ্ট দিকে। পারমিতার কারণেই শুভব্রত বিশ্বাস করে যে সে মহাশক্তিধর বিধাতার মনোনীত একজন। বহুদেবতাবাদকে উচ্ছেদ করে বিধাতার রাজ্য প্রতিষ্ঠা করাই তার মূল কাজ। এই কাজ করতে দুটো বিষয় ঘটে। শুভব্রত লাভ করে এক দল অনুসারী। নগ্নরাতো আগে থেকেই তাকে ত্রাতা হিসাবে চাচ্ছিলো। বিধাতা রাজ্য প্রতিষ্ঠা করার সংকল্প শুভব্রত ঘোষণা করার সাথে সাথেই তারা তার অনুসারীতে পরিণত হয়। এর বাইরেও বেশ কিছু শুভানুধ্যায়ীও জুটে যায় শুভব্রতের। তবে, একই সাথে শুভব্রত লাভ করে অসংখ্য শত্রুও।

শত্রুর কারণে পিতার রাজ্য থেকে বিতাড়িত হয় শুভব্রত। অনুসারীদের নিয়ে কঠিন এক জীবনকে বেছে নিতে হয়। বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হয়। কিন্তু, তাতেও কোনো আপত্তি থাকে না শুভব্রতের। নিজের ভিতরে বিধার অস্তিত্বকে অনুভব করে শুভব্রত। অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন মনে হয় নিজেকে তার। সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমানের যে ঘনিষ্ঠ সহচর, তার কাছে বন্ধুর পথ কোনো সমস্যাই নয়। তীব্র বিশ্বাস নিয়ে বিধাতার নামে একদিন সে জয় করে নতুন রাজ্য। পুনরুদ্ধার করে পিতার রাজ্য। দিকে দিকে বহু দেবতাদের মন্দিরকে ধ্বংস করে কিংবা রূপান্তরিত করে বিধাতার স্তবাগার দিয়ে ভরে দেয় সে সমস্ত রাজ্য। সবাইকে বেঁধে ফেলে বিধাতার কঠোর অনুশাসনে। এমনকি নিজেকেও বিধাতার অনুশাসনের কঠোর শৃঙ্খলে শৃঙ্খলিত করে ফেলে শুভব্রত।

একদিন অবশ্য তার ভুল ভাঙে। বুঝতে পারে যে বিধাতার ধর্ম সে প্রচার করছে পরম বিশ্বাস নিয়ে, সেই বিধাতা আসলে তার নিজেরই সৃষ্টি। তবে, এই ভাবনাও তার নিজস্ব ভাবনা না। বিধাতার ভাবনা যেমন তার মধ্যে একদিন ঢুকিয়ে ছিলো পারমিতা। বিধাতা যে কাল্পনিক অস্তিত্ব, সেই ভাবনাও শুভব্রতের মধ্যে নিয়ে আসে পারমিতা। বিধাতা তাকে ত্যাগ করেছে এটা ভেবে শুভব্রত যখন বিচলিত জীবন যাপন করছিলো তখন একদিন পারমিতা তাকে বলেছিলো, ‘বিধাতা আপনাকে ত্যাগ করতে পারেন না, তাঁকে সৃষ্টি করেছেন আপনি, আপনাকে ত্যাগ করলে তিনি থাকেন না।’

বিধাতার বিষয়ে শুভব্রতের ভুল ভাঙলেও, নিজের ভুলকে স্বীকার করলেও, এই সত্যকে তার সেনাপতিরা স্বীকার করতে রাজী হয় না। বিধাতার নামে তারা পেয়েছে বিপুল পরিমাণ শক্তির স্বাদ। লুটতরাজের মাধ্যমে অর্জন করেছে বিপুল বিত্ত, শক্তি প্রয়োগে ভোগ করেছে অসংখ্য নারীকে। কাজেই, হোক না তা কাল্পনিক বিধাতা, সেই বিধাতাকেও জিইয়ে রাখতে হবে সেই শক্তির প্রয়োজনেই। বিধাতা নেই, বিধাতা তার নিজের মনের সৃষ্টি, এই মহাসত্য প্রকাশের সাথে সাথেই শুভব্রতের মহাপরিক্রমাশালী সেনাপতিরা তাকে হত্যা করে। বাস্তব শুভব্রতকে তাদের আর প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন রয়েছে বাস্তবতা বিবর্জিত বিধাতার। অবাস্তব বিধাতার স্তব করতে করতেই স্তম্ভিত করে দেওয়া সম্ভব বিরুদ্ধ পক্ষকে। শুভব্রতকে হত্যা করে বিধাতার নামে বীর বিক্রমে তারা বেরিয়ে পড়ে বসুধা বিজয়ে। এই বসুন্ধরা যে বীরভোগ্যা, বীরের বারাঙ্গনা সে।

যে কাহিনি উপরে বিবৃত করলাম, সেটা হুমায়ুন আজাদের উপন্যাস ‘শুভব্রত তার সম্পর্কিত সুসমাচার’ এর কাহিনি।

এই পৃথিবীতে ধর্ম এসেছে অজ্ঞানতা থেকে। মানুষ যখনই প্রকৃতিকে বুঝতে অক্ষম হয়েছে, তখনই সে আমদানি করেছে অলৌকিক দেবদেবতার। মানুষ বিশ্বকে ঠিক মতো বুঝতে কিংবা ব্যাখ্যা করতে পারেনি বলে কল্পনা করেছে দেবদেবীর। যখনই কোনো কিছু মানুষ বুঝতে পারেনি, তখনই সে ভয় পেয়েছে। আর সেই ভয় থেকে তার মানসলোকে তৈরি করে নিয়েছে দেবদেবীর। ‘শুভব্রত তার সম্পর্কিত সুসমাচার’ উপন্যাসের সবচেয়ে সুস্থির চরিত্র হচ্ছে অধ্যাপক অগ্নিকুমার। তাঁর মুখ দিয়ে হুমায়ুন আজাদ বলিয়েছেন, ‘অজ্ঞানতা থেকেই ভয়ের উৎপত্তি, ভয় থেকেই উৎপত্তি দেবদেবীর।’ জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশের সাথে সাথে মানুষের অলীক ভয় কেটে যাবার কথা ছিলো। অলীক ভয়মুক্তির সাথে সাথে দেবদেবী মুক্তও হবার কথা ছিলো। কিন্তু, সেটা হয়নি। জ্ঞান-বিজ্ঞানের রাজত্বে এখনো যে সকল ফাঁক-ফোকর আছে সেগুলোতে ঈশ্বরকে গুঁজে দেবার চেষ্টা করে বিশ্বাসীরা। জ্ঞানের মাঝের শূন্যতাকে তারা পূর্ণতা দেয় পরম ঈশ্বরের পরশ মাখিয়ে। যুক্তিবিদ্যায় এটাকে ‘গড অব দ্যা গ্যাপস’ বলে।

হুমায়ুন আজাদ তাঁর ‘শুভব্রত তার সম্পর্কিত সুসমাচার’ বইটা একটা রূপক গ্রন্থ। এই বই পড়ার সাথে সাথে সচেতন পাঠকের কাছে সহজেই অনুমিত হয় শুভব্রত কে, বিধাতাই বা কে, আর তরবারির মাধ্যমে বিধাতার কোন বর্বর ধর্ম বিকশিত হয়েছে বিশ্ব জুড়ে। তবে, শুধু সেই ধর্মই নয়, মোটামুটি সব আধিপত্যবাদী ধর্মের প্রতিভ‚ হিসাবেই আমরা শুভব্রতের বিধাতার ধর্মকে ভেবে নিতে পারি। কীভাবে একটা ধর্মে মনোনীতজন তৈরি হয়, কীভাবে অনুসারীরা জন্মায়, কীভাবে সেই ধর্ম সামান্য একটা তুষার কণা থেকে গড়াতে গড়াতে বিশালাকৃতির তুষার বলে পরিণত হয়, সেটার একটা অসাধারণ চিত্র এঁকেছেন হুমায়ুন আজাদ তার এই বইতে। একটাই শুধু পার্থক্য। তাঁর উপন্যাসের শেষে শুভব্রত স্বীকার করেছে যে তাঁর বিধাতা তার নিজেরই কল্পনা থেকে সৃষ্ট, বাস্তবের শুভব্রতরা এটা কখনোই স্বীকার করেনি। বিধাতাকে নিয়ে তারা নিজেরা যেমন বিভ্রান্ত বিলাসে থেকেছেন, তাদের অনুসারীদেরকেও বিভ্রান্তির বেড়াজালে আটকে রেখেছে তারা। সেই বেড়াজাল ছিন্ন করে বেরিয়ে আসার শক্তি শুভব্রতদের অনুসারীরা পেয়েছে কদাচিৎ।
এই বইটা বারুদে ঠাসা একটা বোমা। এর পুরোটা যদি কেউ পড়ে, সে যতো বড় বিশ্বাসীই হোক না কেনো, তার বিশ্বাসের রাজত্বে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটতে বাধ্য। সমস্যা হচ্ছে, খুব অল্প সংখ্যক বিশ্বাসী মানুষই এই বই পুরোটা শেষ করার বীরত্বসূচক কাজটা করবে। নিজেদের বিশ্বাসের জগতকে অক্ষত এবং অটল রাখতে অল্প কয়েক পৃষ্ঠা পড়েই সরিয়ে রাখবে অবহেলায়।
আমি নিজেও এই বইটাকে উপন্যাস ভেবে উপেক্ষা করে গিয়েছি দীর্ঘকাল। কল্প গল্প পড়ার ব্যাপারে কিঞ্চিৎ অনীহা আছে আমার। অতি স¤প্রতি ‘শুভব্রত তার সম্পর্কিত সুসমাচার’ পড়ার পরে আক্ষেপ হয়েছে এই ভেবে যে এমন একটা অগ্নিগর্ভ বই আগে কেনো পড়িনি।

আরেকটা বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। অসম্ভব সুখপাঠ্য আর সুরেলা এই বই। হুমায়ুন আজাদের মতো সমৃদ্ধ গদ্য বাংলা সাহিত্যে অন্য কারো আছে কিনা জানা নেই আমার। তার গদ্য যে শুধু সমৃদ্ধ, তা নয়, একই সাথে কাব্য রসেও থাকে ভরপুর। গদ্য পড়তে গেলে মনে হয় পদ্যের এক কোমল এবং মায়াময় জগতে নিয়ে যাচ্ছেন তিনি আমাদের। ‘শুভব্রত তার সম্পর্কিত সুসমাচার’-ও ব্যতিক্রম কিছু নয়। উপন্যাস নয়, আমার কাছে মনে হয়েছে আমি যেনো কোনো কাব্যগ্রন্থ পড়ছি। এমনই ঐশ্বর্যশালী, আলংকারিক আর আনন্দ ঝংকার ছড়ানো ছন্দময় তাঁর ভাষা।