ভজন সরকার : (১)
করোনা অন্তরীণ দিনে হঠাৎ টেলিফোনের ওপারে চেনা কন্ঠ।
“হাই মিঃ সরকার, আমি সুধীর”।
দীর্ঘ ১৪ বছর পরেও কন্ঠ শুনেই চিনতে পারলাম। সুধীর যোশী।
“আরে সুধীর, কোথায় তুমি? এতোদিন পরে? টেলিফোন নম্বর কিভাবে পেলে?” এক নিঃশ্বাসে রাজ্যের প্রশ্ন।

সুধীর যোশী উত্তর ভারতীয় উচ্চারণে বললো, “আমি তোমার পাড়াতেই বাড়ি কিনেছি দু’মাস আগে। টেলিফোন নম্বর পেলাম টেলিফোন বই থেকে”।
হঠাৎ বাড়ি কেনা? হিসেব করলাম; সুধীরের সাথে যখন শেষ দেখা তখন সুধীরের বয়স ৬৩ বছর। এক বছর আগে সোনার খনির নিয়মিত চাকুরী থেকে অবসর নিয়ে আবার সেখানেই কনসালটেন্ট হিসেবে কাজ করছে। সে হিসেবে সুধীরের বয়স এখন ৭৭ বছর।

৭৭ বছর বয়সে বাড়ি কেনা? যে এলাকায় বাড়ি কিনেছে বলে জানালো, সেখানে উচ্চবিত্তের বাস। সাধারণত এ বয়সের অনেক আগেই পশ্চিমা বিশ্বের মানুষ বাড়ি বিক্রি ক’রে এপার্টমেন্টে চলে যায়। অধিকাংশই চলে যায় বৃদ্ধাশ্রমে। কিন্ত সুধীর যোশীকে আর দশজনের মধ্যে ফেলানো যাবে না। রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতার নায়ক অমিত রায়ের মতো সুধীর যোশীও দশজনের মধ্যে একজন নয়, একেবারে দশম জন।

সুধীরের সাথে পরিচয় আজকের টেলিফোনের মতোই কাকতালীয়। আমি তখন কানাডার এক নির্জন এবং জনবসতি-বিবর্জিত এলাকায় চাকুরী নিয়েছি।
মাস্টার্স ডিগ্রী শেষ করে তখন বেকার। যেখানে পাই চাকুরীর আবেদন করি। এক অলস দুপুরে একটি টেলিফোন এলো। কিছু সম্বোধন আদান প্রদানের পরেই ভদ্রমহিলা জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি জানো ম্যারাথন নামের শহরটি কোথায়?”
আমি বললাম, “না”।

“তুমি না জেনেই চাকুরীর আবেদন করেছো?” ভদ্রমহিলা অবাক হলেন।
আমি বললাম, “আমি জানি এটি কানাডার ভিতরেই। তাই নয় কি? আর চাকুরীর জন্য আমি যে কোনো স্থানে যেতে প্রস্তুত।”
ভদ্রমহিলা বললেন, “জানো, এটি টরন্টো থেকে ১৩০০ কিলোমিটার দূরে”।
আমি বললাম, “বাংলাদেশ থেকে টরন্টো আর ম্যারাথন শহরের দূরত্ব প্রায় সমান। বাংলাদেশ থেকে যখন টরন্টো আসতে পেরেছি, তখন ম্যারাথন শহরেও যেতে পারবো”।

ভদ্রমহিলার সাথে অনেক বিষয়ে কথা হলো। পরের দিনই সব ব্যবস্থা ক’রে জানালেন, “তোমার জন্য নিকটস্থ এয়ারপোর্টে গাড়ি ভাড়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিমানের টিকেটও পাঠালাম। তুমি সামনে সপ্তাহে এসে আরেকবার সাক্ষাৎকার দিয়ে যাও। শহরটিও দেখে যাও, বাস করতে পারবে কিনা”।
চাকুরীটি আমার হ’লো। পরের মাসেই কাজে যোগ দেব। টরন্টোতে ফ্যামিলি রেখেই গেলাম প্রথমবার। মাত্র হাজার চারেক মানুষের বসতি। শহর থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে তিনটি সোনার খনি। আর সে খনিতে কাজ করা মানুষের বাসস্থান হিসেবেই এ শহরটির গোড়াপত্তন। আশেপাশে আদিবাসীদের বাস। তিন পাশেই লেক। এক পাশে কানাডার দীর্ঘতম সড়কপথ হাইওয়ে -১৭। হাইওয়ে থেকে ৫ কিলোমিটার ভিতরে লেক সুপিরিয়রের পেটের মধ্য ঢুকে যাওয়া একটি ঝকমকে শহর। শহরটির নাম ম্যারাথন কেনো হলো জানি না। তবে প্রথম দেখাতেই আমার কাব্যিক মনের সাড়া পেলাম; এখানে থাকা যাবে। লোকালয় থেকে দূরে নিজের মতো ক’রে থাকতে এর চেয়ে উত্তম জায়গা আর কোথাও নেই।

টরন্টো থেকে খুব ভোরে রওনা হয়ে একদিন একরাত পরে ভোর পাঁচটায় নামিয়ে দিল দূর পাল্লার বাস। আমিই একমাত্র যাত্রী বাস থেকে নামার।
বাস ড্রাইভার বললো, “এতো ভোরে কাউন্টার বন্ধ থাকে। ট্যাক্সিওয়ালারা জানে এ সময়েই যাত্রীরা নামে এখানে। যদিও আজ একটু আগেই এসেছি। তুমি একটু দাঁড়ালেই ট্যাক্সি পেয়ে যাবে”।

মে মাসের শেষ সপ্তাহ। ভেবেছিলাম তেমন শীত নেই। তাই শীতের পোশাক সংগে নেই। কিন্ত বাস থেকে নেমেই বুঝলাম কী ভয়ানক ভুলটাই না করেছি। বন্ধ কাউন্টারের সামনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। ট্যাক্সির দেখা নেই।
একদিকে প্রচন্ড শীত। অন্যদিকে অনিশ্চিত অচেনা পরিবেশ। আধা ঘন্টা অপেক্ষার পরে দেখলাম একটু একটু করে ভোরের আলো ফুটছে। এতক্ষণ বুঝতেই পারছিলাম না কোন্ দিকে হেঁটে যাব। অফিস থেকে একটি আসবাবপত্রসমেত এপার্টমেন্ট ঠিক করে রেখেছে। ঠিকানাও জানা। এপার্টমেন্টের চাবি রাখার জায়গাও জানিয়ে দিয়েছে। কিন্ত কোথায় যাব? ট্যাক্সি না পেলে কিভাবেই বা যাব?

ভোরের আলো ফুটতেই দেখলাম, কিছু গাড়ি সামনের রাস্তা দিয়ে শহরের দিকে যাচ্ছে। বাস কাউন্টার থেকে একটু দূরেই রাস্তা। সেদিকেই হাঁটলাম। অনেক গাড়ি শহরের দিকে যাচ্ছে। আমি কি হাত উঁচু ক’রে কোনো গাড়িকে থামাবো? এসব সাত-পাঁচ ভাবতেই একটি পিক-আপ ভ্যান গাড়ি সামনে এসে দাঁড়াল।
গাড়ির চালক কিছুক্ষণ সুক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ করে ভারতীয় উচ্চারণে ইংরেজিতে আমার নাম ধ’রে ডেকে জিজ্ঞাসা করলো, আমি সেই ইঞ্জিনিয়ার কিনা যে সিটির পাবিøক ওয়ার্কস ম্যানেজার হিসেবে যোগ দিচ্ছে?
আমি একটু অবাকই হলাম। বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “তুমি আমার নাম কি ক’রে জানলে?”

ষাটোর্ধ্ব বয়সের সুঠাম দেহের ভদ্রলোক হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো, “আমি সুধীর। সুধীর যোশী।এই শহরের একমাত্র রেডিও স্টেশন থেকে তোমার নাম ঘোষণা করেছে। কমিউনিটি টিভিতে তোমার ছবিও দেখিয়েছে। নাম ও চেহারা দেখেই বুঝেছি তুমি পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি হবে।”
আমি হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, “হ্যা, আমি বাঙালি কিন্ত ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নয়; বাংলাদেশের বাঙালি”।
ভারতের অন্যান্য প্রদেশের লোকেরা বাঙালিদের দেখলে প্রথমে যে ভাঙা বাংলাটা দিয়ে শুরু করে, সুধীর যোশীও অট্ট হাসিতে পরিবেশ মাতিয়ে তুলে বললো, “কেমন আছো? আমি তোমা-রে বালোবাসি”।

সুধীর গাড়ি থেকে নেমে নিজেই আমার লাগেজ তুললো তাঁর গাড়িতে। আমিও সুধীরের গাড়িতে উঠলাম। সুধীর ঠিকানা জিজ্ঞেস ক’রে আমাকে নামিয়ে দিলো অফিস থেকে ভাড়া করা এপার্টমেন্টে।
চলে যাওয়ার সময় বললো, “আমি সোনা খনিতে রাতের শিফট থেকে ফিরছিলাম। তুমি একাএকা এই শীতে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলে জায়গাটা নিরাপদ নয়। কালো ভালুকের প্রচন্ড উপদ্রুপ শীতের শেষের এই সময়ে। শীতে ভালুক হাইবারনেশনে বা শীতনিদ্রায় থাকে। শীত শেষ হ’লেই খাবারের সন্ধানে বের হয়। তোমার উচিত ছিল, হাইওয়ে-১৭-এ যে হোটেল “ট্রাভেল লজ” আছে ওখানে নেমে একটি ট্যাক্সি ডাকা”।

সুধীর যোশীর কথা শুনে সত্যি ভয় পেয়ে গেলাম। তবুও সান্ত¡না, এই দূর প্রবাসে একজন মানুষ পেলাম অন্তত কৃষ্টি-সংস্কৃতিতে যার সাথে কিছুটা মিল আছে।
পরে জানালাম, এই শহরে সুধীর যোশীই ছিল একমাত্র ভারতীয় বংশোদ্ভুত বাদামী ত্বকের মানুষ। এবার আরেকটি পরিবার যোগ হলো।
এতোদিন পরে বিশ্ব মহামারী কোভিডে ঘরবন্দী সময়ে সুধীরের টেলিফোন পেয়ে তাই আশ্চর্যই হয়েছিলাম।
টেলিফোনেই সুধীর জানালো সান্দ্রাও এখন তাঁর সাথে এসেছে। দু’বছর আগে।

আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘দু’বছর আগে মানে? তুমি তো ম্যারাথন শহর ছেড়েছ আজ ১৪ বছর হলো? এতোদিন সান্দ্রা তোমার সাথে ছিল না?” সুধীর নিরুত্তর।
কানাডায় আমার অভিবাসী জীবন তখন বছর পাঁচেক। বছর না-গেলে পড়াশোনার সরকারী আর্থিক সাহায্য মেলে না। তাই এক বছর আর সবার মতোই টুকটাক কাজ করেছি এখানে সেখানে। তারপর দীর্ঘ তিন সাড়ে তিন বছরের বিশ্ববিদ্যালয় জীবন।

পর পর দু’টো ডিগ্রী নিলেও কানাডায় কাজের পরিবেশ সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই। তার উপরে সরকারী অফিস। পাব্লিক ওয়ার্কসের মতো একটি বিভাগের প্রধান। বাংলাদেশে সরকারী কাজের অভিজ্ঞতা আছে। কিন্ত কানাডার সাথে বাংলাদেশের তেমন মিল নেই। তিন স্তরের সরকারী ব্যবস্থায় সবচেয়ে নিচের স্তরটি মিউনিসিপ্যাল গভর্মেন্ট। একেবারে জনসেবা ও জনসম্পৃক্ততা বলতে যা বোঝায়, সব কিছুই দেয় মিউনিসিপ্যালিটি। (অসমাপ্ত)
(ভজন সরকার : কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, কানাডা)