ইউসুফ কামাল : আজারবাইজানের আবু সালেমের জন্ম আমেরিকায়, এদেশে লেখাপড়া শেষ করে এ দেশের সরকারের এক আইটি প্রতিষ্ঠানে ভালো চাকুরী করেন। প্রায় ত্রিশ বছর আগে তার পিতা আবু রুশদ এ দেশে এসেছিলেন নিজের ভাগ্যান্বেষণে। প্রথম স্ত্রীর ডরোথী পর্ব শেষ হবার পর আবু রুশদের দ্বিতীয় স্ত্রীর ঔরস জাত এক সন্তান আবু সালেক আর কন্যা আয়েশা। কন্যা আয়েশা মেরিল্যান্ডের এক সরকারি দপ্তরে চাকরি করে। পিতা এ দেশের নাগরিক দ্বিতীয়ত তার জন্ম ও এদেশে সেই সুবাদেই আবু সালেক নিজেও এদেশের নাগরিক। আর এ কারণেই ইচ্ছে মতো লেখাপড়ার সুযোগ পেয়েছেন পৃথিবীর এই উন্নত দেশে। আদি দেশ আজারবাইজানে বসবাস করলে কোন দিনই যা সম্ভব হতো না। লেখাপড়ার পাট শেষ করে ওয়াশিংটন ডিসি তে সে একটা ভালো চাকুরীও পেয়ে যান। প্রচন্ডভাবে ভাগ্য বিশ্বাসী নিরাহংকারী মানুষ এই আবু সালেক। সে নিজে বিয়ে করেছে একই প্রতিষ্ঠানে চাকুরী রত তাঁর সহকর্মি রাশিয়ার মেয়ে ইভানাকে। প্রায়ই অসুস্থ ইভানার মা মেয়ের কাছেই থাকেন।

পিতা আবু রুশদ যুবক বয়সে ভাগ্যান্বষনে এদেশে চলে আসেন নিজ মাতৃভ‚মি আজারবাইজান ছেড়ে এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর আন্তরিক সহযোগীতায়। ছোট খাটো কাজ করে বুঝতে পারেন এভাবে এখানে প্রতিষ্ঠিত হওয়া যাবে না। বন্ধুদের পরামর্শে এদেশে স্থায়ী হওয়ার পরিকল্পনায় সে মেক্সিকান মহিলা ডরোথীকে বিয়ে করেন নানা রকমের শর্তে। কিন্তু ডরোথী নিজে তার দেওয়া শর্তের চেয়ে বেশি সুবিধা দাবী করতে থাকলে দাম্পত্য জীবনে নানান অশান্তির সৃষ্টি হয়। দুই বছর পর ডরোথী নিজেই আবু রুশদকে পরিত্যাগ করে অন্যত্র চলে যায়। ইতিমধ্যে শর্তানুযায়ী ডরোথীর স্বামী হিসেবে আবু রুশদ আমেরিকার নাগরিকত্বের সার্টিফিকেট পেয়ে যায়, লাভের মধ্যে ডরোথীর কাছ থেকে সে এটা পেয়েছে। অন্তত আমেরিকা থাকার একটা বৈধতা তো পেয়েছে। পরের বছর আবু রুশদ দেশে যেয়ে তাদের পরিবারেরই পূর্ব পরিচিতা এক মহিলাকে বিয়ে করে স্ত্রী হিসেবে এ দেশে নিয়ে আসেন। তার পর ধীরে ধীরে তার পরিবার একটু একটু করে বড় হয়ে ওঠে, দুই সন্তান সন্ততি নিয়ে সে স্থায়ী হয়ে যান ওয়াশিংটন এর কাছের শহর মেরিল্যান্ডে। লেখাপড়ার প্রচুর সুবিধা এ দেশে, আর সেটার কল্যাণে আবু রুশদের ছেলে মেয়ে এখন শিক্ষিত হয়ে আমেরিকায় প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছেন।

পিতার কষ্টের সার্থক প্রতিদান যে তার সন্তানেরা তাকে দিতে পেরেছেন এটাই এখন তার মনের সন্তষ্টি। আবেগ প্রবন মানুষ আবু রুশদ নিজে এখনও তার সেই পুরনো কর্মস্থল ‘টেকোবেল’ ছাড়তে পারেননি, হয়তো প্রতিষ্ঠানের প্রতি তার সেই দীর্ঘ দিনের ভালোবাসার কারণেই। সে মনে প্রাণে বিশ্বাস করে এই প্রতিষ্ঠানের কারণেই আজ সে এবং তার পরিবার এখানে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। এখন অবসরের বেশির ভাগ সময় কাটে তার শাক সব্জীর বাগান করে। আবু রুশদ এর নিজের বাসার ব্যাক ইয়ার্ডেই হরেক রকমের গাছ লাগিয়ে চলেছেন তিনি এখন। কি নাই সেখানে টমেটো, আলু, বেগুন, মরিচসহ আরো অনেক রকম। কিন্তু আশ্চার্যের বিষয় হলো উৎপাদিত পণ্যের যৎসামান্য তার জন্য রেখে বাকী সবটুকুই প্রতিবেশীদের মধ্যে বিলিয়ে দেন। আশে পাশে যারা লাউ মুলা বেগুন টমেটো গাছ লাগাতে চান তাদেরকে নিজে সাহায্যও করেন। প্রয়োজনে কি ভাবে লাগাতে হবে, প্রয়োজন বোধে নিজে যেয়ে যেয়ে দেখিয়ে দিয়ে আসেন। প্রকৃতপক্ষে আবু রুশদ এলাকায় একজন মানব হিতৈষী রুপে আবির্ভুত হয়েছেন। পুত্র আবু সালেক ভিন্ন বাসায় তার এক পুত্র সন্তান ও কন্যা নিয়ে আলাদা থাকেন। বুদ্ধিমান মানুষ, কোন পারিবারিক দ্ব›েদ্বর অবতারনা করতে চাননি পরিবারের মধ্যে, হয়তো তাই এই ব্যাবস্থা। আবু রুশদের মানসিক সান্তনা, এখন এটুকুই সে দুটো সন্তানকে এদেশে এনে ভিন্ন পরিবেশে মানুষ করতে পেরেছেন, এটাই আল্লাহর কাছে হাজার শোকর।

আবু রুশদের এ দেশে আসা মানুষদের প্রতি তার একটাই বক্তব্য নিজেরা কষ্ট করেও যদি ভবিষৎ বংশধরদের জন্য ভালো কিছু করে যাওয়া যায় সেটাতেই শান্তি নিহিত থাকে। ভবিষ্য বংশধরদের মাঝেই তো নিজেদের ভবিষ্যতের পরিচয় নিহিত থাকে। মানুষটার সহজ সরল স্বীকারোক্তি যা সত্যি সত্যি মনে রাখার মতো। (চলবে)

ইউসুফ কামাল : লেখক, উডব্রীজ, ভার্জিনিয়া, ইউএসএ