জান্নাত-এ-ফেরদৌসী : জাতি বৈচিত্র্যের দেশ বাংলাদেশ। বাঙালি ছাড়া আটাত্তরটি জাতির বসবাস এই দেশে। এদের জনসংখ্যা বর্তমানে ত্রিশ লাখের বেশি। এদের বেশির ভাগেরই রয়েছে নিজস্ব ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি আর জীবনবোধ। বাংলাদেশের স্বনামধন্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘গবেষণা ও উন্নয়ন কালেকটিভ’ (জউঈ) এর সাধারণ সম্পাদক এবং সঙ্গীত শিল্পী ও গবেষক জান্নাত-এ-ফেরদৌসী দেড় যুগের বেশি সময় ধরে গবেষণা করছেন বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী নিয়ে। বাংলাদেশের পঞ্চাশটি জাতি নিয়ে তাঁর গবেষণালব্ধ লেখা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকদের জন্য।
এগারো.
ম্রোদের বসবাস মূলত পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান জেলায়। সরকারিভাবে ১৯৯১ সালের আদমশুমারি রিপোর্ট হতে জানা যায়, ম্রোদের মোট জনসংখ্যা ২২,১৬৭। ম্রোদের বাস দুর্গম অঞ্চলে বিধায় আদমশুমারিতে ম্রোদের সংখ্যা তথ্যের যথার্থতা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
গোত্র
ম্রো’রা নিজেদেরকে মারুচা বলে অভিহিত করেন। ম্রো ভাষায় ‘মারু’ শব্দের অর্থ মানুষ। অনেকে ধারণা করেন, ‘মারু’ শব্দ থেকেই ম্রো শব্দের উৎপত্তি হয়েছে। ম্রোদের সমাজে কয়েকটি পরিবার মিলে একটি গোত্র গঠিত হয় এবং গোত্রের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। তাদের উল্লেখযোগ্য গোত্রগুলো হলো- ঙারুয়া, নাইচাহ, তাম-তু-চাহ, ইয়ম্রে, কানবক, দেং, প্রেনজু, তাং, খউ, ঙারিংচাহ্ ইত্যাদি। অতীতে ম্রোদের সামাজিক কাঠামো নির্ভর করতো দল ও গোত্রের প্রধানদের উপর। কিন্তু ১৯০০ সালের পর থেকে হেডম্যান ও রোয়াজা পদ চালু হওয়ায় বর্তমানে গ্রাম ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে।
উত্তরাধিকার
ম্রো পিতৃপ্রধান পরিবার। তাদের সমাজে পিতার সূত্র ধরে সন্তানের বংশ বা গোত্র নির্ণয় করা হয়। গোত্রের নামগুলো অনেকটা উদ্ভিদের নামের সাথে সম্পৃক্ত। ম্রোদের সমাজে একক ও যৌথ পরিবার প্রথা রয়েছে। পিতার বংশ পরিচয় অনুযায়ী সন্তানের বংশ পরিচয় নির্ধারিত হয়। পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত পিতা গ্রহণ করেন। পিতার অনুপস্থিতিতে বড় ভাই বা বড় ছেলে দায়িত্ব পালন করেন। উত্তরাধিকার সূত্রে ম্রো পরিবারের পুত্র সন্তান পারিবারিক সম্পদের অধিকারী হয়। পুত্র সন্তানের অনুপস্থিতিতে পিতার কোন নিকট আত্মীয়ের পুত্র মৃতের সম্পদ ভোগ করতে পারেন। ম্রো সমাজে মেয়েদের সম্পদের অধিকার নেই।
ভাষা
ম্রো ভাষা তিব্বতি-বর্মী ভাষাভুক্ত। ম্রোদের কোন লিখিত ভাষা ছিল না, মৌখিক উত্তরাধিকার সূত্রে তারা তাদের ভাষা ব্যবহার করে আসছেন এবং এ প্রক্রিয়াই তাদের ভাষা বংশ পরম্পরায় টিকে আছে। তবে স¤প্রতি ম্রোদের নিজস্ব বর্ণমালা তৈরি হযেছে। মেনলে ম্রো ১৯৮৬ সালে ম্রো বর্ণমালা আবিষ্কার করেন।
পেশা
জুম চাষ ম্রোদের প্রধান পেশা। ম্রো নারী-পুরুষ উভয়ে জুম চাষ করেন। পুরুষের তুলনায় ম্রো নারীরা অধিক পরিশ্রমী। তবে বর্তমানে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, ভূমি কমে যাওয়া, বিভিন্ন কারণে জুম চাষের জায়গা কমে যাচ্ছে। বেঁচে থাকাটাই কঠিন হয়ে গেছে তবুও তারা এ জীবন নিয়ে বেঁচে থাকতে চান। পুরুষের পাশাপাশি নরীারাও কাঠ কাটা ও কাঠ সংগ্রহ করেন। কৃষিজাত পণ্য সরবরাহ ও ঠিকাদারি ব্যবসার কাজে অনেকেই নিয়োজিত আছেন। বর্তমানে অনেকে লেখাপড়া শিখে সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন।
খাদ্য
ম্রোদের মূল খাদ্য মাছ, মাংশ, ভাত, সবজি। তবে নাপ্পি তাদের অন্যতম একটি পছন্দের খাবার। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি তারা মাঠে কাজ করে ঝুড়িভর্তি ফলমূল, ফসল নিয়ে ঘরে ফিরে আসেন। জুম চাষ থেকে যে পরিমাণ ফসল পায় তা দিয়ে তাদের সারাবছর চলে না ।
পোশাক পরিচ্ছেদ
ম্রো’রা সংক্ষিপ্ত পোশাক পরিধান করেন। কথিত রয়েছে সৃষ্টি কর্তার নিকট থেকে কাপড় পরার নির্দেশ পাননি বলে তারা সংক্ষিপ্ত কাপড় ব্যবহার করেন। ম্রো নারীরা কালো রঙের ‘ওয়ান ক্লাই’ নামে পরিচিত এক প্রকার ক্ষুদ্র বস্ত্র ব্যবহার করেন। যা মাত্র নয় থেকে এগারো ইঞ্চি চওড়া। কোমর বন্ধনী দিয়ে ‘রয়ান ক্লাই’ আটকানো থাকে। তাদের উর্ধ্বাংশ ‘রয়ানচা’ নামক চাদরের ন্যায় কাপড় গায়ে জড়িয়ে নেয়। ম্রো পুরুষরা নেংটি পরিধান করেন যা তাদের ভাষায় ‘দং’ বা ‘নাপং’ নামে পরিচিত। ম্রো নারী-পুরুষ উভয়ে অলংকার ব্যবহার করেন। তারা সাধারণত রূপা, তামা ও এনামেলের অলংকার ব্যবহার করেন। নারীরা বড় আকৃতির বৈশিষ্ট্যপূর্ণ কানের অলংকার ব্যবহার করেন। উভয়ে নিজেদের ফুল দিয়ে সাজাতে পছন্দ করেন।
বিয়ে
অন্যান্য আদিবাসীর মত ম্রোদের বিবাহেরও নিজস্ব রীতি রয়েছে। তাদের সমাজে দুই ধরণের বিবাহ প্রথা রয়েছে। যথা: ১। দিনে বউ আনা (নিমাঙ): দিনের বেলা বিবাহ সম্পন্ন হওয়াকে নিমাঙ বলে। বর ও কনের পিতা-মাতা উভয়ই অর্থশালী হলে এই ধরণের বিবাহ অনুষ্ঠিত হয়। ২। রাতে বউ আনা (ওয়ামাং): বর ও কনের পিতা-মাতা গরিব হলে ওয়ামাং পদ্ধতিতে বিবাহ সম্পন্ন হয়। এই পদ্ধতিতে গ্রামের সব লোক ঘুমিয়ে গেলে বর তার বন্ধু-বান্ধব সহ বউ চুরি করে নিজ বাড়িতে নিয়ে আসে।
সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড
ম্রোদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রয়েছে। তারা বিনোদন প্রিয় জাতি। তাদের সংস্কৃতিতে রয়েছে নিজস্ব গান, ধাঁধা, ছড়া, প্রবাদ প্রচলন ইত্যাদি। তাদের গানের মধ্যে রয়েছে প্রেম-ভালবাসা, দেশাত্নবোধ ও বিরহব্যাথার আখ্যান। ম্রোদের লোকগীতি অত্যন্ত শ্রুতিমধুর। এই লোকগীতিতে প্রতিফলিত হয়েছে অরন্যের বন্দনা, ম্রোদের দুঃখ, ভালবাসা, জীবন-জীবিকা, যুদ্ধের বিরত্ব গাথা ইত্যাদি। তাদের লোক-নৃত্য বৈচিত্র্যময়। বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে ম্রোরা লোক-নৃত্যের আয়োজন করেন। আদিবাসী জনগোষ্ঠির মধ্যে ম্রোদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য স্বতন্ত্র ও সমৃদ্ধ।
ধর্ম
ম্রো জনগোষ্ঠীর মধ্যে কেউ বৌদ্ধ ধর্ম, খ্রিষ্টান ধর্ম, আবার অনেকে সনাতন ধর্মে বিশ্বাসী। ম্রোরা সাধারণত সর্বপ্রাণবাদী ও প্রকৃতি পূজারী। তারা নিজেদের মঙ্গলের জন্য বিভিন্ন দেব-দেবীর পূজা করে। এ সর্বপ্রাণবাদই মানুষের আদি ধর্ম এবং চিকিৎসা ব্যবস্থার মূল ভিত্তি। ধর্মীয় উৎসবের মধ্যে তারা রইক্ষারাম (কান ফোঁড়ানো উৎসব), গো হত্যা বা ছিয়াছত-প্লাই উৎসব, পূজা পার্বন, কেরাই/কংনাত পূজা, চাম্পুয়া উৎসব ও ক্রামা ধর্ম ইত্যাদি নানা ধরনের ধর্মীয় উৎসব পালন করেন।
উৎসব
ম্রোরা নবান্ন উৎসব পালন করেন। ম্রো’রা তাদের নিজস্ব পদ্ধতির জুমচাষের প্রথম ধান কেটে এনে ঐ চাল দিয়ে প্রতিবেশীদের নিমন্ত্রণ করে খাওয়ান। সমাজের বায়োজ্যেষ্ঠদের মধ্যে থেকে একজন কিছু আনুষ্ঠানিকতা পালন করে এ অনুষ্ঠান করেন। এটাকে তারা চাহমাইনাত (নবান্ন উৎসব) বলেন। এই খাবারের সঙ্গে ঘরে তৈরি চোলাই মদও পরিবেশন করা হয়। ঐ দিন ঘরের মূল্যবান দ্রব্যাদি বিশেষ করে শিকারের অস্ত্রশস্ত্র, অলংকার, দামি জিনিষপত্র পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে একত্রিত করে ঘরে রাখা হয়। একই দিনে আগামী দিনের শুভ কামনা করা হয়। চৈত্রসংক্রান্তি ও পহেলা বৈশাখ অত্যন্ত আনন্দ উৎসবের সঙ্গে পালন করে থাকে ম্রো জাতি। জনপ্রিয় এ উৎসব ম্রো সমাজের ‘ক্লবং পাই’ নামে খ্যাত। বছরের শেষ দিন হিসেবে বন থেকে ফুল এনে ঘরবাড়ি সাজায় ও নিজে সাজে এবং ঐদিন ফুল পূজা করে। পহেলা বৈশাখে বাড়ির বায়োজ্যেষ্ঠাদের ম্লান করিয়ে নতুন পোশাক পরিধান করায়। পরে সুস্বাদু খাবার খাওয়ান। এদিন ঐতিহ্যবাহী হাঙ্গর মাছের শুঁটকি দিয়ে পাঁচন রান্না করে সকলকে আপ্যায়ন করেন। সারাদিন পাড়ায় সকলে আনন্দে মেতে থাকেন এবং প্রাণী হত্যা থেকে বিরত থাকেন। ম্রো যুবতীরা খোপায় ফুল গুঁজে এবং দাঁতে রং করে ক্লবংপাই উৎসবকে মুখরিত করে তোলে। এদিন পাড়ায় সকলে মিলে উৎসব উৎসবে মেতে ওঠায় এক অনাবিল আনন্দজনক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। সকলে কামনা করে যেন আগামী দিনগুলি সুখে, আনন্দে ও উল্লাসে কাটে।
মৃত্যু
ম্রো সমাজে কোন ব্যক্তির মৃত্যু হলে কুকুর আত্মাকে স্বর্গের পথ প্রদর্শন করবে এবং মুরগি সঙ্গী হবে এই রুপক প্রকাশ হিসেবে একটি কুকুর ও একটি মুরগি হত্যা করা হয় এবং বিভিন্ন আচার পালন করেন। খাল বা নদীর ধারে মৃতের দাহ করা হয়। কেননা শবদাহে সঙ্গে সঙ্গে পানি দিয়ে চিতা নিভানো যায়। চিতা নিভানো হলে আত্মার শান্তি হয় বলে তাদের ধারণা।
তথ্যসূত্র :
মেসবাহ কামাল, জাহিদুল ইসলাম, সুগত চাকমা সম্পাদিত আদিবাসী জনগোষ্ঠী, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ঢাকা, ২০০৭।
মঙ্গল কুমার চাকমা ও অন্যান্য সম্পাদিত বাংলাদেশের আদিবাসী, এথনোগ্রাফীয় গবেষণা (১ম খণ্ড), উৎস প্রকাশন, ঢাকা, ২০১০।
সঞ্জীব দ্রং, বাংলাদেশের বিপন্ন আদিবাসী, নওরোজ কিতাবিস্তান, ঢাকা, ২০০৪।
মোহাম্মদ আব্দুল বাতেন, বাংলাদেশের ম্রো উপজাতির জীবনধারা, বলাকা প্রকাশন, চট্টগ্রাম, ২০০৩।
Abul Barkat, Sadeka Halim, Asmar Osman, Md. Ismail Hossain, Manzuma Ahsan, Status and Dynamics of Land Rights, Land use and Population in Chittagong Hill Tracts of Bangladesh, Human Development Research Centre, Dhaka, 2010
Chattapadhyaya. Annapurna. The People and Culture of Bengal: A Study in Origins Vol I, Farma Klm Private Limited, Kalkata, 2002.
ছবি: ইণ্টারনেট