মনিস রফিক : কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো নিজের জন্ম, বেড়ে উঠা আর কানাডার নেতৃত্বে আসার অসাধারণ কিছু ঘটনা উপস্থাপন করেছেন তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এ। জাস্টিন ট্রুডোর সাবলীল আর অসম্ভব সুন্দর বর্ণনা খুব সহজেই পাঠকের সামনে উম্মোচিত করে কানাডার রাজনীতি, সংস্কৃতি আর স্বপ্নকে। ইংরেজি ভাষায় লিখিত গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মনিস রফিক। ‘বাংলা কাগজ’ এ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এর অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে।

ঊনসত্তর.
আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, প্রচারণার সময় গুরুত্বপূর্ণ নীতি নির্ধারকদের কিভাবে চিহ্নিত করবো। আমরা তখন এটাও ঠিক করেছিলাম, যে দলটা আমার নেতৃত্বে সামনে এগুবে সেটাকে অবশ্যই উন্নয়নমুখী পরিকল্পনায় দক্ষ হতে হবে। সেই দল মুক্ত বাজার অর্থনীতিকে সমর্থন করবে এবং অর্থনৈতিক স্বচ্ছতা ও শৃংখলা প্রতিষ্ঠা করবে। সেই সাথে তারা সরাসরি বৈদিশিক বিনিয়োগের জন্য কাজ করবে। নব্বই দশকে লিবারেলরা অর্থনীতির ক্ষেত্রে যে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছিল সে ব্যাপারে আমাদের দীর্ঘ আলোচনা হয়েছিল, কিন্তু আমাদের সেই একত্রিত হওয়ার সময়ের পূর্বের দশক নিয়ে আমরা তেমন কোনো আলোচনা করিনি। এটাতো সত্য, অনেক ক্ষেত্রেই কঠোর পরিশ্রম করে আমরা যা অর্জন করেছিলাম, সেটা আমাদের হাতছাড়া হয়ে গেছে। আমরা বিশেষভাবে আলোচনা করেছিলাম, আমরা যদি সত্যিই গ্রহণযোগ্য আর কার্যকরী অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারণ করতে পারি, তাহলে সেটা আমাদের অর্থনীতিকে এমন এক জায়গায় দাঁড় করাবে, যা অসংখ্য মানুষের জন্য তাদের ঈপ্সিত চাকুরীর ব্যবস্থা করে দিবে। গত তিরিশ বছরে কানাডার মধ্যবিত্তদের জীবনে কী ঘটেছে, কী কী পরিবর্তন হয়েছে আর কি ধরনের অপ্রাপ্তির দীর্ঘশ্বাস পড়েছে, সে সম্পর্কে আমাদের একটা চুলচেরা উপস্থাপনা ছিল। আমরা সেই উপস্থাপনায় দেখেছিলাম, জনগণের ঋণ ক্রমে ক্রমে শুধু বেড়েই গেছে, কিন্তু সে তুলনায় তাদের উপার্জন বাড়েনি। আমরা অনুধাবন করেছিলাম, কেউই কানাডার ব্যাপক কাঠামোগত পরিবর্তনের পক্ষে আওয়াজ তুলেনি, যে পরিবর্তন অর্থনীতিতে একটা ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আনতে পারতো। আর এটা না হওয়ায় ক্রমে ক্রমে কানাডার খেটে খাওয়া মানুষদের জীবন কঠিন থেকে আরো কঠিনতর অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে।

কুইবেক নিয়ে আমরা একেবারে চুলচেরা আলোচনা করেছিলাম এবং আমাদের আলোচনার প্রধানতম বিষয় ছিল আমার নিজ প্রদেশেই লিবারেলদের অবস্থা কেন এত বেশী নাজুক হয়ে পড়েছে। এ ব্যাপারে তখনও আমার যে ধারণা ছিল সেটা এখনও একই আছে, আর সেটা হচ্ছে আমরা যে অস্তিত্ববাদী বিষয়গুলিকে বেশি গুরুত্ব দিই সেটা খুবই কম সংখ্যক মানুষই ধারণ করতে পারে। যখন স্পন্সরশীপ কেলেংকারী পার্টির সুনামের জায়গায় আঘাত করেছিল, তখন আমরা এমন কোন কিছু হাজির করতে পারিনি যা আমাদের অবস্থান আর ইমেজকে সবার সামনে সঠিকভাবে তুলে ধরতে পারে। সেই বছরগুলোতে কুইবেকের মানুষ সরকারের সব স্তরেই একটার পর একটা কেলেংকারী শুধু দেখেই গেছে। ফলে সরকারী কর্মকর্তাদের উপর তাদের বিশ্বাসটা একেবারে টলে গিয়েছিল। চারবোনিউ কমিশন সেই প্রতিদিনই ভয়ংকর যে সব তথ্য আমাদের সামনে হাজির করছিল সেটার প্রেক্ষিতে আমি সবাইকে সেই সময়ের কুইবেকের একটা চিত্র তুলে ধরেছিলাম। আমি সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলাম, কুইবেক এ লিবারেল পার্টিকে আবার সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করতে হলে আমাদের প্রধানতম কাজ হচ্ছে, পার্টির শেকড়ের কাছে ফিরে যাওয়া, আর জনগণের আলু মাংসের ব্যবস্থা করার জন্য তাদের চাকুরী, পেনশনের ব্যবস্থা করা এবং তাদের ছেলে মেয়েদের অনাগত অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের দিকে নজর দেয়া। সংক্ষেপে বলতে গেলে বলতে হয়, আমি সবার সামনে তুলে ধরার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েছিলাম, আমি কিভাবে পাপিনিউ’তে রাজনীতি করতে গিয়ে সফল হয়েছি, আর আমার পাপিনিউ’র সেই কাজের প্রক্রিয়াকে কিভাবে গোটা প্রদেশে ছড়িয়ে দিতে পারি।

এই জায়গাই আমি থেমেছিলাম এবং সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলাম, যদি আমরা এই আলোচনার মূল বিষয়গুলো নিয়ে সামনে এগুতে পারি, তাহলে আমরা যা স্বপ্ন দেখছি, সেটা বাস্তবায়িত করতে পারবো। সেই সময় আমরা সকলেই এই সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ব্যাপারে একমত পোষণ করেছিলাম। আমরা আমাদের নিজেদের মূল্যবোধ, প্রত্যাশা আর নিজেদের রাজনৈতিক সব অভিজ্ঞতা একে অপরের কাছে তুলে ধরেছিলাম। আমাদের অনেকের সাথেই সেদিন আমাদের বাচ্চারা ছিল। আমরা সেই সাথে আলোচনা করেছিলাম, লিবারেল পার্টি থেকে বিভিন্ন এলাকায় কারা সম্ভাব্য প্রার্থী হবার যোগ্যতা ও ক্ষমতা রাখে। অনেক লিবারেলের কাছে প্রার্থী হিসেবে আমার নাম ঘোষণা করা ছিল লিবারেল পার্টির অতীতের সেই সুদিনে ফিরে যাওয়া। আমার নামের শেষ অংশটা তাদের বার বার পার্টির সেই সুন্দর দিনগুলোর কথা মনে করিয়ে দিয়েছিল। আমি সবাইকে এটাও মনে করিয়ে দিয়েছিলাম, শুধু শুধু হৈ চৈ, আনন্দ আর পিকনিকের আমেজ নিয়ে সমাজ আর দেশ পরিবর্তনের জন্য যদি আমরা প্রচারণা চালিয়ে যাবার চিন্তা করি, তবে সেই রাজনীতিতে যুক্ত হওয়া বা লড়াই করার আমার কোন ইচ্ছে নেই। আমরা এমন এক রাজনীতিতে নিজেদের ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রাখতে চাই যা সত্যিকারের দেশ ও দশের উন্নয়নের জন্য কাজ করবে।

আমি সবার কাছে বিষয়টা পরিষ্কার করে দিয়েছিলাম, আমি যে প্রচারণাটা চালাতে চাই সেটার মূল লক্ষ্য থাকবে আমরা আগামীতে কি করবো, সেখানে কথায় কথায় যেন আমাদের সোনালী অতীতের স্মৃতি রোমন্থন করার অবকাশ না থাকে। আর আমাদের এই যাত্রায় আমি এক নতুন ধরনের রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে চাই যেখানে লাখে লাখে মানুষ আমাদের সাথে শামিল হবে। লিবারেল পার্টির সাথে যারা জড়িত আছে, অবশ্যই তাদের আমরা সাদর আমন্ত্রণ জানাবো, কিন্তু আমাদের পার্টির ভবিষ্যৎ কর্ণধার হবে তারাই, যারা মানুষের হৃদয় আর মন জয় করে কাজ করার ক্ষমতা ও মানসিকতা রাখে, আর যারা তথাকথিত রাজনৈতিক দলের সাথে কখনও সম্পৃক্ত হবে না। আমরা দেশের জন্য খুবই ইতিবাচক ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এক স্বপ্ন গড়তে চাই এবং এমন এক প্রবল বিশ্বাস ও মনোবল নিয়ে সামনে এগুতে চাই যে, আমাদের এই স্বপ্ন আর যাত্রায় যেন কানাডার জনগণ ধীরে ধীরে অংশ নিতে শুরু করে।

আমরা জানতাম অনেকেই আমাদের এই যাত্রার বিরোধীতা করবে। আমরা এটাও জানতাম, কনজারভেটিভ আর সহজ কথায় ডানপন্থীদের কাছে ট্রæডোর এই প্রচারণার কর্মকাণ্ড অনেকটা বিরক্তিকর ঠেকবে, এমনকি তারা এ ব্যাপারে হাসি তামাশা করতেও ছাড়বে না। আমি ধারণা করেছিলাম, তারা রূঢ়ভাবে আমাদের আক্রমণ করবে এবং এমনভাবে তারা তাদের প্রচারণা চালাবে যে, শেষ পর্যন্ত টিকে থাকা কিছু লিবারেল নেতাদের মধ্য একটা দ্ব›েদ্বর বীজ ঢুকিয়ে দিবে। তাদের আক্রমণগুলো অনেক ক্ষেত্রেই হবে নেতিবাচক, জঘন্য আর ব্যক্তিগত। তাদের খরচ করার মত মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার আছে, আর তারা এমন আক্রমণাত্মক কাজে নির্দ্ধিতায় এসব অর্থ খরচ করবে। আমাদের ধ্বংস করতে তারা নিয়ম নীতি আর নৈতিকতার কোন ধার ধারবে না। সব শেষে, আমি সেই কক্ষের

চারিদিকে ভালোভাবে একবার তাকিয়ে নিয়ে সবার দিকে আরেকটা খুব সাধারণ প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিলাম। প্রশ্নটি ছিল, ‘তোমরা সবাই কি আমাদের এই যাত্রার জন্য প্রস্তুত?’

২০১২ সালের অক্টোবরে ক্যালগরীতে নির্বাচনী প্রচারণায় জাস্টিন ট্রুডো

আমি দেখেছিলাম, একে একে উপস্থিত সবাই ‘হ্যাঁ’ বলতে শুরু করলো। তারা সবাই আমার সাথে এক হয়েছিল, এবং খুবই সঙ্গত কিছু কারণেই তারা সবাই আমার সাথে পথ চলতে রাজি হয়েছিল। আমার ভাবনাই ছিল, ব্যাপারটা কয়েক মাস পর প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সবাইকে জানাবো, কিন্তু সেই মুহূর্তে এবং সেই খানেই সোফি ও আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, আমরাতো ইতিমধ্যে সবাই এই যাত্রায় মনে প্রাণে শামিল হয়ে গেছি। অতএব, আমাদের কালক্ষেপণ করা উচিৎ হবে না। আমরা এক নতুন রাজনীতির জন্ম দিয়ে ভয় ও নেতিবাচক রাজনীতির পথ রুদ্ধ করে দিবো। সেই মুহূর্তে আমরা সবাই যে অনুভ‚তি ও স্বপ্ন নিয়ে এক হয়েছি এবং এক সঙ্গে নতুন পথে এগুনোর শক্তি অর্জন করেছি, সেই মাহেন্দ্রক্ষণটাকে আমাদের কাজে লাগাতে হবে এবং সামনে এগুনোর প্রত্যয়ে সেই মুহূর্তেই একটা সম্মিলিত স্বর উচ্চারণ করতে হবে। সেই মুহূর্তে আমাদের দুজনার ভাবনায় এসেছিল, সেই সময়টার সদ্ব্যবহার না করে যদি শুধু শুধু সময় ক্ষেপন করা হয় আর দলে দলে সবাইকে আলোচনা করার সুযোগ দেয়া হয়, তাহলে মূল লক্ষ্য থেকে অনেকেরই বিচ্যুতি ঘটতে পারে এবং নানা উপদল আর কোন্দল সৃষ্টি হতে পারে। আমরা যারা একই স্বপ্নের আলোয় নিজেদেরকে রাঙিয়েছি, সেই রাঙা আলো আমাদের এক করেছে আর একই প্রান্তে একই মিলনমেলায় হাজির করিয়েছে। সেই আলো, সময় আর স্থানকে আমাদের সম্মান করতে হবে। কারণ সেগুলো আমাদের একটা স্বপ্ন বুনতে সামনে এগিয়ে যাবার মন্ত্রণায় উজ্জীবিত করে তুলেছে, আর কানাডিয়ান হিসেবে একত্রে কাজ করার মন্ত্র যুগিয়েছে। সেদিন আমরা সবাই উপলব্ধি করেছিলাম, আমাদের এই পথ চলার প্রধানতম লক্ষ্যই হচ্ছে, কানাডা নামের এই চমৎকার দেশটির সার্বিক মঙ্গলের জন্য অবিরাম কাজ করে যাওয়া।
আর আমাদের মাটি থেকে উঠে দাঁড়িয়ে শক্ত করে পা ফেলে সামনে এগিয়ে যাবার এই অবিরাম যুদ্ধে সব সময় মূল শক্তি হিসেবে কাজ করবে আমাদের অশেষ আশা আর কঠোর পরিশ্রম। (চলবে)