ইউসুফ কামাল : প্রায় দেড় বছর পর দেশের মাটিতে পা রেখেছি। শারীরিক অসুস্থতার জন্য হিউষ্টনের মেথিডিষ্ট হাসপাতালে প্রায় দুই মাস চিকিৎসা শেষে পারিবারিক কিছু কাজের জন্য প্রিয় মাতৃভ‚মিতে এসেছি। পারিবারিক কিছু কাজের জন্যই মূলত এবার দেশে আসা। আসা যাওয়ার এই খেলাই চিরন্তন, কাজ শেষ করে আবার ফিরে গেলে কয়েকদিন পর মনে হয়, আরে ঐ কাজটা তো শেষ হলো না। তারপর থেকে শুরু হয় আবার ফিরে আসার তাড়া, কাজ শেষ করার তাড়া। এটাই যেন সমস্ত জীবনের চলমান নিয়ম। গতকাল আমার হিউষ্টন কেটি’র অবাঙালি বন্ধু খালিদের ফোন কল আসলো আমার হোয়াটস এ্যাপের নাম্বারে, বড়ই অসময়ে রাত চারটে নাগাদ। বুঝলাম সময়ের হিসাবটা উনি করে উঠতে পারেননি। টেক্সাস থেকে সুদুর লসএনজেল্স্ এর সময়ের পার্থক্য দু’ঘন্টা তার উপর আমি তো এখন স্বদেশে, আমার জন্মভ‚মি বাংলাদেশে।

সময়ের অনেক হেরফের। দেশে আসবার দু’দিন আগে ফোন করে খালিদকে বলেছিলাম, যাচ্ছি আপনার সেই হারানো বাস্তুভিটার দেশে। আমার কথায় হঠাৎ করে ওর কন্ঠস্বর থেমে গিয়েছিলো, নিজের সেই হারিয়ে ফেলা দেশের স্মৃতি মনে পড়ে যাওয়াতেই যে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল সেটা হাজার হাজার মাইল দূর থেকেও আমি টের পেয়েছিলাম। তারই ফলোআপ বন্ধু খালিদের কালকের এই অসময়ের কল; কি খবর? কেমন আছেন? আমার দেশ কেমন আছে? আমিও থমকে গেলাম, খালিদ খানের শেষ কথায়, জানতে চাইলো ওর দেশ কেমন আছে? খানিক ক্ষন কোন কথা বলতে পারলাম না, খালিদ খান ওর নিজের পরিবারের কারো সাথেই বাংলা বলেন না। কারণ কেউ বাংলা ভাষা বুঝে না এমন কি বলতেও পারেন না।
যে দেশ থেকে পরিবারের সবাইকে নিয়ে জীবনের ভয়ে পালিয়ে বেঁচেছেন, সেই দেশকে সম্মোধন করলেন নিজের দেশ হিসেবে। কি আশ্চর্যের বিষয়, কি মমত্ববোধ নিজের দেশের জন্য। যে দেশ তাকে ধারন করে রাখতে পারেনি, ঠাঁই দিতে পারেনি নিজের বুকে! তারপরও কি অদ্ভুত মায়া ভরা ভালোবাসা সেই দেশের জন্য। বিস্মিত হলাম খালিদের দেশের প্রতি ভালোবাসা দেখে, ফেলে যাওয়া দেশের প্রতি মমত্ববোধ দেখে। খালিদ খানের জীবন বেঁচে গিয়েছিলো একমাত্র ওর বাবার বুদ্ধিতে। ওর বাবা যুবক দুই ছেলেকে করাচী পাঠিয়ে দিয়েছিলেন (তখন তো একই দেশ) প্লেনের টিকিট করে। তখন না চলে গেলে হাজার হাজার অবাঙালির মতো তার জীবনের আলোও হয়তো নিভে আসতো নৃশংসভাবে। কিম্বা ক্যাম্পের আলো আঁধারেই দিন কেটে যেত, খুব বড় জোর যদি বেঁচেও থাকতো। খালিদের করাচী চলে যাওয়ার পরে ওর বাবা মা’র স্থান হয়েছিলো নাটোর আন্তর্জাতিক রেড ক্রস ক্যাম্পে। কয়েক মাস পরে অসুস্থ অবস্থায় ওর মায়ের মৃত্যু হয় ক্যাম্পেই আর বাবা পরবর্তিতে আন্তর্জাতিক রেড ক্রসের মাধ্যমে করাচী চলে যান।

গতকাল রাতে হঠাৎ করেই খালিদ খানের কথা মনে পড়ে গেল, হোয়াটস এ্যাপ দিয়ে ফোন দিলাম আমার ফোনে সেভ করে রাখা ওর ক্যালিফোর্নিয়ার নম্বরে। চার বার রিং বাজতে ওপার থেকে দুর্বল কন্ঠস্বর ইথারে ভেসে আসলো সেই পরিচিত সম্বোধন, কি খবর, কেমন আছেন? স্বরে বুঝলাম আমার বন্ধু খালিদ খান ভালো নেই। ভালোই অসুস্থ। অসুস্থতার কারণ জানতে চাইলাম, কি করে এমন হলো? ভাংগা গলায় বল্লেন, ঠান্ডা লেগেছে হঠাৎ করে। বয়স হয়ে গেছে তো, শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেছে। আপনি দেশে গেছেন শুনে আমার খুব যেতে ইচ্ছে করছিলো। তাই হয়তো অসময়েই ফোন দিলাম, কিছু মনে করবেন না। খুব মনে পড়ছে সেই প্রিয় মতিহার ক্যাম্পাস, ভ‚গোল ডিপার্টমেন্ট আর সহপাঠি হুস্না’কে। পাল্টা প্রশ্ন করলাম, কই আপনার মুখে তো এই নাম আগে কখনো শুনিনি। হাসতে যেয়ে জোরে জোরে কাশতে শুরু করে দিলেন বন্ধু খালিদ খান। কাশি থামতে হাপাতে লাগলেন, পরে দম নিয়ে বল্লেন হারিয়েই তো গেছে তবু কেন যেন ভুলতে পারি না! কয়েক বছর চিঠির মাধ্যমে খবর আদান প্রদান হতো, এক সময় সেটাও বন্ধ হয়ে গেলো। বাংলায় চিঠি আসতো তাই বাসার কেউ সেটা পড়তে পারতো না, এটা আমার জন্য এক ধরনের সুবিধাই ছিলো। শেষ চিঠিটা যখন পেয়েছিলাম তখন সে ভারতের আহমেদাবাদের বাসিন্দা। আমি দেশ থেকে করাচী চলে যাওয়ার মাস খানেক পর ওদের পরিবারও নিরাপত্তার কারণে ওর নানা বাড়ি ভারতের আহমেদাবাদ চলে যায়। যোগাযোগ বন্ধ হওয়ায় বুঝেছিলাম, ও হয়তো নতুন জীবনে প্রবেশ করেছে অথবা অন্য কোন সমস্যার কারণে ও যোগাযোগ রাখতে চাচ্ছে না। তাই আমিও আর ওকে বিব্রত করতে চাইনি। চেয়েছিলাম ও ভালো থাকুক।

নিজের দেশ ছাড়ার যন্ত্রণা আমি বুঝেছিলাম রাজশাহী ছেড়ে চলে যাওয়ার সময়, শুধু বুঝিনি কি অপরাধ ছিলো আমার? আমি তো কখনও কোন অপরাধমুলক কাজে থাকিনি তবে কেন আমাকে স্বদেশ থেকে বিতাড়িত হতে হবে? সেই ভয়ংকর দিনগুলো আমার জীবন থেকে চলে গেলেও স্মৃতিগুলো কিন্তু আমার পিছু ছাড়েনি। খালিদকে বলেছিলাম আমি দেশে থাকতে থাকতে থাকতে একবার চলে আসেন, দু’জনে মিলে ঘুরে ঘুরে দেখে আসবো আপনার সেই সব স্মৃতিময় স্থানগুলো। ভালো লাগা মানুষগুলোকে একবার দেখে যান। খালিদ আমাকে প্রশ্ন করেছিলো, আমাকে কি আমার সেই দেশে এখন ঢুকতে দেবে? অবাক বিস্ময়ে পাল্টা প্রশ্ন করেছিলাম, কেন দেবে না, আপনি তো এখন পৃথিবীর শক্তিশালী এক দেশের নাগরিক। বৈধভাবে ভিসা নিয়েই এ দেশে আসতে পারবেন, কোন সমস্যা হবে না। ধীর কন্ঠে খালিদ শুধু বল্লো, আচ্ছা দেখি।

মনে হলো, খালিদ আসবে না, ও আসতে পারবে না কারণ সেই পঞ্চাশ বছর আগের সেই ছবিগুলো এখনো যে ওর মনের মধ্যে জ্বল জ্বল করছে। যেটা এখনো ওভাবেই আছে। আমি আর কথা বাড়ালাম না, শুধু বল্লাম সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাকে জানাবেন। জানি অভিমানী পাখীরা একবার গৃহ ত্যাগী হলে আর ফিরে আসে না। আমার বন্ধু খালিদের বর্তমান অবস্থাও ঠিক তাই, দুঃখে ভরা মন নিয়ে একদিন সবার অজান্তেই সে হয়তো হারিয়ে যাবে সমস্ত মায়া মমতা ছিন্ন করে। দেশ বিভাগের অন্তরালে কতো লক্ষ প্রাণের হাহাকার যে লুকিয়ে থাকে, কে তার হিসেব রাখে? এক সময় সবাই সব কিছু ভুলে যায়। জীবনের নিগূঢ় বাস্তবতার কাছে সবাইকেই যে হার মানতে হয়।
(চলবে)
ইউসুফ কামাল : লেখক, রাজবাড়ী বাংলাদেশ