আতোয়ার রহমান : স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস শুধু নয় মাসের পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতা এবং মুক্তিসেনাদের বীরত্বের ইতিহাস নয়। বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতাসংগ্রামের ইতিহাস অনেক বিস্তৃত এবং সময়ের অনেক গভীরে তার শিকড়। তা শুধু ঘটনানির্ভর নয়-চেতনানির্ভর। তার সঙ্গে এই ভ‚খণ্ডের মানুষের সংস্কৃতি অর্থাৎ ভাষা, সামাজিক আচার-আচরণ, রীতিনীতি, অর্থনীতি, ধর্ম- জীবনের যাবতীয় বিষয় যুক্ত।
আমাদের মুক্তিযুদ্ব যেমন ছিল, মাটি ও মানুষের মুক্তির জন্যে, তেমনি ছিল কিছু মুল্যবোধ প্রতিষ্ঠার জন্যে। যে লক্ষ্য ও আদর্শ নিয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম স্বাধীনতার অর্ধ শতাব্দি পর আমরা কতটুকু অর্জন করতে পেরেছি? মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ছিল জাতীয় ঐক্য, ন্যায়, সাম্য ও গণতন্ত্র। স্বাধীনতা সংগ্রামের মর্মকথা ছিল অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ধর্মনৈতিক, সামাজিক সবধরণের অন্যায়-অবিচার, বৈষম্য থেকে মানুষের মুক্তি। কিন্তু স্বাধীনতার চার দশক পরও আমরা সেগুলো প্রত্যাশিত মাত্রায় অর্জন করতে পারিনি।
বিজয়ের তথা স্বাধীনতার অর্ধ শতাব্দির প্রাক্কালে দাঁড়িয়ে দেশ, এখনই আদর্শ সময় ‘উন্নত’ বাংলাদেশের স্বপ্নগুলোকে উন্মোচন করার। এমন এক বাংলাদেশ, যেখানে ঘৃণার উপর স¤প্রীতি বিরাজ করবে। ধর্ম, জাত, স¤প্রদায়, আঞ্চলিকতার কারণে কোনও নাগরিক যদি ঘৃণার শিকার হন, তাহলে অপরাধীদের যেন বিচার হয় এবং শাস্তি হয়। বিদ্বেষ ছড়ায়, ঘৃণা ছড়ায় যারা, স¤প্রদায় নির্বিশেষে তাদের যেন আজীবনের জন্য কারারুদ্ধ করা হয়।
এমন এক বাংলাদেশ, যেখানে ‘সব ঠিক আছে’ জাতীয় ভুয়ো ধারণা তৈরির জন্য মিথ্যা তথ্যের জাল বোনা হবে না।
এমন এক বাংলাদেশ, যেখানে চিকিৎসার অধিকার সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা দ্বারা নির্ধারিত হবে না। যেখানে জনস্বাস্থ্যব্যবস্থায় ‘ভিভিআইপি’ সুবিধাভোগী শ্রেণির উপরে স্থান পাবে সাধারণ মানুষ, যেখানে এটা নিশ্চিত করা হবে যে, কেউ জরুরি অবস্থায় হাসপাতালের বিছানা থেকে বঞ্চিত হবে না, হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের ভোগান্তি পোহাতে হবে না। কেউ আক্ষেপ করে বলবেনা, ‘এ দেশে গরিবদের অসুখ অইতে নাই।’
এমন এক বাংলাদেশ, যেখানে আমরা বিভাজন কমিয়ে আনব, বৈষম্যের ধারণাকে বৃদ্ধি পেতে দেব না। যেখানে সরকারি কর্মচারীরা দেশের বাসিন্দাদের ‘প্রজা’ এবং নিজেদের ‘রাজলস্কর’ হিসেবে দেখবেন না। এ কারণে কোনো নাগরিক ‘স্যার’ না বলে ‘ভাই’ বা ‘আপা’ বললেই তার মধ্যে তিনি রাজাজ্ঞা লঙ্ঘন খুঁজে পাবেন না। এতে তাঁর গায়ে জ্বলুনি শুরু হবে না।এটা বলার দায়ে নাগরিককে কান ধরে উঠ বস করাবেন না বা কক্ষ থেকে বের করে দেবেন না।
এমন এক বাংলাদেশ, যেখানে দারিদ্র মোচনকে মানবতার সবচেয়ে বড় সেবা হিসাবে দেখা হবে।
যেখানে সংসদ একতরফা নয়, নয় বিরোধীদের বাধা দেওয়ার জায়গা, বরং বিতর্ক, ভিন্নমত এবং সংলাপের মতো গণতান্ত্রিক মূল্যবোধগুলির চূড়ান্ত প্রতীক। সংসদ কখনও একাধিপত্য বিস্তারের আরও একটি ক্ষেত্র হতে পারে না, যেখানে নিষ্ঠুর সংখ্যাগরিষ্ঠতায় সিদ্ধান্তগুলো চাপিয়ে দেওয়া হয়।
এমন এক বাংলাদেশ, যেখানে সরকার তার নাগরিকদের গোপনীয়তার অধিকার লঙ্ঘনের অপরাধে অভিযুক্ত হবে এবং তা প্রাতিষ্ঠানিক তদন্তের বিষয় হয়ে উঠবে। যেখানে স্বাধীন ও উন্মুক্ত সমাজকে নিশ্চিত করতে হবে যে, যারা তাদের বহুলালিত স্বাধীনতাকে ব্যাহত করতে চায়, তাদের নিন্দা করা হবে এবং বিষয়টি তদন্তের আওতায় পড়বে।
এমন এক বাংলাদেশ, যেখানে গণতন্ত্র মোটেই পাঁচ বছর অন্তর অন্তর পালন করার মতো কোনও আচার-অনুষ্ঠান নয়, যা কিনা কেবল ভোটদান প্রক্রিয়ায় সীমিত থাকবে। যেখানে নির্বাচিত প্রতিনিধি জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য হবে এবং জনসাধারণের থেকে বিচ্ছিন্ন সামন্তপ্রভু হয়ে বিরাজ করবে না।
এমন এক বাংলাদেশ, যেখানে সরকারের মতাদর্শগত বিরোধীরা তাৎক্ষণিকভাবে ‘দেশদ্রোহী’-র তকমা পাবে না, যেখানে আমরা উপলব্ধি করব যে, সত্যিকারের দেশপ্রেম সরকারি নির্দেশমাফিক নির্ধারিত ভুল ও ঠিকের অন্ধ অনুকরণ নয়। যেখানে ভিন্নমতকে অপরাধ হিসাবে গণ্য করা হবে না, প্রায় বিনা প্রমাণে ‘সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড’ হিসাবে চিহ্নিত করা হবে না।
এমন এক বাংলাদেশ, যেখানে নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ আম্পায়ার হিসাবে কাজ করবে, ক্ষমতাসীন দলের দ্বাদশ ব্যক্তি হিসাবে নয়। যেখানে আইনশৃঙ্খলা-রক্ষাকারী বাহিনীকে রাজনৈতিক সাফল্যের জন্য অপব্যবহার করা হবে না।
এমন এক বাংলাদেশ, যেখানে কোনও মহিলা নিগৃহীত হবেন না। যেখানে এই ধরনের মামলায় নিষ্পত্তি দ্রুত এবং নিশ্চিত করা হবে। যেখানে ভিকটিমের পরিবারকে আদালতের সিদ্ধান্তের জন্য বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হবে না, যেখানে সাক্ষীদের সাক্ষ্য-বিবৃতি পরিবর্তন করতে ভয় দেখানো হবে না, যেখানে নারীর সম্মান চিরাচরিত নারীবিদ্বেষী আচরণ দ্বারা নির্ধারিত হবে না।
এমন এক বাংলাদেশ, যেখানে জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যাকে যুক্তিযুক্তভাবে এই শতাব্দীর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হবে। এমন এক বাংলাদেশ, যেখানে কেঁউ খাল বিল নদী নালা জঙ্গল দখল করতে পারবে না।
এমন এক বাংলাদেশ, যা শুধুমাত্র ক্রিকেট নিয়ে আবেগপ্রবণ দেশ হয়ে থেকে যাবে না, বরং ফুটবলসহ অলিম্পিকেও একটি শক্তিশালী দেশ হয়ে উঠবে। খেলার তারকাদের উদ্যাপন করার সময় ক্রীড়াবিদকে সম্মানিত করার সময় যেন তাঁদের ছবি রাজনৈতিক নেতাদের চেয়ে বড় হয়! সংবাদ সন্মেলনে কর্মকর্তাদের সামনের সারিতে রেখে তাদের যেন পেছনের সারিতে ঠেলে না দেয়া হয়।
পুনশ্চ, এই স্বপ্ন শুধু উন্নত বাংলাদেশের জন্য নয় বরং উন্নত মিডিয়ার জন্যও: যেখানে চেতনাকে রোমাঞ্চের ঊর্ধ্বে এবং সংবাদকে চিৎকারের ঊর্ধ্বে রাখা হবে। আর হ্যাঁ, সেই গণমাধ্যম ক্ষমতার সামনে সত্যিকথা বলার সাহস রাখবে, ক্ষমতার সামনে নুয়ে পড়বে না। শুভ স্বাধীনতা দিবস!