বিদ্যুৎ সরকার : বেহুলার ভেলা ভাসে নদীর জলে। চন্দ্রমুখী ল²ীন্দরের ভালোবাসার নিথর দেহ স্রোতের টানে ছুটে চলে উজানে। করম আলীর লাঙ্গলের ফলায় কী দারুণ চকচকে সূর্যোদয়। উর্বর ও ভালোবাসার পরাগ উঠে আসে করম আলীর বলিষ্ঠ হাতের যাদুকরী কর্ষণে। করম আলী একই গাঁয়ের বাসিন্দা, স্কুলের সহপাঠী, একই মেঠোপথে সুদূরের পথযাত্রী। হেঁটে হেঁটে কখনো আমরা হারিয়ে যেতাম নীল-সবুজের মিলন রেখায়। করম আলী এখনও নীল আকাশ দেখে আর দেখে মাইল মাইল সবুজ শস্যক্ষেত্র। পুলকিত হয় কৃষকের ভাললাগার কথা ভেবে ভেবে। গোলায় গোলায় ধান উঠবে। উঠবে নানান সঞ্জীবনী ফলন। কৃষকের হাসিতে আলোকিত হবে তামাম গ্রাম-গঞ্জ। নন্দী পাড়ায় আবার বসবে যাত্রার আসর। রক্ত প্রবাহের সহসা চঞ্চলতায় উৎসবের মনোময় মহড়া। পৌষ সংক্রান্তিতে আকাশ জুড়ে শত শত রঙিন ঘুড়ি করম আলীর আকাশকেও রাঙিয়ে তুলে। লাটাইয়ের সঙ্গে ঘুড়ির যেমন নিবিড় সম্পর্ক, করম আলীর সাথে আমার সম্পর্কটিও তেমন। লাটাইয়ের সুতোর টানে যেমন ঘুড়ি উড়ে উড়ে বেড়ায় আকাশ থেকে আকাশে, আমরাও ভালোবাসার সুতোর টানে একে অপরকে কেন্দ্র করে ঘুরতে থাকতাম সুখে-দু:খে, সময়-অসময়ে।
করম আলীর চোখের আঙ্গিনায় ছানির হাতছানি। মনের আকাশের রঙিন ঘুড়িরা কেমন ঝাপসা হয়ে আসে ক্রমশ:। কাছের জনকেও কেন জানি অনেক দূরের মনে হয় প্রতিনিয়ত। করম আলীর জীবন সঙ্গিনীর অকাল জীবনাবসানে সমস্ত ভালোবাসা, ভাললাগা বর্ণহীন হয়ে যায় বুঝি গাঁয়ের সবুজ প্রান্তরে। করম আলী আমার জীবনের এক ঝাঁক আলোকিত জোনাকি। যার পিছন ছুটে ছুটে আমাকেও আলোকময় করে তুলেছে। ছন্দায়িত করেছে শৈশবের প্রতিটি মুহূর্ত। ইদানিং আমি যেন একটু একটু করে অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে যাচ্ছি প্রতিদিন। করম আলীর আলোকবর্তিকার প্রযত্নে আমি ফিরে যেতে চাই বারবার।
বিদ্যুৎ সরকার : লেখক, আলোকচিত্রী, টরন্টো, কানাডা