ভজন সরকার : কলাবাগান বাসস্ট্যান্ড থেকে ধানমন্ডি লেকের উলটো দিকে যে গলিটি গ্রিনরোডের দিকে চলে গেছে, তার ঠিক মাঝামাঝি আরেকটি গলি পশ্চিমদিক থেকে এসে মিশেছে। ওই সরু পশ্চিম গলির দু’টো বাড়ি পরেই ছয় তলার একটি বাড়ি। ছয় তলা বাড়ির ঠিক উপরের তলায় ব্যাচেলারদের একটি মেস। সেই মেসেরই একজনের কাছে এসে উঠেছে ছেলেটি।

এখন যেমন প্রায় সব বিল্ডিংয়েই সারাক্ষণ দারোয়ান দেখা যায়। ঢাকা শহরের সব ফ্ল্যাট বাড়িতে তখনও দারোয়ানের ব্যবস্থা হয়নি। কলাবাগানের পশ্চিমগলির ওই বিল্ডিংয়েও তখন দারোয়ান নেই। মেইন কলাপ্সিবল গেইটে সারাক্ষণ একটি ঢাউস আকারের তালা ঝুলানো থাকে। প্রতিটি ফ্ল্যাটে চাবি আছে। যার যার সুবিধে মতো চাবির সংখ্যা বাড়িয়ে নেয়। কিন্তু সমস্যা হয় গেস্ট আসলে। দেখা যায় নিচের তলায় যারা বাস করেন, বিরামহীন লোহার গেইটে ধাক্কাধাক্কির ধকল তাদেরই সহ্য করতে হয়।

নিচতলার বাসিন্দা হিসেবে আমাকেও এই লোহার গেইট ধাক্কাধাক্কির ধকল সইতে হয়। অনেক সময় কানে তুলো দিয়ে থাকি। দেখা গেল দুপুরে খাওয়ার পরে একটু শরীর এলিয়ে দিয়েছি বিছানায়, এমন সময় কোনো নাছোড়বান্দা বিরামহীনভাবে বিশাল তালা দিয়ে সজোরে গেইটে আঘাত করছে। কানে দু’হাত কেন, তুলো দিয়ে শুয়ে থাকলেও রক্ষা নেই। শত সহস্র ডেসিবেলের শব্দ আপনার ব্রহ্মতালু কাঁপিয়ে দেবেই।
তেমনি এক দুপুরে প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে দরজা খুলে ভেবেছিলাম দেবো এক প্রচণ্ড জোরে ধমক। কিন্তু দরজা খুলে বের হ’তেই বাইরে থেকে এক যুবকের কন্ঠ, “আমি দেবজ্যোতি। দাদা, তালাটা একটু খুলে দেবেন কি দাদা?।”

কলকাতার খাঁটি ঘটি উচ্চারণের এ আকুতি শুনে একটু কৌতুহল হলো আমার। ঘরের ভিতর থেকে চাবিটা নিয়ে তালা খুলে দিলাম। বছর তিরিশের এক যুবক। হালকা পাতলা গড়ন। একটি সরু গোঁফ নাকের নিচে দু’পাশে ছড়িয়ে পড়েছে। পিঠে একটি ট্রাভেল ব্যাগ। লম্বাকৃতির একটু শ্যামলা মুখের উপর বড় এক জোড়া চোখ। চাহনিতে এমন এক আকুতি আছে যে, চাইলেই উপেক্ষা ক’রে দূরে সরে যাওয়া যায় না। ট্রাউজার জাতীয় কিছু একটা পরা। সাথে একটি রেসিং সাইকেল। মাথার পরিপাটি চুল দেখে বোঝা যায়, হেলমেটটি এই মাত্র খুলে সাইকেলের হাতলে রেখেছে। হাতের দস্তানা দু’টো তখনও হাতেই।
আমি বললাম, “কোন্ ফ্ল্যাটে যাবেন?”

কলকাতার লোকজন যা করে, দেবজ্যোতিও তাই করলো। হাতের দস্তানা খুলে সাইকেলটা পায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখে দু’হাত জোড় ক’রে নমষ্কার দিলো। আমি মাথা নাড়লাম। দেবজ্যোতি যার কথা বললো, তাকে ঠিক চিনতে পারলাম না। তবে সবিস্তারে জানার চেষ্টা ক’রে যা বুঝলাম, ছয় তলার মেসের এক বাসিন্দার কাছেই যাবে সে।
বাংগালির সহজাত অভ্যেস সব কিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানা। দরকার নেই তবুও ঠিঁকুজি জেনে নেবে। ভাবখান এমন যে, ভবিষ্যতে তার সাথে আত্মীয়তা করবে। আমিও দেবজ্যোতির কাছ থেকে নাড়ি-নক্ষত্র জেনে নিলাম বেশ লম্বা সময় ধরে। শুধু দেবজ্যোতি বা তার চোদ্দগোষ্ঠী নয়, ছয়তলার যার কাছে যাবে তারও ব্যবচ্ছেদ করা হলো। প্রায় আধা-ঘন্টা জিজ্ঞাসাবাদের পরে দেবজ্যোতি কলাপ্সিবল গেইটের ভিতরে ঢুকার অনুমতি পেল।

দেবজ্যোতি এটা জানত যে তাকে ছয় তলায় উঠতে হবে। কিন্তু সিড়ি বেয়ে উঠতে হবে সেটা হয়ত ভাবেনি। তাই পিঠে ঝোলানো বড়সড় ব্যাগের সাথে সাইকেল কিভাবে উঠাবে সেটা নিয়ে একটু ইতস্তত করতে লাগলো। আমি অযাচিত আগ্রহে বললাম, “আপনার সাইকেলটি বেশ দামী। তাই নিচে রাখা তেমন নিরাপদ নয়। ছয় তলায় উঠানোও বেশ কষ্টকর হবে, তাই যদি ইচ্ছে করেন আমার বাসায় রেখে যেতে পারেন”।
দেবজ্যোতি সম্মতি জানিয়ে বললেন, “ঠিক বলেছেন দাদা। আমি বিশ্ব ভ্রমণের পরিকল্পনা নিয়ে এই বাইকটি কিনেছি বেশ দাম দিয়েই। আর আমার প্রথম ভ্রমণ এই বাংলাদেশে। তাই সাইকেলটি আমি হাতছাড়া করতে চাই না। তবে দাদা, আপনি যখন সম্মত হয়েছেন তখন আপনার বাসাতে বাইকটি রেখে আমি নিশ্চিন্ত হ’তে পারবো। দিন চারেক থাকবো এখানে। তাই প্রতিবেলা উঠানো -নামানোর ঝক্কিঝামেলা থেকেও রেহাই পাব। ধন্যবাদ, দাদা”।

আমিও স্মিত হেসে উত্তর দিলাম, “ভালোই হলো। আমিও সপ্তাহখানিক বাসাতেই থাকবো। বাইক আনা-নেওয়ার সময়ে আপনার সাথে টুকটাক কথাও বলা যাবে। আপনার ভ্রমণ পরিকল্পনা নিয়ে জানা যাবে। বাংলাদেশি কেন প্রথমে আসা সে নিয়েও আলাপ করা যাবে”।
সেদিনের মতো দেবজ্যোতি বাইকটি আমার ফ্ল্যাটে রেখে উপরে চলে গেল। বেশ আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, দেবজ্যোতি আমার নামটা পর্যন্ত জিজ্ঞেস করলো না। দেবজ্যোতি ঢাকায় কিছু তথ্য নিয়ে ঢাকার অদূরের এক এলাকায় যাবে। যে অঞ্চলের কথা বলল, ১৯৭১ সালে সেখানে পাকিস্তানী মিলিটারির সাথে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথবাহিনী, যাকে মিত্র বাহিনী বলা হয়, তাদের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়েছিল। উভয় পক্ষেই ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছিল। একজন ভারতীয় বাংগালি মেজর নিখোঁজ হয়েছিল। কিন্ত দেবজ্যোতির কী কাজ ওখানে?
পরের দিন দেবজ্যোতির কলিংবেলে সকালের ঘুম ভাংগে। এতো সকালে আমি কখনোই ঘুম থেকে উঠি না। এমনিতেই ঘুম বড় পছন্দের। হঠাৎ করেই সপ্তাহখানিক ছুটি পেয়ে সকালের ঘুমটা আরামেই ঘুমাই। অভ্যেস মতো ঘুম ভেঙ্গে গেলেও শরীর কম্বলের সাথে লেপ্টে পড়ে থাকি। সেদিনও সেভাবেই ছিলাম। দেবজ্যোতির ডাকে দরজা খুলে দিলাম।

ছেলেটি ঘুম ভাংগানোর জন্য “সরিটরি” না বলেই ডাইনিং রুমের দেয়ালে ঠেস দিয়ে রাখা সাইকেলটি নিয়ে বাইরে চলে এলো। আমি জানি দেবজ্যোতির কাছে মেইন গেইটের চাবি নেই। আমি নিজেই তালে খুলে দিলাম। বাইরে যাবার সময় “থ্যাঙ্ক ইউ” এবং “বাই” বলে বিদায় নিলো। বাংলাদেশ ও ভারতে বিদায় সম্ভাষণের বেলায় “টা টা” বলাতেই অভ্যস্ত কিন্তু দেবজ্যোতি “বাই” বলাতে একটু অবাকই হলাম। তাছাড়া কালকেও লক্ষ্য করেছি ছেলেটির বাংলা উচ্চারণে কলকাতার প্রমিত ভাবটি তেমন নেই। একটু লক্ষ্য করলেই বোঝা যায়, হিন্দি এবং ইংরেজি মিশিয়েই বাংলা বলে দেবজ্যোতি।
দু’দিন হলো দেবজ্যোতি সকালে বেরিয়ে বিকেলে ফেরে। আমি প্রতিবারের মতোই সকাল-বিকেল মেইন গেইটের তালা খুলে আমার ঘরেই সাইকেলটি রেখে দিই। দেবজ্যোতি ছ’তলার ফ্ল্যাটে তার গন্তব্যে চলে যায় সিঁড়ি বেয়ে। বেশ স্বল্পভাষী ছেলেটির চোখেমুখে কালকে একটু বিষন্নতার ছাপ দেখলাম। ভেবেছিলাম হয়ত ঢাকার ডিসেম্বর মাসের এই শীতের হাওয়া মেশানো নরম রোদেও সাইকেল চালিয়ে ক্লান্ত দেবজ্যোতি।
তৃতীয় দিন বিকেলেও দেবজ্যোতির মুখে অবসাদের ছাপ। আমি কিঞ্চিত চিন্তিত হলাম। আবার একটু ভয়ও পেলাম। প্রতিবেশী দেশের লোক। বাইক চালিয়ে ভ্রমণে এসেছে। কে জানে কোনো গোয়েন্দা-ফয়েন্দা নয় তো?

দেবজ্যোতি নামের মতোই তার মুখে এক জ্বাজ্জল্য আলোর দ্যূতি আছে, যা মানুষকে টানে। দেবজ্যোতি এই তিন দিনে আমাকে কম বিরক্ত করে নি। তবুও আমি আমার স্বভাবজাত অধৈর্য্য স্বভাবকে সরিয়ে রেখে অজ্ঞাতকারণে দেবজ্যোতির প্রতি নরম আচরণ করছি।
দেবজ্যোতিকে আগ বাড়িয়েই বললাম, “তুমি আমার চেয়ে বয়সে অনেক ছোটই হবে। তাই তুমি করেই বলি”।
দেবজ্যোতি শান্তভাবে বলল, “ওহ ইয়া,অব কোর্স আপনি তুমি করে বলবেন। তাছাড়া আমরা দিল্লির বাসায় তো সবাইকে তুমি করেই বলি। কলকাতা থেকে যখন কেউ পুজোয় বেড়াতে যায়, ছোট বড় সবাইকে আমরা তুমি করেই বলি। মাই মম হ্যাজ টট আচ লাইক দিস, আমার মা এভাবেই শিখিয়েছে”।
আমি বললাম, “ওহ, তোমরা দিল্লি থাকো বুঝি? মা ছাড়া আর কে কে আছেন?”
দেবজ্যোতি উত্তর দিল, ‘মা শুধু। আমার গ্র্যান্ড প্যারেন্ট ছিলেন। বাট বোথ অব দেম হাভ পাসড এওয়ে ফিউ ইয়ার্স ব্যাক। উনারা ক’বছর আগে মারা গেছেন”।

আমি বললাম, “তুমি কিছু মনে না করলে আমার এখানে কিছুক্ষণ বসতে পার। আমি চা বানাই”।
দেবজ্যোতি মাথা নাড়ল। আমি ড্রইং রুমে নিয়ে বসালাম। দেবজ্যোতির সাথে অনেক কথা হলো সেদিন।
“প্রতি সকালে বেড়িয়ে সারাদিন ঢাকা শহর ঘুরে দেখো বুঝি?” আমি প্রশ্ন করলাম।
দেবজ্যোতি উত্তর দিল,” না, আমি প্রতিদিন ইন্ডিয়ান হাইকমিশন অফিসে যাই। ধানমন্ডি ২ নম্বরে ওদের যে অফিস আছে সেখানে?”
“প্রতিদিন যাও, তোমার কোনো আত্মীয় ওখানে আছেন বুঝি” –আমি বললাম।
দেবজ্যোতি প্রথমে একটু ইতস্তত করেও পরে খুলে বললো। ইন্ডিয়ান হাইকমিশন অফিসে কিছু তথ্যের জন্য যায় দেবজ্যোতি। ইতিমধ্যেই কিছু তথ্য পেয়েছে। কিছু লোকের রেফারেন্সও। আগামী ক’দিনের মধ্যে তাদের সাথে দেখা করবে।
আমি বেশ কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,” তথ্যগুলো খুব জরুরী বুঝি তোমার জন্য? যদি ইচ্ছে করো আমাকে বলতে পারো যদি একান্ত কনফিডেন্সিয়াল না হয়”।

দেবজ্যোতি সামনে রাখা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে একটু সময় নিলো। আমি বললাম, “ঠিক আছে, বলতে না চাও বলার দরকার নেই। তুমি এতোদূর এসেছ, তাই বললাম। যদি তুমি নিজেই পারো, দ্যাটস গুড এনাফ। বাট নেভার হেজিটেট ট্যু আস্ক মি ইফ ইউ ফিল কমফোরটেবল, ওক্কে”?
আমার ইংরেজি উত্তরে দেবজ্যোতি একটু আস্বস্ত বলে মনে হলো। বলল,” অব কোর্স দাদা। আই উইল আস্ক ইউ ডেফিনেটলি। আমি অবশ্যই বলবো। তবে একজনের নাম পেয়েছি বাবা নাকি শেষ সময়ে তার সাথেই ছিলেন। দেখি, দ্যাটস জেন্টেল ম্যান ক্যুড হেল্প মি অর নট?”
আমি বললাম, “ওকে ইয়ং ম্যান। গুড লাক। তোমার বাবা এখানে চাকুরী করতেন বুঝি?”
দেবজ্যোতি বললো, “না। আমার বাবা ইন্ডিয়ান সেনাবাহিনীর মেজর ছিলেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশে ঢাকার পাশেই কোথাও নিহত হোন। আমি তখন মাত্র ২ বছরের। বাবার স্মৃতি কিছু নেই। মা এখন মৃত্যুর দিন গুনছে। ক্যান্সার। আই প্রমিজড মাই মম টু গিব হ্যার ইনফরম্যাশন আবাউট মাই ড্যাড। আই মিন , বাবা কোথায় মারা গেছেন। কিভাবে মারা গেছেন। হ্যাড হি বিন বারিড অর নট। কোথায় বাবাকে দাহ করা হয়েছে? এই সব জানার জন্যেই আমার বাংলাদেশে আসা”।

আমি অবাক বিস্ময়ে দেবজ্যোতির বাংলা -ইংরেজি মেশানো কথাগুলো শুনে গেলাম। মনের কোণায় কোথায় যেন এক টুকরো কালো মেঘ জমলো। আজ ডিসেম্বরের এগারো তারিখ। ১৯৭১ সালে এই মাসেই হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীর সাথে ভারতীয় বাহিনী ও বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর মিলিত মিত্র বাহিনীর সাথে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হচ্ছিল বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। উত্তর -পূর্ব দিক থেকে ঢাকা শহরের দিকে মিত্র বাহিনী অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে এসেছিল এই সময়ে।
পাকিস্তানী সেনাবাহিনী নিশ্চিত পরাজয় অনুধাবন করতে শুরু করেছিল এই সময়ে। দেশীয় রাজাকার -আলবদরদের সহায়তায় পাল্টা আক্রমন করে হতাহতও করেছিল মিত্রবাহিনীর অনেক। এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, ভারতীয় বাহিনীর প্রায় ১৭ হাজার নিহত হয়েছিল। এর মধ্যে কয়েক শত অফিসারও ছিলেন। দেবজ্যোতির বাবা হয়ত তাদের মধ্যে একজন।

এই দীর্ঘদিন পরে দেবজ্যোতি তার নিহত বাবার শেষ দিনগুলো জানার জন্যে এসেছে। ফটো এলবামে দেখা বাবার ছবি ছাড়া হয়ত তার কোনো স্মৃতিই আজ অবশিষ্ট নেই। কিন্তু তার মা হয়ত তাকে বাবার স্মৃতির মধ্যেই মানুষ করেছে। তাই মায়ের শেষ সময়ে মাকে যদি কিছু সান্ত¡না দেওয়া যায় দেবজ্যোতির সেটাই শেষ প্রচেষ্টা। আমি জানি না, দেবজ্যোতিকে কী বলবো? শহীদের সন্তান? আমাদের প্রিয় জন্মভ‚মির মুক্তি সংগ্রামে জীবন উৎসর্গ করা এক বীরের সন্তান?
এসব ভাবতে ভাবতে খেয়াল করলাম দেবজ্যোতি চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে টেবিলে খালি কাপটি রেখে দিলো। আমি বেশ অপ্রস্তুত হয়েও নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, “তুমি জানো কিনা জানি না। আমি সাংবাদিকতা করি। কিঞ্চিৎ লেখালেখিও। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমার কিছু গবেষণা কাজও আছে। তুমি যদি চাও আমিও তোমাকে কিছু তথ্য জানাতে পারি”।

চা শেষ করে দেবজ্যোতি উঠতেই চাচ্ছিল। আমার কথা শুনে আবার সোফায় বসলো। আমাকে পকেট থেকে একটি কার্ড দেখিয়ে বললো, “এই ভদ্রলোক নাকি তখন মিত্র বাহিনীর সাথে ছিলেন। উনার কাছে গেলেই নাকি বাবার শেষ দিনগুলো জানা যাবে।”
দেবজ্যোতি আরও বললো, “আমরা জেনেছি বাবা ঢাকার কাছেই এক যুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন স্থানীয় পাকিস্তানী কোলাবরেটোরদের হাতে। এই ভদ্রলোকের সাথেই নাকি বাবা বেরিয়েছিলেন ক্যাম্প থেকে। সাথে কোনো ইন্ডিয়ান বাহিনী ছিল না। তারপর থেকে বাবার কোনো খোঁজ মেলেনি”।
আমি হাত বাড়িয়ে ভিজিটিং কার্ডটি হাতে নিলাম। কার্ডে লেখা নাম দেখে আমি “ওহ মাই গড” বলে উঠলাম। দেবজ্যোতি অবাক হয়ে বললো, “হোয়াটস হ্যাপেন্ড? ডু ইউ নো হিম? দাদা, আপনি কি এই ইন্ড্রাস্টিয়ালিস্ট চৌধুরীকে চেনেন?”
আমি একটু চুপ করে থাকলাম। জানি না স্মৃতি কতো দ্রুত গতিতে পেছনে যায়? হয়ত তার চেয়ে দ্রæত গতিতে আমি ফিরে গেলাম স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে একটি এসাইন্টেমেণ্ট কভার করার সময়ে। তখন আমি সবে মাত্র সাংবাদিকতা শুরু করেছি। অফিস থেকে ঢাকার অদূরে কাঁচপুরে এক ভারতীয় অফিসারের রহস্যজনক নিখোঁজ হওয়ার অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরী করার ভার এসেছে।

আমি দীর্ঘদিন গ্রামে গ্রামে ঘুরেছি। সে সময়ের মুক্তিবাহিনীর সাক্ষাতকার নিয়েছি। আজ দেবজ্যোতি যে ভদ্রলোকের ভিজিটিং কার্ড দেখালো তার সাথেও কথা বলেছি। আমি কোনো নিশ্চিত তথ্য প্রমান সংগ্রহ করতে পারি নি তখন। তবে আমি সবার সাথে কথা বলে একটি প্রতিবেদনও তৈরী করেছিলাম। সম্পাদক সাহেব সেটি প্রকাশ করতে অপরাগতা প্রকাশ করেছিলেন তখন। বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক নষ্ট হতে পারে এ আশঙ্কা থেকেই প্রতিবেদনটি আলোর মুখ দেখেনি।
কী ছিল আমার সে প্রতিবেদনে? সময় গড়িয়ে গেলেও আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে প্রতিবেদনের কথাটি। আমার সাংবাদিকতা জীবনের প্রথম এসাইনমেন্টটি প্রথম সন্তানের মতোই বড় আদরের ও স্নেহের। তাই এতোদিন পরেও ভুলতে পারি নি। আজ সেটি আবার স্মৃতিপটে জ্বলজ্বল করে উঠলো!

ভারতীয় সেনাবাহিনীর বাংগালি মেজরের নিখোঁজের বিষয়টি তখন মুক্তিবাহিনীর মধ্যেও বেশ আলোচিত ছিল। আমার নেওয়া সাক্ষাতকারেও বুঝেছিলাম, এই মেজরের অপমৃত্যু হয়েছে তারই বিশ্বস্ত এক লোকের সহায়তায়। যে রাতে বাংগালি মেজর নিখোঁজ হোন সেদিন ভোর রাতে একটি লাশকে ভাসিয়ে দিতে দেখেছিল কিছু গ্রামবাসী। ভিজিটিং কার্ডের ভদ্রলোক তখন ওই এলাকার ইউনিয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান। যুদ্ধে না গিয়েও মুক্তিবাহিনীর পক্ষে গোপনে কাজ করতেন বলে পুরষ্কৃতও হয়েছিলেন তখন।
এক গ্রামবাসী তখন আমাকে বলেছিলেন , সেদিন রাতে একটি লাশ যখন নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়, তখন ইউনিয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যানের মতো একজনকে দেখেছিলো অনেকেই। তারা ভেবেছিল হয়ত কোনো পাকিস্তানী বাহিনীর কাউকে হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দিতে এসেছিলেন চেয়ারম্যান সা’ব। আমার প্রতিবেদনে আমি সেটিও উল্লেখ করেছিলাম। হয়ত সে কারণেই প্রতিবেদনটি আলোর মুখ দেখেনি তখন।
আমার দীর্ঘক্ষণ নীরবতা দেখে দেবজ্যোতি বলে উঠলো, “দাদা, এই মিঃ চৌধুরীই নাকি বাবাকে পাকিস্তানী বাহিনীর অবস্থান রেকি করার জন্য নিয়ে গিয়েছিলেন।” আমি দেবজ্যোতিকে কী বলবো ভেবে পাচ্ছিলাম না।

ভিজিটিং কার্ডের এই মিঃ চৌধুরী স্বাধীনতার পরে ফুলেফেঁপে কলা গাছ হয়ে উঠেছিল। ইউনিয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান থেকে শিল্পপতি হতে বেশীদিন লাগে নি তখন। ১৯৭৫ সালের পরে যখন স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি দেশের ক্ষমতায় তখন মিঃ চৌধুরী আরও ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেছিলেন। এখন তো দেশের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তি। স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তির অন্যতম অর্থ দাতা। সা¤প্রদায়িক ও মৌলবাদী গোষ্ঠীর অন্যতম বুদ্ধিজীবি।
দেবজ্যোতি আমাকে প্রশ্ন করলো, “দাদা, মিঃ চৌধুরী কি আমাকে হেল্প করবেন বলে মনে করেন?”
দুই বছর বয়সে বাবাকে হারিয়েছে দেবজ্যোতি। তার বাবা যুদ্ধ করতে এসেছিল তার পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য। দেবজ্যোতির বাবার মতো অসংখ্য বীরের দায়িত্ব পালনের মাধ্যমেই আমরা পেয়েছি একটি স্বাধীন দেশ। দেবজ্যোতিও হয়ত তার বাবার আত্মত্যাগকে একটি মহান কর্ম হিসেবেই জেনে এসেছে এতোদিন। হয়ত জেনে এসেছে তার বাবার আত্মাহুতিকে বাংলাদেশ এখনো স্মরণ করছে। কিন্তু তার বাবার মতো আত্মদানকারীরা যে স্বাধীন বাংলাদেশের অনেকের কাছেই এখন শত্রুর আসনে বসেছে। তার বাবার নিখোঁজকান্ডের মদদদাতা যে এই মিঃ চৌধুরী -এ তথ্যটি জানলে শিশুকালে পিতৃহীন দেবজ্যোতির কষ্টের অবশেষ থাকবে না। আমি সেটি অনুমান করেই চুপ করে থাকলাম।

দেবজ্যোতি বললো, “আগামীকাল মিঃ চৌধুরীর এপোয়েন্টমেন্ট পেয়েছি। দেখি, যদি কোনো তথ্য পাই। মা মৃত্যুর আগে সেটি জানলে হয়ত একটু সান্ত¡না নিয়ে মরতে পারবেন”।
আমি জানালা দিয়ে বাইরের তাকিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, “গুড লাক এন্ড বেস্ট উইশেশ ফর ইউ এন্ড ইওর মাদার এজ ওয়েল। তোমার মায়ের জন্য আমার শুভকামনা”।

(ভজন সরকার : কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, কানাডা)