ফরিদ আহমেদ : গড্ডলিকা প্রবাহ বলে বাংলাতে একটা বাগধারা প্রচলিত আছে। এর অর্থ হচ্ছে অন্ধ অনুকরণ। গড্ডলিকা শব্দটা সংস্কৃত শব্দ। আসল শব্দটা গড্ডলিকাও নয়, সেটা হচ্ছে গড্ডরিকা। র বর্ণটা ল হয়ে গিয়ে সেটা গড্ডলিকা হয়ে গিয়েছে। গড্ডরিকা এসেছে গড্ডর শব্দ থেকে, যা এখন গড্ডল হয়ে গিয়েছে। গড্ডর বা গড্ডলের অর্থ হচ্ছে মেষ বা ভেড়া। এই গড্ডল আবার বাংলাতে এসে গাড়ল হয়ে গিয়েছে। গাড়ল শব্দটা বাংলাতে গালি হিসাবে ব্যবহৃত হয়। যদিও অনেকেই জানে না যে এর প্রকৃত অর্থ হচ্ছে ভেড়া। ভেড়ার মতো একটা নিরীহ প্রাণীকে গালি হিসাবে ব্যবহার করা হয় মূলত তার নির্বুদ্ধিতার কারণে।
ভেড়ার পাল যখন চলাচল করে তখন তারা নিজস্ব কোনো বুদ্ধি খাটায় না। এরা একজন আরেকজনকে অনুসরণ করে অন্ধের মতো। যে কারণে দল থেকে বিচ্যুত হতে সাধারণত দেখা যায় না কোনো ভেড়াকে। ভেড়ার খামারিদের জন্য ভেড়ার পাল একটা আশীর্বাদ। এগুলোকে দেখে রাখার জন্য বাড়তি কোনো পরিশ্রম করতে হয় না, অতিরিক্ত কোনো লোককেও নিয়োগ দিতে হয় না। অনেক খামারেতো বর্ডার কোলি নামের কুকুর দিয়েই ভেড়াদের শৃঙ্খলাবদ্ধ করে রাখা হয়। ভেড়ার এই বোধবুদ্ধিহীন, আনুগত্যময়, কৌতূহলশূন্য আচরণের কারণেই ভেড়ার পাল শব্দটার জন্ম হয়েছে বাংলায়। এটা একটা নেতিবাচক বিশেষণ। যারা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নিজস্ব বুদ্ধি প্রয়োগের বদলে অন্য কাউকে অনুকরণ করে, অন্যের উপরে নির্ভর করে, কিংবা অন্যের দেখানো পথে ধরে চলে, তাদেরকেই আমরা সাধারণত ভেড়ার পাল বলি।
ভেড়ার এই নির্বিরোধী ও নিস্তরঙ্গ আচরণ, নির্বিকার এবং নিরস মনোভাবের পিছনে মানুষের বেশ বড়সড় একটা দায় রয়েছে। ভেড়ার পালকে নিয়ে এখন আমরা যে হাসাহাসি করি, বা রসিকতায় মেতে উঠি, সেটার জন্য ভেড়াদের যতোটা না দায়, তার চেয়ে অনেক বেশি দায় হচ্ছে মানুষের। মানুষের অন্তহীন লোভের মূল্য চোকাচ্ছে ভেড়ারা এমন নির্বোধ হয়ে।
আদিম কালে প্রকৃতিতে ভেড়া যখন বুনো জন্তু হিসাবে ঘোরাফেরা করতো, তখন সব ভেড়াদের এমন অনুগত এবং অনুসরণকামী আচরণ ছিলো না। কেউ বেশ দুর্বিনীত ছিলো, কেউ ছিলো দুর্দান্ত কৌতূহলী, কেউ ছিলো রোম্যান্টিক, কেউ বা রোমাঞ্চপ্রিয়, কেউ ছিলো কল্পপ্রবন, কেউ বা কলহপ্রবন। কারো দল বেঁধে চলতে ভালো লাগতো, কেউ থাকতে চাইতো একা একা, নিরিবিলি। কেউ বা আবার সবার থেকে আলাদা হয়ে এদিক ওদিক গিয়ে প্রকৃতিকে ভালোভাবে বোঝার জন্য অধীর আগ্রহ দেখাতো। ভেড়াদের পোষা প্রাণী বানাতে গিয়ে তাদের আচরণের এই নানা বৈচিত্র্যময় সৌন্দর্যকে অত্যন্ত পরিকল্পিত উপায়ে পাকাপাকিভাবে পরিবর্তন করে ফেলে মানুষ।
নোয়াহ হারারি তাঁর “স্যাপিয়েন্স : এ ব্রিভ হিস্ট্রি অব হিউম্যানকাইন্ড বইতে এর একটা চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন। মানুষ যখন যাযাবর জীবন যাপন করতো, খাদ্যের জন্য শিকারের উপর নির্ভর করতো, তখন থেকেই ভেড়ার উপর পরিবর্তন নেমে আসা শুরু হয়। এর সূত্রপাত ঘটে নির্বাচিত শিকার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। শুরুর দিকে মানুষ যা তার শক্তি এবং সক্ষমতার আওতায়, তাই শিকার করতো। ধীরে ধীরে তারা বুঝে গেলো এভাবে শিকার করলে একটা পর্যায়ে গিয়ে শিকারের সংখ্যা কমে যাবে আশংকাজনকভাবে। ফলে, খাদ্যের অভাব দেখা দেবে। এ কারণেই নির্বাচিত শিকারের ধারণা মাথায় আসে মানুষের। মানুষ তার অভিজ্ঞতা দিয়ে ততদিনে জেনে গেছে, পূর্ণ বয়স্ক পুরুষ ভেড়া, দুর্বল স্বাস্থ্যের ভেড়া এবং অসুস্থ ভেড়াদের শিকার করাটাই তাদের জন্য বেশি সুবিধাজনক এবং লাভজনক। শিকারের এলাকায় দীর্ঘকাল ভেড়ার পাল যাতে টিকে থাকে, সে কারণে তারা মাদী ভেড়া এবং বাচ্চা ভেড়াদের শিকার করতো না, বরং এদেরকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করতো। শুধু তাই নয়, এদেরকে অন্য হিংস্র প্রাণী থেকেও তারা রক্ষা করার সর্বাত্মক চেষ্টা করতো। সিংহ, নেকড়ে, হায়েনাদের মতো শিকারি প্রাণী এবং অন্য দলের মানুষদের দূরে তাড়িয়ে দিতো তারা। বিস্তীর্ণ এলাকায় ভেড়াদের রক্ষা করা এবং নিয়ন্ত্রণ করা কষ্টকর বলে তারা এগুলোকে তাড়িয়ে সংকীর্ণ কোনো এলাকায় নিয়ে আসতো। তখন এই কাজগুলো করার তাদের পক্ষে খুব সহজ এবং সুবিধার হতো।
ভেড়ার পালকে নিয়ন্ত্রিত এলাকার মধ্যে এনেও মানুষ ক্ষান্ত দেয়নি। এই ভেড়াদের মধ্যে থেকেও যাচাই-বাছাই করা শুরু করে মানুষ। নিজেদের প্রয়োজনের জন্য সহায়ক যেগুলো, সেগুলোকেই শুধু টিকে থাকতে সহযোগিতা করে, বাকিদের বিনাশে মেতে ওঠে তারা। যে ভেড়াটা সবচেয়ে বেশি আক্রমণাত্মক, যেটা সবচেয়ে বেশি প্রতিরোধ দেখানোর চেষ্টা করে, যেটা শিং উঁচিয়ে গুঁতো দিতে চায়, সেটাকে সবার আগে জবাই করে দিতো তারা। যেটার গায়ে বেশি মাংস নেই, সেটাকেও দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হতো দ্রুত। এর পিছনে সময় ব্যয় করার কোনো মানে হয় না। আর যেটা বেশি কৌতূহলী, দল ছেড়ে এদিক ওদিক চলে যায় কৌতূহল নিবারণ করতে, তাকেও বলি হতে হতো সহসাই। এরকম কৌতূহলী ধরনে ভেড়া, ভেড়া পালকদের মোটেও পছন্দের কিছু নয়। এগুলোকে দলের মাঝে রাখতে অতিরিক্ত পরিশ্রম করা লাগে। শুধু তাই নয়, এদের দেখাদেখি অন্যগুলোও কৌতূহলী হয়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে। প্রতি প্রজন্মে এরকম নির্বাচিত বিনাশের মাধ্যমে সাহসী, শক্তিশালী, প্রতিরোধপ্রবন ও কৌতূহলী ভেড়াদের সরিয়ে দেওয়া হতে থাকে। থেকে যেতে থাকে বোকাসোকা ধরনের মাংসল ভেড়াগুলো। এরা প্রতি প্রজন্মে মাংসল থেকে আরও মাংসল হয়ে ওঠে মানুষের প্রয়োজনে। বুদ্ধিদীপ্ত ভেড়াগুলো চলে গিয়ে থেকে যেতে থাকে চিন্তাশূন্য নির্বোধগুলো। বাইরের জগত-সংসার সম্পর্কে এদের কোনো অযাচিত কৌতূহল থাকে না। একটা ভেড়া যেদিকে রওনা দেয় বা ভেড়া পালক যেদিকে যেতে বলে এই বোধলুপ্তগুলো গায়ের সাথে গা মিশিয়ে সেইদিকেই রওনা দেয়।
মানুষ শুধু ভেড়ার পালের উপরেই এই কাজটা করে ক্ষান্ত থাকেনি। কিছু মানুষ সাধারণ মানুষদের উপর দিয়েও একই ধরনের কাজ করেছে। এটা ঘটেছে কৃষি সভ্যতার যুগে। মানব সভ্যতার এই পর্যায়ে এসে মানুষের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য দেখা দেয়। কিছু মানুষ হঠাৎ করেই অন্যদের চেয়ে ধনী হয়ে পড়ে। দিনে দিনে এই বৈষম্য বাড়তেই থাকে। ধনী ব্যক্তিদের মধ্যে এদের মধ্যে কেউ কেউ শহরের শাসক হিসাবে নিজদের স্থান করে নেয়। কেউ কেউ আরও বড় এবং বিস্তীর্ণ এলাকার শাসক বনে যায়। রাজা, সম্রাট, এই সব নানা উপাধির জন্ম হতে থাকে। এই সব শাসকদের জন্য টিকে থাকার অন্যতম একটা শর্ত ছিলো প্রজাদের আনুগত্য। সভ্য সমাজের নিয়ম কানুন তখনও প্রচলিত না থাকাতে রাজা হলেও শান্তি ছিলো না। পার্শ্ববর্তী কোনো শক্তিশালী রাজা যুদ্ধের মাধ্যমে তাকে উচ্ছেদ করে ফেলতে পারে। ফলে, তার নিজেরও নিজস্ব সেনাবাহিনীর দরকার ছিলো। সেনাদের শুধু বেতন দিলেই তারা আন্তরিকভাবে যুদ্ধ করে না, এর জন্য প্রয়োজন হয় রাজার প্রতি ভালবাসা এবং অন্ধ আনুগত্য। ফলে, রাজারা তাদের নিজেদের প্রয়োজনেই বিরুদ্ধবাদীদের দমন করে ফেলতো। বিরুদ্ধ কণ্ঠস্বরকে থামিয়ে দেওয়া হতো, বিরুদ্ধ দর্শনকে উচ্ছেদ করা হতো অতি নিষ্ঠুরতার সাথে। রাজাদের টিকে থাকতে গেলে এটা করা ছাড়া বিকল্প কিছু ছিলো না। মানব সভ্যতায় রাজাদের প্রথম আবির্ভাব ঘটেছে সুমেরিয় সভ্যতায়। সেটা পাঁচ হাজার বছর আগে। এর প্রায় সমসাময়িক সময়ে মিশরেও রাজতন্ত্র চালু হয়। এরপর এই রাজতন্ত্র ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে। বিশ্বের প্রতিটা অঞ্চলে প্রতিটা রাজবংশই তাদের জন্য অনুগত এক প্রজা-শ্রেণী তৈরি করেছে নানা উপায়ে।
প্রাচীন চীনের কথাই ধরা যাক। এখানকার প্রথম রাজবংশ হচ্ছে কিন রাজবংশ। কিন রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সম্রাট কিন শি হুয়াং। খ্রিস্টপূর্ব ২২২ সালে তিনি বিবদমান খণ্ড খণ্ড চীনা রাজ্যগুলোকে একত্রিত করেন। এই কাজটা তিনি করেছিলেন চতুর ক‚টনৈতিক বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে। চীনের সব রাজ্যগুলোকে একত্রিত করেই তিনি কেন্দ্রীয় আমলাতন্ত্র চালু করেন, আদর্শ লিখন পদ্ধতির প্রচলন ঘটান, রাস্তাঘাট তৈরি করার মাধ্যমে সারাদেশ জুড়ে যোগাযোগ ব্যবস্থাকে সচল করেন। আজকের যে গ্রেট ওয়াল, সেটার প্রথম অংশের সূচনাও হয় সম্রাট কিন এর সময়ে। বিভিন্ন রাজ্যগুলোর মধ্যে সাংস্কৃতিক সংযোজনা ঘটাতে গিয়ে জোর জুলুমেরও আশ্রয় নেওয়া হয়েছিলো।
জ্যারেড ডায়মন্ড তাঁর “গানস, জার্মস এন্ড স্টীল’ বইতে একটা অধ্যায়ই বরাদ্দ করেছেন এ নিয়ে। সেই অধ্যায়টার শিরোনাম হচ্ছে ‘হাউ চায়না বিকেম চাইনিজ’। সেখানে তিনি লিখেছেন, “চীনকে এখন রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং ভাষাগতভাবে একক রূপ বলে মনে হয়। অন্তত সাধারণ মানুষের কাছে এমনটাই মনে হবে।। চীন ২২১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রাজনৈতিকভাবে একীভ‚ত হয়েছিল। এবং তারপর থেকে বেশিরভাগ শতাব্দী ধরে তাই রয়ে গিয়েছে। চীনে সাক্ষরতার সূচনা থেকে, এখানে শুধুমাত্র একটি একক লিখন ব্যবস্থা ছিল, যেখানে আধুনিক ইউরোপ কয়েক ডজন পরিবর্তিত বর্ণমালা ব্যবহার করে। চীনের এক দশমিক দুই বিলিয়ন জনসংখ্যার মধ্যে ৮০০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ ম্যান্ডারিন ভাষায় কথা বলে। এই ভাষাটি বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষের ভাষা।” প্রথম কিন সম্রাট আগের সব ইতিহাস বইগুলোকে মূল্যহীন বলে বাতিল করে দেন। সেগুলোকে পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ দেন তিনি। এই পোড়ানোর সাথে চীনের অতীত সব মুছে যায়। নতুন এক চীনের যাত্রা শুরু হয়, যেখানে সাংস্কৃতিক এবং ভাষিক জায়গাতে মানুষের মধ্যে পার্থক্য আর থাকে না। অনেকটাই রূপ নেয় ভেড়ার পালে।
আমাদের দেশের রাজনীতি, সমাজনীতি, সব জায়গাতেই এখন এই ভেড়ার পালের যুগ চলছে। দিনের পর দিন ধরে বুদ্ধিমান, সাহসী এবং শক্তিধর মানুষগুলোকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়েছে। সত্য কথন বলা সুমিষ্টভাষীদের ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে অশান্ত সাগরে। যারা প্রতিরোধ করতে পারতো, তাদের উপর প্রতি আক্রমণ এসেছে সবার আগে। যারা লড়তে পারতো, তাদের রক্তে লাল করে দেওয়া হয়েছে সবুজ মানচিত্র।
বাকি যারা আছে তারা ওই ভেড়ার পালই। রাজা যায় রানি আসে, ভেড়ার পাল থেকে যায় একই রকম। বারুদ নিভে যাওয়া বুলেটের মতো বাতিল এবং পরিত্যক্ত।