বিদ্যুৎ সরকার : ঢোল কলমী গাছ যেমন আঁকড়ে ধরে রাখে মৃত্তিকাকে, আমিও আমার স্মৃতিকে বেধে রাখবো। অবিরাম বৃষ্টি, হঠাৎ বানে এতটুকু মাটি ক্ষয়ে যাবে না শেকড়ের অটুট বাধন থেকে। স্মৃতিও মুছে যাবে না বিস্মৃতির টানাপোড়েনে। আমার স্মৃতি আমার শৈশব। বাতাসে দোল খাওয়া ঢোল কলমীর বেগুনী ফুল যেন মৃত্তিকার অমলিন কালিতে লিখা প্রথম প্রেমপত্র। বাড়ির পাশের খালের পাড়ের অযতনে বেড়ে ওঠা ঢোল কলমীর শাখা-প্রশাখাসমূহ নন্দলালের জলরং চিত্রকলার বিষয়বস্তু হয়ে পড়ে আমার স্মৃতিতে। স্মৃতি কেন এত বাস্তব হয়ে যায় সতেজ হয়ে ভেসে বেড়ায় আমার চোখের জলজ আয়নায়। আমার শৈশব কেন আটকে থাকতে চায় একটি সময়ের মাঝে। শৈশব কি কোনদিনও বেড়ে উঠবে না, বয়োঃবৃদ্ধ হবে না কোন কালেও। আমি কি আমার শৈশবের ‘টাইম মেশিন’এ আটকে থাকবো চিরকাল। বুনোফুল দিয়ে বানানো লাটিম যেমন ফলার উপর স্থির হয়ে ঘুরতে থাকতো অনবরত, আমার শৈশবও তেমনি স্থির হয়ে ঘুরে ঘুরে আসছে একই বিন্দুতে- সে আমার সুখ, আমার চিরদিনের অন্তহীন ভালোবাসা।
আমার কেন চলে আসা সবকিছু দূরে ঠেলে দিয়ে। আমার ভাললাগা পৌষের দূরন্ত দুপুর। ভোঁকাট্টা ঘুড়ির লাটাইয়ের দুঃখ-কষ্ট আমাকেও কষ্ট দিতো- তাও ভালো ছিল। শরতের দোল খাওয়া সফেদ কাঁশবন, হঠাৎ বৃষ্টি এলে কেমন চুপসে যেতো- তাও ভালো ছিল। শীতের সকালে ঘাসের ডগায় কুয়াশার স্ফটিক পায়ের তলায় মিলিয়ে যেতো- তাও ভালো ছিল। দিনের শেষে ঝরা শেফালি মিষ্টি সুবাস কোথায় হারিয়ে যেতো- তাও ভালো ছিল। উঠোনে ছড়িয়ে দেয়া সদ্য সিদ্ধ ধানের সোঁদা গন্ধে আমার শৈশবকে খুঁজে পেতাম যখন-তখন। মারবেলের চকচকে উজ্জ্বোল্যে ‘তিতাস’ একটি নদীর নাম মনে পড়ে যেত কত সহজেই। সাইকেলের প্যাডেলে লেগে থাকা বর্ষার কাদায় ঝুলে থাকতো শৈশবের স্কুল পালানো দিনগুলো। আমি আমার গ্রামের শ্যামল ছায়ায় ফিরে যেতে চাই। আমি ফিরে যেতে চাই আমার ভালো লাগার ট্রাফিক জ্যামে। যেখানে দুঃখের সাথে সুখও আছে, দারিদ্রের সাথেও জড়িয়ে থাকে একাত্তরের গৌরব গাঁথা। যেখানে কষ্ট কষ্ট সুখ, সুখময় কওে তোলে জীবন।
বিদ্যুৎ সরকার : লেখক, আলোকচিত্রী, টরন্টো, কানাডা