সাজ্জাদ আলী : কিবরিয়ার গাড়িতে চড়ে কোর্টে যাচ্ছি। হাজিরার প্রথম দিন আজ। মামলার আসামি সে, সাক্ষী আমি। গাড়িটা সেই চালাচ্ছে। আমি বসেছি সামনের প্যাসেঞ্জার সিটে। কিবরিয়া আতর মেখেছে। ঝাঁঝালো গন্ধে গাড়িতে বসা দায়। বাইরে আজ কনকনে ঠান্ডা, মাইনাস ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তো হবেই। তারপরও জানালার কাচ খানিকটা নামিয়ে আতরের গন্ধমুক্ত হওয়ার চেষ্টা করলাম। জিজ্ঞেস করলাম, কিবরিয়া, আতর জোগাড় করলে কীভাবে? ও সব কানাডায় পাওয়া যায় নাকি?
কী যে কন মামা? কয় শিশি লাগবি আপনার? এক্কেবারে খাঁটি সৌদি আতর!
না না, আমার লাগবে না। এমনিই জিজ্ঞাসা করলাম।
মামা, এই ব্রান্ডের আতর যে ফ্যাক্টরিতে তৈরি হয়, সেটার মালিকরা খোদ কুরাইশ বংশের। নবিজির বংশধর ওরা, এ কথা বলে কিবরিয়া দাড়িতে আঙুল বোলাতে লাগলো।
কিবরিয়া আমার এক বান্ধবীর ভাগনে। সেই পরম্পরায় মামা ডাক শুনতে পাই। বছর সাতেক আগে বউ নিয়ে কানাডার টরন্টোতে এসেছে। ছেলেটি রাজশাহী ইউনিভার্সিটি থেকে অ্যাপ্লায়েড ফিজিক্সে মাস্টার্স করেছে। বউ পড়ত ক্লাশ টেনে। বিয়ের পরপরই বিদেশে উড়াল দিয়েছে। ফুটফুটে ওই মেয়েটির তখন বিয়ের লিগ্যাল বয়স হয়েছিল কি না, আমার ঘোরতর সন্দেহ আছে। বান্ধবীর তদবিরে এয়ারপোর্ট থেকে ওদের সোজা আমার বাসায় নিয়ে এলাম। দিন দশেক আমাদের সাথে থেকেছিল। সেই থেকে চেনাজানা। ওরা দুজনেই মামা মামা করে, এক ধরনের মায়া পড়ে গেছে।
যখন কানাডায় এলো, কিবরিয়াটা তখন এক আধুনিক যুবক। জিন্স, টি-শার্ট পরে। পাবলিক লাইব্রেরিতে গিয়ে সায়েন্স জার্নালগুলো খুঁজে বের করে। বউ নিয়ে থিয়েটার দেখতে যায়। টিভিতে আইস হকি খেলা দেখে। গোল হলে হৈহৈ করে চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করে! ওর পরিবর্তন এসেছে বছর দুয়েক হলো। নামাজে মন বসেছে। পোষাকেও এসেছে পরিবর্তন। এখন খাটো পাজামা এবং লম্বা পাঞ্জাবি পরনে তার। গোঁফ কামিয়ে লম্বা দাড়ি রেখেছে। সেই দাড়িতে আতর মাখে। বউটাকে এখন বোরখা পরতে হয়। যেনতেন বোরকা না! একেবারে আপাদমস্তক ঢাকা। শুধু চোখ বরাবর দুটো ফুটো। ছোট্ট সেই ফুটো দিয়ে মেয়েটি আর পৃথিবীর শোভা দেখতে পায় না।
গেল গ্রীষ্মে টরন্টোর ওয়াটার ফ্রন্ট পার্কে কিবরিয়ার বন্ধুরা একটা গেট টুগেদার করেছিল। কয়েকটা পরিবার মিলে সারাটা দিন সেখানে ওরা গল্পগুজব করে কাটালো। যার যার বাড়ি থেকে সবাই বাটি ভরে নানা পদের তরকারি রান্না করে এনেছে। পার্কে বসে একসাথে খাবে। এ ধরনের আয়োজনকে কানাডিয়ানরা ‘পটলাক পার্টি’ বলে। তিন সপ্তাহ আগে থেকে রিয়া, মানে কিবরিয়ার বউটা আমাকে ওই পার্টিতে যাওয়ার জন্য নেমন্তন্ন করা শুরু করলো, মামা আপনার আসাই লাগবি, আসাই লাগবি!
একেবারে ছোট বাচ্চাদের মতো করে ঝুমুর কাটে, আপনি একটার সময় আসলিই হবি। চাইট্টা খাইয়াই আবার চইলা যাবেন মামা, আপনারে আটকাবো নানে।
একেবারে নাছোড়বান্দা, রাজি না হওয়া পর্যন্ত মেয়েটা ফোন ছাড়ে না। তো সেই পার্টিতেই বিপত্তিটা ঘটে। পার্কের মাঠে বাচ্চারা বল খেলছিলো। সাথে তাদের মা বাবারাও যোগ দিলো। অন্য বৌদের তুলনায় রিয়া নবীনা। মুক্ত মাঠের বল খেলার আনন্দ তাকে চপলা করে তুললো। কিন্তু তার আনন্দ তো বোরকায় ঢাকা। হঠাৎ কী মনে করে মেয়েটি বোরকা খুলে বাচ্চাদের সাথে খেলতে শুরু করলো। আর যায় কোথা! কিবরিয়া দৌড়ে এসে বৌয়ের গালে চড় কষিয়ে দিলো। রিয়াকে টেনে হিঁচড়ে পার্কের শেডের নিচে নিয়ে গেল। তারপর নিজের হাতে আবার বোরকায় ঢেকে দিলো। রিয়ার অপমান, লজ্জা, চোখের জল, সব সেই বোরকায় ঢাকা পড়ে গেল।
তবে আমরা ওর চোখের জল দেখতে না পেলেও পার্কে দায়িত্বরত পুলিশ ঠিকই দেখে ফেললো। মুহূর্তে তিনজন পুলিশ এসে কিবরিয়াকে ঘিরে ফেললো। হাতে হাত কড়া পরিয়ে ওদের গাড়িতে নিয়ে তুললো। আমাদের কৌশিক এগিয়ে গেল। পুলিশকে বলার চেষ্টা করলো যে কেউ তো কোনো অভিযোগ করেনি। তবে আপনারা ওকে নিয়ে যাচ্ছেন কেন?
নারী অফিসারটি বললো, ক্রাইমটা তো আমরা নিজের চোখে দেখেছি। কারো নালিশ করার তো দরকার পড়ছে না।
রিয়া কাঁদতে কাঁদতে বলে, মামা, ওরে পুলিশের কাছ থেইকা ছাড়াইয়া আনেন। আমি তো ব্যথা পাই নাই!
আহারে, আমাদের অভাগিনিরা! কী আর বলি? তোদের চামড়া এতই পুরু যে, তীব্র ব্যথাও তা ভেদ করতে পারে না। অগত্যা আমি এগিয়ে গিয়ে ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে বললাম, অফিসার ওকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? আর ওর পরিবারের পরবর্তী করণীয়ই বা কী?
ওনাকে কাল কোর্টে হাজির করবো। আপনারা চাইলে জামিনের আবেদন করতে পারেন, এটুকু বলে পুলিশরা চলে গেল। যাবার আগে রিয়া আর আমার ফোন নম্বর আর আইডির (ড্রাইভার্স লাইসেন্স) ফটো তুলে নিয়ে গেল।
তো সেই জামিন পাওয়ার ৫ মাস পরে আজই মামলার প্রথম শুনানি হবে। আতরের গন্ধ শুকতে শুকতে কোর্টের দিকে চলেছি। যেতে যেতে কিবরিয়া ধর্মকথা শুরু করলো। জুম্মার নামাজ অবহেলা করলে কী শাস্তি হয়, ওয়াক্তিয় নামাজ মসজিদে গিয়ে পড়ার ফজিলত কী ইত্যাদি বলছিলো সে।
আমি ওর বয়ানে যারপরনাই বিরক্ত। বললাম, আচ্ছা কিবরিয়া, ধর্মমতে বউ পেটানোর শাস্তি কী ব্যাটা?
আমার প্রশ্নের মর্মার্থ বুঝতে পেরে সে চট করে বললো, বেশরম স্ত্রীকে পর্দা করতে বাধ্য করার আদেশ আছে মামা। এ জন্য কোনো শাস্তি নাই, বরং পুরস্কার আছে। এই দ্যাশের ইহুদি নাসারারা আমারে শাস্তি দিলিও আখেরাতে আমি পুরস্কার পাবো।
ছোট্ট করে বললাম, এ সব কথা যেন আবার কোর্টে দাঁড়িয়ে বোলো না।
প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে কিবরিয়া জিজ্ঞাসা করলো, মামা, আমি সেদিন রিয়ারে চড়াইছিলাম, এ কথা কোর্টে প্রমাণ হলি তো আমার জেল হইয়া যাবি। তাই না?
তা হতে পারে। আবার আইনের খাতায় এটা তোমার প্রথম অপরাধ এবং কোর্টে এসে রিয়া তোমার শাস্তিও দাবি করছে না। তুমি যদি অপরাধ স্বীকার করে ক্ষমা চাও, তবে জজ সাহেবের দয়া হতেও পারে।
আমার উকিলও তাই কইছে মামা। আইচ্চা, আপনি তো মোসোলমানের ছাওয়াল, কনতো এই বিধর্মীগো দ্যাশে কেমনে ঈমান নিয়া চলি? ঘরের বউডারেও আদব শিক্ষা দিবার উপায় নাই! এই দ্যাশে আর থাকা যাবি না। তয় মামা, আইজ কিন্তু আপনি আমারে বাঁচাইয়া নেবেন।
কেন, তোমাকে বাঁচাবো কেন? এ রকম একটা মামলা চলা অবস্থায়ও তুমি মাসখানেক আগে রিয়ার গায়ে আবার হাত তুলেছো। মনে করেছো, আমি কোনো খবর রাখি না? অভদ্র, অসভ্য কোথাকার, বলে আমি জানালার দিকে তাকিয়ে রাস্তার গাড়ি গুনতে থাকলাম।
রাস্তার পাশে গাড়ি দাঁড় করিয়ে আমার হাত ধরে কাকুতি-মিনতী শুরু করলো কিবরিয়া। বলে, মামা, আমি জেলে গেলে রিয়ারে কিডা দ্যাখবো? সে তো কাইল রাইতে ফোনে আপনারে যা কবার কইছেই!
রিয়াকে আল্লাহপাক দেখবেন, বললাম আমি। শোনো কিবরিয়া, জানি না কোর্ট আমাকে কেন তলব করেছে। তবে তোমাকে ফাঁসানোর বা বাঁচানোর জন্য আমি কোর্টে যাচ্ছি না। তুমি যে রিয়াকে মারধর করেছো, তার প্রত্যক্ষদর্শী তো স্বয়ং টরন্টো পুলিশ। আমার সাক্ষী এ মামলায় জরুরি কিছু বলে মনে হচ্ছে না।
আর কোনো কথা বললো না কিবরিয়া। একমনে গাড়ি চালাচ্ছে। কোর্ট চত্তরের পার্কিং লটে ঢুকে সোজা সে শারীরিকভাবে অক্ষমদের জন্য নির্ধারিত পার্কিং স্পটে গাড়ি পার্ক করলো।
পাঠক বন্ধুরা জানেন, তবুও বলি। সভ্য দেশগুলোর অফিস, আদালত, শপিং প্লাজার পার্কিং লটে শারীরিকভাবে অক্ষম ব্যক্তিদের জন্য সংরক্ষিত কয়েকটি পার্কিং স্পট থাকে। এসব স্পট অফিস বা প্লাজার সদর দরজার খুব কাছাকাছি হয়। যাতে অক্ষমদের বেশি দূর হাঁটতে না হয়। সুস্থ সবল মানুষেরা কখনোই ওখানে গাড়ি পার্ক করে না। ডাক্তারের পরামর্শে সরকার ওই সব পার্কিং স্পটে গাড়ি পার্ক করার জন্য বিশেষ ধরনের পারমিট ইস্যু করে।
এ সব পার্কিং স্পটে খুব বড় করে হুইল চেয়ার আঁকা থাকে। আবার স্পষ্টভাবে ‘ডিজেবল পার্কিং’ লেখা সাইবোর্ডও থাকে। কারোরই চোখ এড়াবার উপায় নেই। তবুও আমি ভাবলাম, কিবরিয়া হয়তো সাইনগুলো খেয়াল করেনি। বললাম, এটা তোমার স্পট না, এখানে তুমি গাড়ি পার্ক করতে পারো না। ওই যে দূরে স্পট ফাঁকা আছে। ওখানে গিয়ে পার্ক করো।
বিরত্ব মাখানো হাসি খেলে গেল কিবরিয়ার ঠোঁটে। গাড়ির ড্রয়ার থেকে একখানা ডিজেবল পারমিট বের করে সে ড্যাশবোর্ড রাখলো। তারপর বললো, চলেন মামা যাই, ১০টা বাইজা গ্যাছে।
বললাম, দাঁড়াও দাঁড়াও, তুমি তো সুস্থ সবল মানুষ, তো এই পারমিট পেলে কোথায়?
আবার সেই হাসিটি দেখলাম কিবরিয়ার ঠোঁটে। বললো, মামা, কয়মাস আগে আমার পা ভাঙছিল না, সেই সময় ডাক্তার আমারে এই পারমিটখান দিছিল। তয় আমি আর তা ফেরত দেই নাই। ভারি সুবিধা হয় মামা। এই যে দেখেন দরজার কাছেই গাড়ি পার্ক করা গেল। আমাগে হাঁটা লাগলো না।
আমি হাঁ করে চেয়ে রইলাম ওই আল্লার বান্দার দিকে! এ ছেলে বলে কী? এই বয়সেই ওর ভেতরটা এতখানি পচে গেল কীভাবে? এমন ধর্মকর্ম করা মানুষ এতটা অপরাধপ্রবণ ও অনৈতিক হয় কী করে? আল্লা-বিল্লা করে ও তবে কী শিখলো?
আমি ধমক দিয়ে বললাম, কিবরিয়া, এখান থেকে গাড়ি বের করো। ওই দূরে নিয়ে পার্ক করো। তার আগে এই গাড়ি থেকে আমি নামছি না।
(লেখক বাংলা টেলিভিশন কানাডার নির্বাহী)