হাসান জাহিদ : কথাশিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিৎসু ক্যানভাস।
জাদুবাস্তবীয় এই আমি
“All that spirits desire, spirits attain.” কাহলিল জিবরানের ‘দি প্রফেট’-এর এই ছোট্ট বাণীটুকু আমার ভালো লাগে। আর আমার ক্ষেত্রে এই বাণীর অনেকখানিই মিলে গেছে বিভিন্ন পর্যায়ে।
কিন্তু জানি না, কবে আমার আত্মার পরিতৃপ্তি হবে। বিশাল অতৃপ্তি নিয়েই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাব। সবাই তাই যায়। তবু কথাটা বললাম এজন্য যে, ফ্রয়েড বেঁচে থাকলে তাকে জিজ্ঞেস করতাম আমার চেতন, অবচেতন ও অচেতন মনের কাজকারবার সম্পর্কে।
আমার যাবতীয় অতৃপ্তি আমার লেখালেখিকে ঘিরে। একটা সময় ছিল, যখন নিজকে মেলে ধরতে চাইতাম কিন্তু পারিনি, আমার একটা অন্যরকম আমিত্বের জন্য। কারুর ওপর দোষ চাপিয়ে ধোয়া তুলসিপাতা হতে চাই না। কেননা, সব ব্যর্থতা আমারই।
আর এখন সেসব ভুল-ব্যর্থতার মাশুল গুনছি। অনেকটা দূরে সরে গেছি সংবেদনশীল একটা মন নিয়ে। অবহেলাময় ফেলে আসা দিনগুলির কথা মনে হলে মাইকেল মধূসূদনের একটি চরণই মনে আসে:
‘কেলিনু শৈবালে; ভুলি কমল-কানন!’
অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যেও মনটা চাঙা রাখার চেষ্টা করছি। বয়স তো কম হলো না। জীবনটাকে টেনে চলছি তো চলছিই; এর যেন শেষ নেই। মহাশূন্যের মতো অসীম। এই অসীমতাকে ভেদ করে সসীম হতে আর চাই না। আমি জানি, আমার ভেতরে লুকিয়ে থাকা অতিমানবীয় ইচ্ছেগুলোর বাস্তবায়ন ইহজীবনে সম্ভব নয়। জীবনানন্দের মতো ‘আবার আসিব ফিরে’ যদি কোনো দৈববলে সম্ভব হয়, তাহলে হয়তো বা তা সম্ভব।
মাতৃভ‚মিতে অবস্থান করে বিরহের গীত গাইব। অনেক অতৃপ্তি নিয়েই পৃথিবী থেকে চলে যেতে হবে আমাকে। তবে আক্ষেপ, ফেলে আসা সময়টাকে কাজে লাগাইনি। এই ব্যর্থতার দায় শতভাগ আমার। তাই সময়ের কাছে করজোরে ক্ষমা চাইছি। সুন্দর সময়, কুৎসিত সময়, অলস সময় বা ব্যস্ত সময়-সবরকমের সময়ের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী আমি।
আমার সৌভাগ্য হয়েছে ‘ওয়ান হানড্রেড ইয়ার্স অব সলিচ্যুড’, ‘নো ওয়ান রাইটস টু কর্নেল,’ ‘ইনোসেন্ট এরেন্দিরা অ্যান্ড আদার স্টোরিজ’ বইগুলো পড়ার। এগুলো আমি পড়েছিলাম আশির দশকের শেষার্ধে। সেই দশকের গোড়া থেকেই জাদুবাস্তবতার ওপর আলোচনা, জাদুবাস্তবতা পাঠ, গবেষণা, এমনকি লেখালেখি বিস্তার লাভ করে। এইসব কর্মকান্ডের অংশীদার আমিও ছিলাম। তখন লিটল ম্যাগাজিনে ও পত্রিকার সাহিত্য পাতায় দুয়েকটি গল্প প্রকাশ করেছিলাম জাদুবাস্তবতার অবয়বে। গল্পগুলো হয়তো জাদুবাস্তবীয় পরিপক্কতা পায়নি; কিন্তু সেসব ছিল যুগমানসের প্রতিফলন। পরবর্তীতে জাদুবাস্তবের ওপর কিছু পড়াশোনা ও লেখালেখি করেছিলাম। ফলশ্রুতিতে পরবর্তীতে টরোন্টোতে অবস্থান করে ২০১৪ সালের একুশে বইমেলায় ‘জাদুবাস্তবের পদাবলি’ নামে গল্পগ্রন্থ প্রকাশ করেছি।”
আমার দুয়েকটি গল্প পড়ে আমার দুয়েকজন গল্পকার বন্ধু প্রীত হয়ে বলেছিল, দুয়েকটি গল্প জাদুবাস্তবীয় আদল পেয়েছে। কিন্তু কোনো লেখায় বা আড্ডায় আমার নামটি উঠে আসে না জাদুবাস্তবীয় লেখার অংশীদার হিসেবে।
মার্কেস লিখেছিলেন ‘ওয়ান হানড্রেড ইয়ার্স অব সলিচ্যুড’ বা একশত বছরের নির্জনতায়। আর আমি বন্দি হয়ে আছি সহস্র বছরের নির্জনতায়। আমি একাকী-নিঃসঙ্গ এজন্য যে, আজকাল সখ্যতা করার বা মনের কথা বলার মানুষের বড্ডো আকাল। প্রবাসে পড়াশোনা করে এমন এক ছাত্রীর থিসিস করে দিচ্ছি। মানুষের উপকারে এসে পাপের বোঝা কিছুটা লাঘব করতে চাই।
তখন এবং মাঝখানে এবং এখনও মানুষের উপকার করে যাচ্ছি আমি, কিন্তু একাকীত্বের এই আমি একাই থেকে গেলাম। জীবনে অনেকের জন্য অনেককিছু করেছি। অনেককে লেখক বানিয়েছি। একথা বলছি এই কারণে যে, একটা সময় আমি গল্প-প্রবন্ধ লেখার পাশাপাশি লেখার ট্রেন্ড বা গতিপ্রকৃতি (যেমন জাদুবাস্তবতা) নিয়ে কিছু কাজ করেছিলাম। তাই আমার সেই সময়কার ক্ষুদ্র প্রয়াস সম্পর্কে সামান্য বর্ণনা দিয়েছি ‘জাদুবাস্তবের জাদুকর’-গার্সিয়া মার্কেসের ওপর একটা লেখা প্রকাশ করে। লেখাটা সম্ভবত টরোন্টোর একটা ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছিল।
একটা সময় যখন সক্রিয় ছিলাম, যোগাযোগ ছিল পত্রিকা ও লেখকদের সাথে, তখন কোনো পত্রিকা বা লেখক আমার সম্পর্কে বলতে কার্পণ্য করতেন না। কিন্তু আজকের চিত্র ভিন্ন। দেশ-সমাজ-রাজনীতি, এমনকি লেখালেখিও দখল হয়ে গেছে তেলমর্দন, সম্পদ ও চাটুকারিতার ওপর। তাই আমার ব্যর্থতাকে এখন আর ব্যর্থতা মনে করি না। এটাকে একধরনের নিয়তি রূপেই গ্রহণ করেছি।
আজ এতটুকুই। পরবর্তী এপিসোডে আরও কিছু বলব।