অনলাইন ডেস্ক : কভিড-১৯ ঝড়ে বিপর্যস্ত সারা বিশ্বের শ্রমবাজার। উৎপাদন, নির্মাণ কিংবা সেবা—সব খাতের পরিস্থিতিই নাজুক। কাজকর্ম ফেলে নিজ আবাসেই কোয়ারেন্টিনে আছেন লাখ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশী। বেকার হয়ে দেশে ফেরার অপেক্ষায় আছেন এমন সংখ্যাও কম নয়। প্রধান শ্রমবাজারগুলোর পরিস্থিতি যখন সবচেয়ে নাজুক, তখনই দেশে এসেছে ইতিহাসের সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স। এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে একি রেমিট্যান্সের উল্লম্ফন, নাকি কেবলই প্রবাসীদের ঘরে ফেরার আয়োজন।

সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, মালয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ওমান, কাতার, ইতালি, বাহরাইন, সিঙ্গাপুরসহ দেশের প্রধান শ্রমবাজারের দেশগুলোতে বসবাসকারী বাংলাদেশীদের সঙ্গে কথা বলেছে বণিক বার্তা। এর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে অবস্থানকারী বাংলাদেশীরা বলেছেন, পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, তাতে চাকরি কিংবা ব্যবসা থাকবে বলে মনে হচ্ছে না। ব্যয় সংকোচনের অংশ হিসেবে বিদেশী শ্রমিকদের দেশে ফেরত পাঠানো হতে পারে। এজন্য দীর্ঘদিনের সঞ্চয় ও ব্যবসার পুঁজি দেশে পাঠানোর চেষ্টা করছেন তারা। আর আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলোয় বসবাসকারীরা বলছেন, দেশে থাকা স্বজনদের আয় নেই। এজন্য তারা ধার করে হলেও দেশে টাকা পাঠানোর চেষ্টা করেছেন।

দেশে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আসে সৌদি আরব থেকে। গত মে মাসে দেশটি থেকে রেমিট্যান্স এসেছে রেকর্ড ৩৮০ মিলিয়ন ডলার। জুনে এসে সে রেকর্ডও ছাড়িয়ে যায়। গত মাসে দেশটি থেকে রেমিট্যান্স এসেছে ৪৫০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি। যদিও গত মার্চ থেকে সৌদি আরবে ছিল টানা দুই মাসের লকডাউন। এ সময়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ছাড়া সব শ্রেণীর দোকানপাট ছিল বন্ধ। যানবাহন ও যাতায়াতে আরোপ করা হয়েছিল কঠোর নিষেধাজ্ঞা। এ অবস্থায় ঘরে বসে থাকা প্রবাসীরা হঠাৎ করে কোথা থেকে এত অর্থ দেশে পাঠাচ্ছেন? তার জবাবে দেশটির জেদ্দায় বসবাসকারী বাংলাদেশী মাহবুবুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, এখানে একটি ইলেকট্রিক পণ্যের দোকান আছে আমার। মার্চের মাঝামাঝি থেকে মধ্য জুন পর্যন্ত টানা দোকান বন্ধ ছিল। মাঝেমধ্যে সীমিত পরিসরে খুললেও তাতে দৈনন্দিন খরচ উঠে আসেনি। সরকার জুনের মাঝামাঝি স্বাভাবিক পরিস্থিতি ঘোষণা করেছে। দোকানপাট খুলেছে। হাতে যা সঞ্চয় ছিল তার সঙ্গে গত দুই সপ্তাহে বিক্রি হওয়া পণ্যের সব অর্থ দেশে পাঠিয়ে দিয়েছি। এ দেশে কতদিন থাকতে পারব তা জানা নেই। পরিস্থিতি যা, তাতে সহসা দেশে ফিরতে হতে পারে।

মাহবুবুর রহমানের গল্পই সৌদি আরবে বসবাসকারী সিংহভাগ বাংলাদেশীর পরিস্থিতি। সৌদি আরবের দাম্মাম শহরে একজন প্রতিষ্ঠিত সুপারশপ ব্যবসায়ী শফিউল বাশার মুকুল পাটওয়ারী। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে সেখানে ব্যবসা করেন তিনি। ব্যবসার সুবাদে পরিবারের সবাইকে নিয়ে যান সেখানে। বেশ ভালোই ছিলেন। কিন্তু ২০১৭ সালে সৌদি সরকারের পরিবর্তিত আইনকানুন তার ব্যবসায় ব্যাপক প্রভাব ফেলে। প্রবাসী ব্যবসায়ীদের ট্যাক্স, লিভিং কস্ট ও শ্রমিক খরচ বেড়ে যাওয়ায় এক পর্যায়ে নিজের ব্যবসা ছোট করে ফেলেছেন তিনি। দেশে চলে আসবেন বলে একে একে পরিবারের সবাইকে দেশে পাঠিয়ে দেন এ প্রবাসী। বর্তমানে সামান্য বিনিয়োগ করে কোনো রকম ব্যবসা আছে সেখানে। বাকি ব্যবসার অর্থ দেশে পাঠিয়ে দিয়েছেন। সর্বশেষ করোনা মহামারীতে সৌদি আরব কঠোর হওয়ায় ব্যবসা বন্ধ করে নিজেও দেশে চলে এসেছেন।

মুকুুলের মতো সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরে ব্যবসা করার চিন্তা করছেন দাম্মামের ব্যবসায়ী রানা রহমানও। রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় সুদিন হারিয়ে এই বাংলাদেশী এখন দেশে ফেরার তোড়জোড় শুরু করেছেন।

একই পরিস্থিতি মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশে অবস্থানকারী বাংলাদেশীদেরও। শ্রমবাজারে সংকট এবং করোনা মহামারীর শিকার ওমানে কয়েক হাজার বাংলাদেশী ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। তারা জানান, ওমানে ব্যবসা-বাণিজ্য সংকুচিত হওয়া, বাসা ভাড়া, দোকান ভাড়া, সার্ভিস চার্জ, কর্মচারীদের বেতন দেয়া এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা।

ওমানের মাস্কাট শহরে বসবাসরত বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, করোনা পরিস্থিতির কারণে ওমানে যারা দীর্ঘদিন সুনাম ও দক্ষতার সঙ্গে ব্যবসা করছিলেন তারা এখন বেশ চ্যালেঞ্জের মুখে। ওমানের সালালাহ শহরে টেইলারিংয়ের ব্যবসা করেন করিম শেখ। প্রতি মাসে অন্তত ৪-৫ লাখ টাকা উপার্জন করতেন তিনি। করোনার কারণে ওমানে পর্যটক প্রবেশ করতে না পারায় দীর্ঘ চার মাস ধরে ব্যবসায় মন্দা ভাব। সালালাহ শহরে অন্তত দেড় শতাধিক টেইলারিংয়ের ব্যবসা রয়েছে বাংলাদেশীদের। এসব ব্যবসায়ীও এখন দুশ্চিন্তায় রয়েছেন কর্মচারীদের বেতন, দোকান ভাড়া ও বাড়ি ভাড়া নিয়ে।

করোনা মহামারীর প্রভাব মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম শ্রমবাজার কাতারেও লেগেছে। সেখানকার বাংলাদেশীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কাজ না থাকায় অনেক শ্রমিক আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব এমনকি দেশ থেকে টাকা নিয়ে জীবন চালাচ্ছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কাতার প্রবাসী বাংলাদেশী জানান, চাকরি না থাকায় বন্ধুদের ওপর ভর করে বেকার অবস্থায় জীবন যাপন করছেন তিনি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, জুনে রেকর্ড রেমিট্যান্স আসার পেছনে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোই সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে। এসব দেশে বসবাসকারী বাংলাদেশীরা দীর্ঘদিনের সঞ্চয়, ব্যবসার মূলধন ও ধার করা অর্থ দেশে পাঠাচ্ছেন।

একক মাস হিসেবে বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স এসেছে জুনে। গত মাসে প্রবাসীরা দেশে পাঠিয়েছেন ১৮৩ কোটি ২৫ লাখ ডলার। বাংলাদেশী মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা। ২০১৯ সালের জুনে দেশে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৩৬ কোটি ৮২ লাখ ডলার। সে হিসেবে গত মাসে রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ৩৪ শতাংশ। প্রবাসীদের পাঠানো এ রিজার্ভের ওপর ভর করে এক মাসেই দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি বেড়েছে। গত বৃহস্পতিবার রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩৬ দশমিক ১৪৪ বিলিয়ন ডলার। বিধ্বস্ত অর্থনীতিতে হঠাৎ করেই রিজার্ভ বৃদ্ধির সংবাদে উচ্ছ্বসিত সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক। যদিও এ উচ্ছ্বাস বেশিদিন স্থায়ী হবে না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

উপসাগরীয় যুদ্ধের সময়ের উদাহরণ টেনে তারা বলেন, ১৯৯০ সালের ২ আগস্ট হঠাৎ করেই ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন কুয়েত দখল করে নেন। ওই সময় কুয়েতে বসবাসকারী ফিলিস্তিনি ও জর্ডানি প্রবাসীরা সাদ্দাম হোসেনের পক্ষ নেয়। যুদ্ধে সাদ্দাম হোসেন পরাজিত হলে ফিলিস্তিনি ও জর্ডানি নাগরিকদের কুয়েত ছাড়তে বলা হয়। প্রবাসীরা দেশে ফিরলেও জর্ডানের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তরতর করে বাড়তে থাকে।

বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিকে জর্ডানের পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করতে চান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর। উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ছিলেন তিনি। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ফিলিস্তিনিরা শিক্ষিত হওয়ায় কুয়েতের উচ্চপদে চাকরি করতেন। তাদের কুয়েত ছাড়ার নির্দেশ দেয়ায় পর দলে দলে জর্ডানে ফেরেন। কারণ ফিলিস্তিনিদের পাসপোর্ট জর্ডান থেকে ইস্যু করা হতো। এতে জর্ডানের রিজার্ভ অস্বাভাবিক গতিতে বাড়তে থাকে। বাড়িঘরসহ অবকাঠামো নির্মাণে বড় ধরনের জোয়ার সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশের রেমিট্যান্স ও রিজার্ভ বৃদ্ধির পরিস্থিতিও জর্ডানের মতোই। তবে মধ্যপ্রাচ্যে বসবাসকারী বাংলাদেশীরা অপেক্ষাকৃত নিম্নপদে চাকরি করেন। তাদের হাতে খুব বেশি অর্থও নেই। এজন্য প্রবাসীরা দেশে ফিরলে অবকাঠামো খাতে বড় উল্লম্ফনের সম্ভাবনাও নেই। চাকরিজীবীরা সঞ্চয় ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা মূলধন দেশে পাঠানোয় রেমিট্যান্স বাড়ছে। এ প্রবৃদ্ধি দীর্ঘস্থায়ী হবে না।

দেশে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আসে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের মাধ্যমে। জুনে নিজেদের অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স দেশে আনতে পেরেছে ব্যাংকটি। গত মাসে ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স এসেছে ৪১৪ কোটি ৯৮ লাখ ডলার। এর আগে কখনই ব্যাংকটির মাধ্যমে ৪০০ কোটি ডলারের বেশি রেমিট্যান্স আসেনি। ইসলামী ব্যাংকের রেমিট্যান্স আহরণের প্রধান বাজার হলো মধ্যপ্রাচ্য। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর প্রবাসীরা বেশি অর্থ পাঠানোর কারণেই ব্যাংকটির রেমিট্যান্স সংগ্রহে উল্লম্ফন হয়েছে।

ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মাহবুব উল আলম এ প্রসঙ্গে বলেন, অতীতে ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে ৩৯০ কোটি ডলারের বেশি কখনই রেমিট্যান্স আসেনি। কিন্তু গত দুই মাসে আমাদের ব্যাংকের রেমিট্যান্সে বড় ধরনের প্রবৃদ্ধি হয়েছে এবং এক মাসেই চার বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স এসেছে। ২ শতাংশ সরকারি প্রণোদনা বাস্তবায়ন ও হুন্ডির তত্পরতা উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পাওয়ায় ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স বেড়েছে বলেই মনে করছি। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রবাসীরা হয়তো সঞ্চয়ের টাকাও দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছেন।

মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অন্যতম শ্রমবাজার কুয়েতের পরিস্থিতি এখনো অস্বাভাবিক। দেশটিতে লকডাউন চলছে প্রায় তিন মাস ধরে। কুয়েতে বসবাসকারী বাংলাদেশীরা এখনো ঘরে বন্দি। ফলে দেশটি থেকে রেমিট্যান্স আহরণও এখন নিম্নমুখী। একই পরিস্থিতি ওমান, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার। স্বাভাবিক হয়নি ইতালি ও ফ্রান্স থেকে রেমিট্যান্স প্রেরণও। করোনার পরিস্থিতি শুরু হওয়ার পর থেকে এ দেশগুলো থেকে রেমিট্যান্স প্রেরণ তলানিতে নেমে গেছে।

সিঙ্গাপুরের পাশাপাশি ইউরোপের অনেক দেশে বসবাসকারী বাংলাদেশীরা ঘরে বসেও সরকার বা নিজ প্রতিষ্ঠান থেকে বেতনের অর্থ পেয়েছেন। তবে এ পরিস্থিতি দীর্ঘস্থায়ী হবে না বলেই মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম এ তসলিম। তিনি বলেন, প্রবাসীদের একটি অংশ এরই মধ্যে বেকার হয়ে ফিরতে শুরু করেছেন। আগামী কয়েক মাসে এ সংখ্যা আরো অনেক গুণ বাড়বে। জ্বালানি তেলের দামে বড় পতন হওয়ায় মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনীতিতে স্থবিরতা কাটবে না। বরং এ দেশগুলো সরকারিভাবে বিদেশী শ্রমিক কমানোর উদ্যোগ নেবে। এতে বাংলাদেশীদের পরিস্থিতি আরো নাজুক হবে। এজন্যই প্রবাসীরা সঞ্চয়ের অর্থ দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। দেশের রেমিট্যান্সের বিদ্যমান প্রবৃদ্ধি দুই-তিন মাস স্থায়ী হতে পারে। তারপর কমতে শুরু করবে।

এম এ তসলিম বলেন, প্রবাসীরা বিদেশে যাওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের তেমন কোনো অবদান নেই। সরকার কোনো দেশে অভিবাসনের জন্য ৪০ হাজার টাকা ফি নির্ধারণ করলে, সেখানে ৪-৫ লাখ টাকা ব্যয় করতে হয়েছে। নিজেদের জমি বিক্রি কিংবা ঋণ করে প্রবাসীরা বিদেশ গিয়েছেন। এখন দেশে ফিরলেও সরকার কিছু করতে পারবে বলে মনে হয় না।