বিদ্যুৎ সরকার : এখন আর আগের মতোন চিঠিগুলো হৃদয় ছুঁয়ে যায় না। অথচ কৈশোর বা যৌবনে পাওয়া যে কোন চিঠে আমার কাছে আনন্দের উৎস ছিল। সেই চিঠির প্রেরক যেই হোক না কেন, সুখ অথবা দুঃখের এগুলো ছিল নিতান্ত গৌণ। আমার কাছে আসা প্রথম চিঠি ছিল ডাক-টিকিট ছাড়া, কোনরূপ খাম বা ইনভেলপ ব্যতিত ভাঁজ করা কাগজের একটি গোলক ধাঁধা সম্পন্ন চিঠি। সহপাঠি মেয়ে বন্ধুর কাছ থেকে পাওয়া। ক্লাস চলাকালীন সময়ের ফাঁকে, চিঠিটি আমার বইয়ের ভাঁজে পাঠিয়ে দেয় সে। প্রথমে চিঠিটাকে কাগজের তৈরি কোন বুদ্ধির খেলা ভেবে ভুল করেছিলাম। অনেক ভাঁজে ভাঁজ করা একটি ফুলের আদলে তৈরি চিঠি। বাড়ি এসে ফুলের নির্মাণশৈলী অটুট রেখে আস্তে আস্তে একসময় চিঠির গভীরে যেতে সক্ষম হয়েছিলাম আমি। চিঠির লাইনটিও ছিল অদ্ভূত রকমের “কেমন বোকা বানালাম তোমাকে! কষ্ট পেও না।”
ছোট্ট একটুকুন লেখা প্রথম চিঠির স্মৃতি এখনও আমি বয়ে বেড়াচ্ছি। কাগজের তৈরি ফুল থেকে যে সৌরভ তা কেবল ছড়ায় তা কেবলই নির্মল আনে হৃদয়ের অলিন্দে। তারপরও সে আমাকে অনেকবার চিঠি দিয়েছে একইভাবে। কিন্তু প্রথম চিঠির মে অনভূতি ছিল অন্য রকম, ভিন্ন স্বাদের। এক সময় আমরা পরষ্পর আলাদা হয়ে যাই উপরের শ্রেণীতে হাইস্কুলে চলে যাওয়ার কারনে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে চিঠির কলেবরও বৃদ্ধি পেয়েছে। ভাষা ও ভালোবাসার গুনগত মান উন্নত হয়েছে, সাথে সাথে চিঠির নান্দনিক দিকের উৎকর্ষতা লাভ করেছে। তবে, আবেগ কতটা বেগবান হয়েছে ভেবে দেখেনি কখনো। হাই স্কুল এসে পাড়াতুতো সমবয়সী ও সহপাঠিদের সাথে হাতে গোনা কয়েকটি চিঠি চালাচালের সুযোগ হয়েছিল তাও আবার অতি সাবধাণতা অবলম্বন করে, পড়ার বই বা গল্পের বই লেনদেনের সুবাদে। কলেজে পড়ার সময় আবার মেয়েদের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ ঘটে যায় আমার। বিজ্ঞান শাখায় পড়ার কারণে ব্যবহারিক ক্লাসগুলোতে বেশি বেশি আন্তরিক হয়ে পড়তাম। সল্ট টেস্ট, এসিড টেস্ট করতে করতে ভাললাগার রসায়ন কখনো কখনো জমে উঠতো। পরিণতিতে সুগন্ধীমাখা লাল খামে ভালোবাসার সমীকরণে ভরা প্রেম নিবেদন জোড়ালো হতো। তখন চিঠি লেখার জন্য যেমন বিভিন্ন রকমের “রাইটিং পেড” খুঁজে বেড়াতাম। তেমনি খুঁজতাম সুন্দর সুন্দর ইনভেলপ, কলম। শুধু তাই কী চিঠির ভাঁজে থাকতো গন্ধযুক্ত গোলাপের পাঁপড়ি, ঝড়া পাতার শুকনো নিথর দেহ, ময়ূরের পালক, প্রজাপতির রঙিন ডানা আর থাকতো সুগন্ধী বা গায়ে মাখার টেলকম পাওডারের মসৃন সুখ।
বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে চিঠির কলেবর ছোট হতে থাকলেও এর গভীরতা ছিল অনেক বেশি, আবেদন ছিল গগনচম্বী। এভাবে পত্র-সংস্কৃতির উত্তরণ হতে থাকলো নীরবে। তবে, এ পর্যায়ে যে শুধু মেয়েদের কাছেই চিঠি লেখা সীমাবদ্ধ ছিল তা নয়। এর সাথে যোগ হয়েছিল বাবা-মা, আত্মীয়- স্বজন, ছেলে বন্ধুদের কাছেও চিঠি লিখার তাগিদ। সব চিঠিই কম বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ডাকে চিঠিগুলো যখন আমার কাছে আসতো আমি হাত দিয়ে স্পর্শ করতাম আর পুলকিত হতাম। চিঠির চালাচালিতে কেমন শিহরিত হতো দেহ-মন। হাতে লিখা আমার কাছে আসা শেষ চিঠি ছিল হারিয়ে যাওয়া এক বন্ধুর কাছ থেকে। যে কিনা একদিন হঠাৎ করেই অদৃশ্য হয়ে গেল আমাদের কাছ থেকে কিছু না বলে, কিছু না জানিয়ে। অথচ কী দারুন দৃশ্যমান হয়েছিল মনের মাঝে অনেক অনেক দিন। তারপর একদিন পশ্চিমে ডুবে যাওয়া সূর্যের মতোন সেই স্মৃতি বিলীন হয়ে যায় ভাবনার অন্ধকারে। কী তার অভিমান আজো জানতে পারিনি। শেষ যেদিন তার সাথে দেখা হয়েছিল সে দিন ছিল তার জন্মদিন। জন্মদিনে অনেকগুলো গোলাপ আর আমার নিজ হাতে আঁকা একটি কার্ড দিয়েছিলাম তাকে। ও আমার শিল্পকর্মের প্রশংসা করতো ভীষণ, শুধু বলতো ছবি আঁকার জন্য। সে সময় যতো ছবি এঁকেছি সে শুধু তারই অনুপ্রেরণায়। যে বেসরকারী সংস্থাতে আমি কাজ করতাম সেও সেই সংস্থাতে কাজ করতো একই বিভাগে। প্রায় সময় আমাদের অফিসের কাজে ট্যুরে যেতে হতো। এভাবেই তার সাথে বন্ধুত্বটা বেশি গাঢ় হয়ে পড়েছিল। কেমন করে সে আমার ডাক ঠিকানা পেল জানি না। হয়তো কর্মস্থলের ঠিকানা কোন না কোন ভাবে তার নাগালে এসেছিল। চিঠির খামের উপর আমেরিকার সীল ও ডাকটিকিট দেয়া ছিল। “ফেসবুকে তোমার অনেক ছবি দেখলাম, এমনকি তোমার ছোট্ট সুখী পরিবারের ছবিও। পত্রিকায় তোমার লেখা পড়লাম, ভালো লাগলো। তুমি কী এখনও ছবি আঁকা চালিয়ে যাচ্ছো? তোমার দেয়া কার্ডটি ‘ফ্রেমে’ বাধিয়ে কম্পিউটার টেবিলে রেখে দিয়েছি। শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। শেষ দুটো কেমো নিলে ডোজ শেষ হবে। আমার জন্য একটু প্রার্থনা করো। ইতি- সাগরিকা চৌহান”।
সাগরিকা চৌহান আমার ভালো বন্ধুদের ভিতর একজন। চিঠিটা পাওয়ার পর সে কতো স্পষ্ট হয়ে স্মৃতি থেকে আবার উঠে এলো। চিঠির শেষে তার নামের উপর স্পর্শ রেখে তার উপস্থিতি অনুভব করতে চেষ্টা করলাম। তার সরু সরু আঙ্গুলগুলো ছুঁয়ে দেখতে চাইলাম। কেনইবা আবার সে দৃশ্যমান হয়ে উঠলো মনের মাঝে। অনেক পুরনো অতীতকে বর্তমানের প্রেক্ষাপটে নিয়ে এলো ছোট্ট একটি চিঠি। ট্রাঙ্কের ভিতর ইস্ত্রি করা পুরনো কাপড়ের ভাঁজ থেকে উঠে আসা ন্যাপথোলিনের গন্ধের মতো এক ধরনের ভালোবাসার সুবাস ছড়ায় ছিল বুঝি তার চিঠির গহীনে।
বিদ্যুৎ সরকার : লেখক ও আলোকচিত্রী, টরন্টো, কানাডা