ইউসুফ কামাল : বন্ধু খালিদ খান এই মাসের এগারো তারিখে ফিরে যাচ্ছেন তার তৃতীয় ঠিকানা লস এ্যান্জ্লস্ এ। চলে যাওয়ার আগের সস্ত্রীক দেখা করতে এলেন আমাদের সাথে, বলে গেলেন আগামীকাল ওদের বাসায় যেতে। সামান্য কয়েকদিন পরিচয় হলেও উনার সাথে আমার সম্পর্কের মাত্রাটা বেশ গভীর হয়ে গিয়েছে। হয়তো এর পিছনের কারন তার শৈশব, কৈশর আর যৌবনের লেখাপড়াসহ পুরো সময়টা জুড়ে বাংলাদেশে বেড়ে ওঠার মধুর স্মৃতি। একই সাথে তার নিজের ভিতরেও গড়ে উঠেছে তার দীর্ঘ দিন পার করা সেই দেশের প্রতি গভীর মমত্ববোধ। সেটা নিজেই অকপটে স্বীকার করলেন আজ আমার কাছে। আশ্চর্য হলাম এই লোকটার মনের ভিতরে যে এত কিছু না বলা কথা লুকিয়ে আছে কখনোই বুঝতে বুঝতে দেন নি আমাকে।

সাতচল্লিশে দেশ বিভাগের প্রাক্কালে ভারতের পাটনা থেকে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গার ভিতরে ট্রেনে করে বাবা মা’র কোলে চড়ে কোন মতো জীবন নিয়ে বেঁচে এসেছিলেন পার্বতিপুরে। সেটা একটু বড়ো হয়ে পরে শুনেছিলেন মায়ের মুখ থেকে। চলন্ত ট্রেনের মধ্যেও কয়েকবার আক্রান্ত হয়েছিলেন ভারতের ভিতরেই। বেশ কিছু ষ্টেশনে ট্রেন ঢোকা মাত্রই দাঙ্গাকারীরা পাকিস্তান গমণরত মুসলমান যাত্রীদের বিশেষ করে মহিলাদের উপর আক্রমণ করে তাদের স্বর্ণালংকার টাকা পয়সা সব কিছু ছিনিয়ে নিয়েছিলো আর সেই সাথে নির্বিচারে পুরুষদেরকে হত্যা করেছিলো। এমন কি পুলিশের প্রতিরোধের মধ্যেও অনেক যাত্রী তখন মারা গিয়েছিলো দাঙ্গাবাজদের হাতে। বুদ্ধি হওয়ার পরে প্রথমে পার্বতীপুর কেই নিজের দেশ মনে করেছিলেন কিশোর খালিদ খান। ধীরে ধীরে বুঝেছিলেন ওটা তার নিজের দেশ না, ওরা রিফুজী, ওরা বিহারী। লোকজন কেমন যেন একটা অস্পৃস্য আর বৈষম্যমূলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো তাদের দিকে। শিশু মনে সেটা তার মনে গভীরভাবে রেখাপাত করেছিলো। স্থানীয় বাঙালী আর অবাঙালীদের মধ্যকার দূরত্বটা স্কুলে ভর্তির পর আরো গভীরভাবে উপলদ্ধি করেছিলেন ঐ সময়েই।

ক্লাসের বন্ধুদের মধ্যেও কেমন যেন একটা অদৃশ্য দেয়াল ছিলো। ইচ্ছা থাকা সত্বেও সেই দেয়ালটা কেউই দূরে সরিয়ে ফেলতে পারতো না। ক্লাসের অনেকে আবার এক বেঞ্চে তার সাথে বসতেও চাইতো না, দূরে দূরে বসতো। খালিদ খান নিজেই বল্লেন, এখন আবার আমার তৃতীয় ঠিকানায় চলে যাচ্ছি। দোয়া করবেন আবার যেন আমাদের দেখা হয়। বল্লাম, তৃতীয় ঠিকানা কেন খালিদ ভাই, ওটাই তো এখন আপনার নিজের বাড়ি। আমার কথায় খালিদ খানের মুখ মলিন হয়ে গেলো, চুপ করে গেলেন। তাকিয়ে দেখলাম তার ভাবলেশহীন মুখের দিকে, হয়তো এর উত্তর তার জানা নেই। হয়তো তাই চুপ করে থাকাই যথার্থ মনে করলেন। প্রসংগ পাল্টানোর জন্য খালিদ খানকে ধরে বাসার ব্যাকইয়ার্ডের লেক সংলগ্ন ডেক এ নিয়ে বসলাম। বাইরের খোলা মেলা প্রকৃতিতে কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বল্লেন, ইউসুফ ভাই লক্ষ্য করলে দেখবেন সারা বিশ্বের বড় বড় রাজনৈতিক নেতৃবন্দের কাছেই সাধারণ মানুষের জীবনের কোন মূল্য নেই। সব রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দই তাদের ব্যাক্তি স্বার্থ ও রাজনৈতিক স্বার্থের পিছনে দৌঁড়ায়, সাধারণ মানুষের জীবন তাদের কাছে মুখ্য নয়। মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলাই যেন তাদের একমাত্র কাজ। অবলীলায় সত্য কথাগুলো বলে গেলেন। এরপর এক অজানা তথ্য ধীরে ধীরে আমার কাছে উন্মোচন করলেন আমাকে খুব আপন মনে করে। বল্লেন, আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর পাসপোর্ট ভিসা করে মা’কে নিয়ে একবার গিয়েছিলাম পিতৃভূমি ভারতের পাটনা’র নিজ গ্রাম বকতিয়ারপুরে। উদ্দেশ্য ফেলে আসা আমার সেই পিতৃ ভূমি দেখে আসা, যে স্থান ছেড়ে আমি চলে এসেছিলাম মাত্র দুই বছর বয়সে। মায়ের মুখে পিতৃপুরুষদের কথা শুনতে শুনতে পিতৃ পুরুষের ভিটেবাড়ী দেখার প্রচন্ড ইচ্ছা হয়েছিলো মনের মধ্যে। সে খানে যেয়ে আমার মনে হয়েছিলো, এ কোন রাজনীতির খেলার মধ্যে আবর্তিত হয়েছিলাম আমরা?

যার পুরোটাই জুড়ে ছিল বড় বড় রাজনৈতিক নেতাদের অর্থনৈতিক আর ধর্মীয় স্বার্থের খেলা, দাবার গুটির মতো ব্যাবহার করেছিল আমাদের মতো নিরীহ দেশবাসীদেরকে। আমার মায়ের গ্রামের বাড়ি পালিগঞ্জ বাবার বাড়ি বকতিয়ারপুর থেকে মাত্র দশ মাইল দূরে। পালিগঞ্জ তখন পাটনার মধ্যে সব দিক দিয়ে উন্নত একটা এলাকা। মুসলিম আর অমুসলিমদের সুন্দর সহ অবস্থানের একটা মেলবন্ধন ছিলো সমস্ত এলাকা জুড়ে। মায়ের কাছ থেকে জেনেছিলাম তাদের পরিবারের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা আমার বাবা’র পরিবার থেকে অনেক ভালো ছিলো। সবাই তাদেরকে শ্রদ্ধা ও সমীহ করতো। শুধুমাত্র বাবার উচ শিক্ষার কারণেই এই বৈবাহিক সম্পর্কটা সম্ভব হয়েছিলো। আশ্চর্যের বিষয় হলো সাতচল্লিশ এ আমার মায়ের পরিবারের কেউই কিন্তু দেশ ত্যাগ করেননি, কেউ দেশ ত্যাগ করতেও দেয়নি। কখনই তাদের পরিবারের উপর কোন রকম আক্রমনাত্মক ঘটনাও ঘটেনি। তারা এখনো বহাল তবিয়তেই পাটনায় বসবাস করছেন। আমরা যখন আমার মায়ের বাড়ি পালিগঞ্জে তাদের পরিবারের লোকজনের সাথে দেখা করতে যাই, দেখি আমার মা’য়ের বড় ভাই তখন পালিগঞ্জ গ্রাম পঞ্চায়েতের একজন জৈষ্ঠ্য নির্বাচিত জন প্রতিনিধি। ভাবছিলাম এটা কিভাবে সম্ভব? খালিদ খান যোগ করলেন মুসলিম অমুসলিম দের মধ্যে বিভক্তির ধারা রোপন করার মূল কারিগর ছিল তৎকালীন উচ্চাভিলাষী রাজনৈতিক নেতৃবন্দসহ সমাজের উচ্চাসনে বসে থাকা কিছু ধনিক শ্রেণীর মানুষ। তারা শুধুমাত্র তাদের ব্যাক্তি স্বার্থের কারণে এগুলো করেছিলো।

আমার মায়ের পরিবারের বয়স্ক মানুষেরা আমার বাবা মা’কে দেশ ত্যাগ করতে নিষেধ করেছিলেন, বলেছিলেন বেশি অসুবিধা হলে কিছু দিন ওনাদের ওখানে যেয়ে থাকতে। অল্প কিছুদিন অসুবিধা হবে, পরে সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু বাবা রাজী হননি চলে এসেছিলেন পাকিস্তানে, মুসলানদের জন্য নিরাপদ আবাস স্থলের প্রত্যাশা করে। কিন্তু এখানে এসেও দেখলেন সেই সংখ্যা লঘু আর সংখ্যা গুরুর দ্বন্ধ, তবে সেটা ভিন্ন আংগিকে। বাঙালী আর অবাঙালীর মধ্যকার দ্বন্ধ। ধর্ম এক হলেও ভাষা গত দূরত্ব যে অনেক গভীরে প্রোথিত যা খুব সহজে দূর হবার নয়। মওলানা আবুল কালাম আজাদসহ কিছু ভারতীয় কেন্দ্রীয় মুসলিম নেতৃবৃন্দ তখন ভারতীয় মুসলিমদেরকে দেশ ত্যাগ করতে নিষেধ করেছিলেন।

বলেছিলেন এগুলোর পিছনে কিছু হিন্দু আধিপত্যবাদী নেতৃত্বের ষড়যন্ত্র নিহিত আছে। এর ফলাফল সাধারণ জনতার জন্য ভালো কিছু বয়ে আনবে না। এলাকাভিত্তিক স্বার্থান্বেষী হিন্দু নেতৃবৃন্দের উদ্দেশ্যমূলক হামলার পাশাপাশি পাকিস্তানপন্থী কিছু মুসলিম নেতারাও নিরাপত্তাসহ ধর্মীয় ভ্রাতৃত্ব বোধের জিকির তুলে লক্ষ লক্ষ অসহায় নিরীহ মুসলিম অধিবাসীদেরকে সরাসরি মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছিলেন। ফলাফল যা হবার তাই হয়েছিলো, ভিন্ন দেশে শরনার্থী হয়ে এরা ধুকে ধুয়ে জীবন শেষ করেছে।

খালিদ খান বল্লেন, আমি হয়তো লাখের মধ্যে একজন যে কিনা ভাগ্য গুনে পরিবার পরিজনসহ এখনো বেঁচে আছি। বাকী অনেকেই তো এখনো বিভিন্ন দেশে জেনেভা ক্যাম্পের মতো ক্যাম্পে আট ফুট বাই আট ফুট ঘরের মধ্যে পরিবার পরিজন নিয়ে, ছোট্ট একটা ঘরে ধুকে ধুকে মরছেন। কথাটা শেষ করে খালিদ খান বুক ভাংগা লম্বা একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লেন। জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসে যেন সেই ষঢ়যন্ত্রকারী বড় বড় রাজনৈতিক নেতাদের আসল চরিত্র উনার কাছে উন্মোচিত হয়ে গেছে। (চলবে)
ইউসুফ কামাল : লেখক, কেটি, টেক্সাস, ইউএসএ