হাসান গোর্কি : আমার এক বন্ধু বাংলাদেশের একটা সরকারি কলেজের অধ্যাপক। তিনি By Design: Behe, Lennox, and Meyer on the Evidence for a Creator শিরোনামে Hoover Institute-র তৈরি করা একটা ডকুমেন্টারি পাঠিয়েছেন। বেশ তথ্যবহুল আলোচনা; বিশেষ করে আমরা যারা বিজ্ঞানের ছাত্র নই তাঁদের জন্য বিবর্তনবাদের বিপক্ষের যুক্তিগুলো বুঝতে পারার জন্য এই আলোচনা সহায়ক হতে পারে (এই লিংক থেকে আলোচনাটা দেখুন: https://www.youtube.com/watch?v=rXexaVsvhCM, ÒBy Design: Behe, Lennox, and Meyer on the Evidence for a Creator” লিখে সার্চ দিলেও এটি পাওয়া যাবে)। যদিও যুক্তিগুলো পুরনো এবং এর কয়েকটির ভালো ব্যাখ্যাও বিবর্তনবাদীরা অনেক আগেই দিয়েছেন তবু বিরুদ্ধ মত হিসেবে এগুলো মূল্যবান। তবে এই ডকুমেন্টারির একটা দুর্বল দিক হলো, অংশগ্রহণকারীরা নিরপেক্ষ কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ করার সুযোগ আছে।
এখানে কথা বলেছেন, লিহাই ইউনিভার্সিটির (পেনসালভেনিয়া) বায়োক্যামিস্ট্রির প্রফেসর গরপযধবষ ইবযব, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটস প্রফেসর John Lennox, এবং Whitworth কলেজের জিওফিজিক্সের প্রফেসর Steven Meyer| Michael Behe, John Lennox ও Steven Meyer-র লেখা একটি করে জনপ্রিয় বইয়ের নাম যথাক্রমে The Biological Challenge to Evolution: DarwinÕs Black Box, Can Science Explain Everything? I DarwinÕs Doubt। অংশগ্রহণকারীদের লেখা এই তিনটি বইয়ের নামে ধর্ম বিশ্বাসীদের গতানুগতিক জিজ্ঞাসার আভাস পাওয়া যায়। পুস্তকগুলোর নাম কিছুটা বাহাছ বা বাকযুদ্ধমূলক (argumentative, quarrelsome)। Steven Meyer পড়াশোনা করেছেন Whitworth University-তে। বর্তমানে ৩০০০ ছাত্র নিয়ে এটি যুক্তরাষ্ট্রের পিটার্সবার্গ চার্চের এফিলিয়েটেড একটি স্পেসালাইজড প্রাইভেট ক্রিশ্চিয়ান ইউনিভার্সিটি। এই ডকুমেন্টারিটির সঞ্চালক Peter Robinson পড়াশোনা করেছেন ক্রাইস্ট চার্চ কলেজে। ১৫৪৬ সালে রাজা তৃতীয় হেনরি এটি প্রতিষ্ঠা করেন— যিনি ছিলেন ধর্মপ্রাণ ক্যাথলিক। তাঁর একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিলো: তিনি জনসমাবেশ করে নিজেই ধর্মীয় বক্তৃতা (piety) দিতেন। আমাদের দেশে এখন যেমন ওয়াজ হয়, সেরকম।
ক্রাইস্ট চার্চ কলেজ বর্তমানে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি কনস্টিটিউয়েন্ট কলেজ, যা যৌথভাবে চালায় অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও ক্রাইস্ট চার্চ ক্যাথিড্রাল। কলেজটি খ্রিস্ট ধর্মের উপাসনালয় (chapel) হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। যেমন অক্সফোর্ড সেন্টার ফর ইসলামিক স্টাডিজে ইসলাম বিষয়ক পড়াশোনার পাশাপাশি এর মসজিদে কোরআন শিক্ষা ও ইসলাম ধর্মীয় আচার শিক্ষার কোর্স চালানো হয়। ডকুমেন্টারিটি তৈরি করেছে Hoover Institute, এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা যেটিকে একটি রক্ষণশীল প্রতিষ্ঠান হিসেবে উল্লেখ করেছে (লেখা হয়েছে, Known for its conservative orientation)। অর্থাৎ ডকুমেন্টারিটির স্বত্বাধিকারী প্রতিষ্ঠান (Hoover Institute), সঞ্চালক ও অংশগ্রহণকারীদের খ্রিস্ট ধর্মের সাথে সংশ্রব আছে এবং ধর্ম বিশ্বাস দিয়ে তাঁরা প্রভাবিত এ’রকম অনুমান করারও সুযোগ আছে। যেমন মদিনা, করাচি, আল আজহার বা তেহরান বিশ্ববিদ্যালয় যদি বিবর্তনবাদ নিয়ে গবেষণা করে তাহলে তা ধর্মীয় বিশ্বাস দিয়ে প্রভাবিত হবার সুযোগ থাকবে। আমরা খেয়াল করলে দেখবো তিন অংশগ্রহণকারী একটি মত প্রতিষ্ঠার জন্য একই সুরে কথা বলছেন। বিরুদ্ধ মতের কেউ এই আলোচনায় নেই। উপস্থাপকরা সাধারণত বিরুদ্ধ মতের প্রশ্ন করেন। এখানে সঞ্চালককে লক্ষ্য (!) অর্জনে অংশগ্রহণকারীদের চেয়েও উৎসাহী মনে হয়েছে।
শুরুতেই সঞ্চালক বলছেন, “আইনস্টাইনের স্পেশাল থিওরি অব রিলেটিভিটি ১৯০৫ সালে প্রকাশিত হবার পর একের পর এক এর সত্যতার সাক্ষ্য পাওয়া যাচ্ছে। এই তত্ত¡কে বুঝতে পারা ক্রমাগত সহজ থেকে সহজতর হচ্ছে। বিপরীতপক্ষে ডারউইন তাঁর অরিজিন অব স্পিসিস প্রকাশ করেন ১৮৫৯ সালে। তাঁর তত্ত¡ বুঝতে পারা কি ক্রমাগত সহজ থেকে সহজতর হচ্ছে?” অংশগ্রহণকারীদের সকলেই সমস্বরে বললেন, “না” (সঞ্চালক হয়তো এই উত্তরটি-ই আশা করছিলেন।)। তাঁদের এই উত্তর থেকে এটা অনুমান করতে দোষ নেই যে তাঁরা সুনির্বাচিত অংশগ্রহণকারী। “The British Journal for the History of Science”-এ (পৃ. ২০, ডিসেম্বর ১৯৬৭) লেখা হয়েছে, “দেড় দশক আগে (অর্থাৎ ১৯৫০ এর দিকে) বিবর্তনবাদে বিশ্বাসী বিজ্ঞানীদের সংখ্যা ছিলো কমবেশি ৭০%। এখন সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৬%। প্রকৃতপক্ষে ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে সাইটোজেনেটিক্স ও আণবিক জীববিদ্যার আবির্ভাবের পর যখন কোষ বংশবিদ্যা বিস্তার লাভ করে এবং জেনেটিক ট্রেইটের পশ্চাৎমুখী সংযোগের স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যেতে শুরু করে তখন-ই বিজ্ঞানীদের মধ্যে বিবর্তনবাদে বিশ্বাসীদের সংখ্যা দ্রুত বেড়ে যায়। পিউ রিসার্চ সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে The American Association for the Advancement of Science (AAAS)-র ৯৮% বিজ্ঞানী বিবর্তন তত্তে¡ বিশ্বাস করেন। তার অর্থ ডকুমেন্টারিতে যে ৩ জন প্রফেসর/বিজ্ঞানীকে আমরা দেখতে পাচ্ছি তাঁরা ঐ ২% এর অন্তর্ভুক্ত।
যাহোক, এরপর প্রফুল্ল সঞ্চালক Steven Meyer কে ফসিল রেকর্ড ও মিসিং লিংক নিয়ে প্রশ্ন করলেন। এক শতাব্দী আগে এটি খুব জনপ্রিয় প্রশ্ন ছিলো। এই প্রসঙ্গ এখন আর কেউ তোলে না। কারণ, আজ অবধি অস্ট্রালোপিথেকাস, হোমো ইরেক্টাস থেকে হোমো সেপিয়েন্স পর্যন্ত সব পর্যায়ের অসংখ্য ট্রাঞ্জিশনাল ফসিল পাওয়া গেছে। সংরক্ষিত ফসিলগুলোর মধ্যে থেকে আদর করে প্রায় ছয় হাজার ফসিলের নামকরণও করা হয়েছে। স্মিথসোনিয়ান জাদুঘরের ওয়েবসাইটে (https://www.si.edu/) তাদের তালিকা পাবেন।
এখানে কয়েকজনের নাম (বন্ধনীতে আবিষ্কারের সন) দেখুন: টাং— অস্ট্রালোপিথেকাস আফ্রিকান (১৯২৪), মোজোকারতো— হোমো ইরেক্টাস (১৯৩৬), মিসেস প্লেস-অস্ট্রালোপিথেকাস আফ্রিকানাস (১৯৪৭), টাউটাভেল-হোমো ইরেক্টাস (১৯৭১), লুসি বা, অখ ২৮৮-১-অস্ট্রালোপিথিকাস এফারেনসিস (১৯৭৪), ডলি-হোমো ইরেক্টাস বা হোমো হাইডেলবার্গেনসিস বা প্রাথমিক হোমো সেপিয়েন্স (১৯৭৮), তুরকানা বয়-হোমো আর্গাস্টার (১৯৮৪), স্কলাডিনা-হোমো নিয়ান্ডারথালেনসিস (১৯৯৩), আরডি-আরডিপিথেকাস রামিডাস (১৯৯৪), ইউরিডাইস-প্যারানথ্রপাস রোবস্টাস (১৯৯৪), ডাকা-হোমো ইরেক্টাস (১৯৯৭), মাদাম বুয়া-হোমো হাইডেলবার্গেনসিস বা হোমো ইরেক্টাস (১৯৯৭), ওবি-রখমত-হোমো নিয়ান্ডারথালেনসিস (২০০৩), হবিট-(হোমো ফ্লোরেসিয়েনসিস (২০০৩)।
এবার দেখা যাক প্রাণিদের ক্ষেত্রে ট্রানজিশন ঘটার প্রমান বিজ্ঞানীদের কাছে আছে কিনা। মাত্র পাঁচ দশক আগেও সৃষ্টিতত্ত¡বাদীদের সবচেয়ে বড় আবদার ছিলো যে কোনো একটা প্রাণির ফসিল দেখাতে হবে যেটা জল থেকে উঠে এসে ডাঙায় বাস করতে শুরু করেছিল বা ডাঙা থেকে জলে নেমে গিয়েছিল। এই দাবিতে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের বায়োকেমিস্ট, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও The Institute for Creation Research (ICR)-র কর্ণধার ডুয়ান গিশ। তিনি ছিলেন একজন সৃষ্টিতত্ত¡বাদী এবং এই বিষয়ের জনপ্রিয় পাবলিক স্পিকার। খেয়াল করে দেখুন বিবর্তন-অবিশ্বাসী বিজ্ঞানী বা স্কলারদের প্রায় সবার-ই আনুষ্ঠানিক সংশ্রব আছে এমন সব সংগঠনের সাথে যারা ঘোষিত ও খোলামেলাভাবে ক্রিয়েশনিজম প্রচার করে। ড. ডুয়ান গিশের লেখা একটা বইয়ের নাম Crusader, Creation Matters; অর্থাৎ বিবর্তনবাদের বিরোধিতা করা তাঁর কাছে ধর্মযুদ্ধের সমতুল্য। তাঁর একটি দাবি ছিলো- তিমি ও স্থলবাসী প্রাণিদের মধ্যবর্তী এমন কিছু ফসিল খুঁজে পাওয়া উচিত যারা পুরোপুরি জলচর বা স্থলচর কোনটা-ই নয়। তিনি মৎসকন্যার একটা কার্টুন আঁকেন, যার সামনের অংশ ছোপ ছোপ দাগওয়ালা গাভী ও পেছনের অংশ মাছ। সে সমুদ্রের পাড়ে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি বক্তৃতা করার সময় এই কার্টুনের স্লাইড দেখাতেন। এতে দর্শকদের মধ্যে হাসির রোল পড়ে যেতো। কিন্তু ১৯৭১ সালে সত্যি সত্যি এ’রকম একটা ট্রানজিশনাল ফসিলের সন্ধান পাওয়া গেলো। জীবাশ্মবিদ হ্যান্স থিয়ুইজেন ও তাঁর সহকর্মীরা ৪৮ মিলিয়ন বছর আগের ‘ইন্ডোহিউস’কে খুঁজে পেলেন ভারতের কাশ্মীরে। সে যে তিমির পূর্বপুরুষদের নিকটাত্মীয় ছিলো সেটার প্রমাণ পাওয়া গেলো তার হাড়ের ঘনত্ব ও দাঁত থেকে পাওয়া আইসোটোপ পরীক্ষায়। তিনি তখন বললেন, “বিবর্তন ঘটে ঈশ্বরের ইচ্ছা ও অনুমোদনে” (Dr. Duane Gish: Crusader, Creation Matters, fwjDj-1, c„. 260)। ভানু বন্দোপাধ্যায় চিত্তবিনোদনমূলক অবসর যাপনের জন্য গয়া যেতে চান। স্ত্রী চান কাশি যেতে। ঝগড়া চরমে উঠলে ভানু বিপদ আঁচ করে বললেন, “নিজের ইচ্ছায় কাশি যামু”। ব্যাপারটা কি সেরকম হলো?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ব্যাটল অব আল আমিন (অক্টোবর-নভেম্বর, ১৯৪২)-এ জেনারেল মন্টোগোমারির কাছে জার্মান জেনারেল রোমেল (যাকে ডেজার্ট ফক্স বলে ডাকা হয়) পরাজিত হন। ২০২১ সালের আগস্টে মিসরের পশ্চিমাঞ্চলের মরুভূমির একই জায়গায় (আল আমিন) তিমির একটি বিলুপ্ত প্রজাতির (ফিওমিসিটাস অ্যানুবিস) ফসিলের সন্ধান পাওয়া গেলো। ফিওমিসেটাস হলো প্রোটোসেটিড তিমির একটি প্রজাতি যা ৪৩ থেকে ৪২ মিলিয়ন বছর আগে উত্তর ও পশ্চিম আফ্রিকায় বাস করতো। এদের শক্তিশালী চোয়াল এবং বড় দাঁত ছিলো যা দিয়ে তারা বড় প্রাণিকে শিকার করতে এবং ছিঁড়ে ফেলতে পারতো। তিমির ডিএনএ বিশ্লেষণ ও কিছু নিষ্ক্রিয় অঙ্গের (আদি পেলভিস, শ্রোণিচক্র বা পেছনের পা) উপস্থিতি থেকে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়েছেন যে তাদের পূর্ব পুরুষরা এক সময় ডাঙায় বাস করতো। ডুয়ান গিশ ২০১৩ সালে মারা যান। ফলে তিনি দ্বিতীয়বার নিজের ইচ্ছায় কাশি যাওয়ার কথা বলে যেতে পারেননি।
বিভিন্ন পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে এখন দেখা গেছে যে পাখিরা এসেছে ডানাওয়ালা মাংসাশী থেরোপড ডাইনোসর থেকে। ডারউইন বিবর্তন তত্ত¡ নিয়ে কাজ শুরু করার আগেই জার্মানিতে পাওয়া গেছে আর্কিওপটেরিক্স (জার্মান ভাষায় ‘Urvogel’) এর ফসিল। এরা পাখির মতো ডাইনোসরের একটি প্রজাতি। বিবর্তনবাদীরা যখন বিভিন্ন গবেষণা, হিসেব নিকেশের পর দাবি করলেন, টেট্রাপোড এসেছে মাছ থেকে তখন বিরোধী মতের বিজ্ঞানীদের পক্ষ থেকে আবার সেই দাবি উঠলো— ‘ট্রানজিশনাল ফসিল দেখাও’। টেট্রাপোড হলো এক ধরণের বিলুপ্তপ্রায় উভচর মেরুদন্ডী প্রাণি। ২০০৬ সালে কানাডার আর্কটিক অঞ্চলের কঠিন পাললিক শিলায় ঢাকা পড়া মাছ এবং টেট্রাপডদের ট্রানজিশনাল ফসিলের (Tiktaalik) সন্ধান পাওয়া গেলো। এটি ছিলো তিন ফুট লম্বা, রে-ফিন মাছের মতো পাখাযুক্ত যার মাথাটা দেখতে অনেকটা কুমিরের মতো।
আলোচ্য ডকুমেন্টারিতে ঝঃবাবহ গবুবৎ কে করা ‘জীবনের নতুন ধরণ’ সম্পর্কে প্রশ্নটি খুব-ই জনপ্রিয়: কিছুটা হতবুদ্ধিকরও। প্রশ্নটির মূল কথা এ’রকম- বিবর্তনবাদের দাবি প্রথম প্রাণ সৃষ্টির ৫০ কোটি বছরের মধ্যে সংখ্যাতীত জলচর প্রাণি আবির্ভূত হয়ে সমুদ্রে ঘুরে বেড়াতে শুরু করে। পরবর্তী ৫০ কোটি বছরের মধ্যে তাদের কিছু প্রজাতি ডাঙায় উঠে এসে বৃহদাকার প্রাণ সৃষ্টির উৎসব শুরু করে দেয়। এদের কিছুসংখ্যক আবার জলে ফিরে যায়। ধরে নেওয়া হলো এক কোষী প্রাণি থেকে বিবর্তনের মাধ্যমে বহুকোষী প্রাণের উদ্ভব ঘটেছে। তাহলে তারা আকস্মিকভাবে লক্ষ লক্ষ প্রাণি ও উদ্ভিদ প্রজাতিতে রূপান্তরিত হলো কেনো? ক্যাকটাস, প্রজাপতি, হাতি, বিভিন্ন ধরণের শস্য, তেলাপোকা, তৃণ, বিটপ, কেঁচো, ডাইনোসর— এ’রকম মিলিয়ন মিলিয়ন প্রাণ-প্রজাতিতে রূপান্তরিত হবার জন্য মূল প্রাণে ডিএনএ-র পরিবর্তন হবার দরকার হয়েছে। অভিযোজন সত্য হয়ে থাকলে তো পৃথিবীতে একটি মাত্র প্রাণি প্রজাতি থাকার কথা! কারণ, আদি প্রাণ টিকে থাকার জন্য সবচেয়ে ভালো বিকল্পটি-ই বেছে নেবে- এটাই স্বাভাবিক। বৃষ্টির সময় হাতে ছাতা থাকলে কেউ তো আর সেটা বন্ধ রেখে হাঁটবে না! এদের মধ্যে কারো আবার উদ্ভিদ হতে ইচ্ছা করলো কেনো! টিকে থাকার জন্য তো নয়। তাহলে বৈচিত্র্য সৃষ্টির জন্য? এই প্রশ্নের উত্তর যদি ‘হ্যাঁ’বাচক হয় তাহলে ‘ন্যাচারাল সিলেকশন’ তত্ত¡ ভুল হয়ে যায় এবং বাইরে থেকে আসা বিচিত্র ইচ্ছার অনুগমন তত্ত¡ বা প্রকারন্তরে ঈশ্বরের অস্তিত্তে¡র ধারণা বহুগুণ বেড়ে যায়। যখন প্রশ্ন করা হচ্ছে ‘জীবনের নতুন ধরণ তৈরি হওয়ার প্রয়োজনীয়তা’ অণুজীবদের মধ্যে অনুভূত হয়েছিল কেনো, তখন এই প্রশ্নও করা যায় চেতনাহীন অজৈব অণুর মধ্যে জৈব অণু তৈরির, জৈব অণুর মধ্যে প্রাণ সৃষ্টির ইচ্ছা তৈরি হয়েছিল কেনো? আরও এক ধাপ পিছিয়ে জিজ্ঞেস করা যায়, সিঙ্গুলারিটির দশায় পরম শূন্যে মহাবিশ্ব সৃষ্টির ইচ্ছা কোথায় এবং কেনো উদ্ভূত হয়েছিল? এই ‘কেনো’গুলোর উত্তর নাই। কিছু দর্শনতাত্তি¡ক মতামত আছে। কিছু মতবাদে মহাবিশ্ব, প্রাণ ও প্রকৃতিকে ‘কারণ’ এর অবভাস মনে করা হয়। আবার কিছু দর্শনে এগুলোকে উদ্দেশ্যহীন ও অন্ধ (ব্লাইন্ড) মনে করা হয়। অতএব ‘কেনো’ খুঁজতে যাওয়া যতটা না বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা, তাঁর চেয়ে বেশি দার্শনিক জিজ্ঞাসা— প্রায়শ যার লক্ষ্য ঈশ্বরের অস্তিত্ত¡ প্রমাণ বা অপ্রমাণ করা।
এই ডকুমেন্টারিতে John Lennox দেহকোষ, শরীরের অঙ্গ, বা প্রাণের মেকানিক্যাল পারফরমেন্সের বর্ণনা দিয়ে বলেছেন যে এগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঘটা প্রায় অসম্ভব: কালাম কসমোলজিক্যাল আর্গুমেন্টের পুনারাবৃত্তি। একটা গাড়িতে গড়ে ৩২ হাজার যন্ত্রাংশ থাকে। এগুলোর কেবলমাত্র পরিকল্পিত ও নির্ভুল সংযোজন-ই গাড়িটাকে সচল করতে পারে। পরিণত অবস্থায় আমাদের দেহে গড়ে প্রায় ৩৭.২ ট্রিলিয়ন কোষ থাকে। কোষ প্রাচীর, সাইটোপ্লাজম, রাইবোজোম, ডিএনএ নিউক্লিওলয়েড, প্লাজমা আবরণী, মেসোজোমসহ আরও অনেক জৈব অণুর জটিল সংগঠন হলো একটা কোষ। এখানে যে মেকানিক্যাল পারফরমেন্স দেখা যায় তার অনেকখানি ব্যাখ্যা জীব বিজ্ঞানের হাতে আছে। কিন্তু এই ‘মেকানিক্যাল পারফরমেন্স’টা তৈরি হলো ‘কেনো’ তার ব্যাখ্যা নেই (দেখুন, আমরা আবার সেই ‘কেনো’তে ফিরলাম)। আন্ত:আণবিক বল তত্ত¡ অনুসারে তাপ প্রয়োগ করলে পদার্থের অণুগুলো গতিপ্রাপ্ত হয়ে ছোটাছুটি শুরু করে। অণুগুলোর মধ্যকার বন্ধনশক্তি শিথিল হয়ে যায় এবং পদার্থ স¤প্রসারিত হয়। এ’কারণে পানিকে তাপ প্রয়োগ করলে বাষ্পে পরিণত হয়। এই তত্ত¡ আবিষ্কারের আগে পদার্থের (এখানে পানির) অণুর গঠন সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের জানতে হয়েছে। মানুষ যখন আগুন জ্বালাতে শিখে পানি ফুটাতে শুরু করে তখন তারা আন্ত:আণবিক বল বুঝতো না। তারা এটাকে ঈশ্বরের কৃপা বা ইচ্ছা বলে মনে করতো। একইভাবে এখন আমরা যখন কোষের মেকানিক্যাল পারফরমেন্স বুঝতে পারি না তখন ভাবি এটা ঈশ্বরের ইচ্ছা। হতে পারে ঈশ্বরের ইচ্ছা; কিন্তু আমাদের ‘বুঝতে না পারা’ থেকে আমরা যদি এরকম সিদ্ধান্ত করে ফেলি সেটা যুক্তিযুক্ত হয় না; যেমন গুহা মানব আগুনে পানি ফোটার কারণ বুঝতে না পেরে সেটাকে ঈশ্বরের অতীন্দ্রিয় ইচ্ছা ভেবেছিল।
(এই নিবন্ধে) শুধু আলোচনায় অংশগ্রহণকারীদের যুক্তি বিষয়ে কথা বলাটা বেশি কাঙ্ক্ষিত ছিলো। কিন্তু শুরুতে তাঁদের পরিচয় বর্ণনা করতে বিরক্তিকরভাবে আমি অনেকটা স্পেস ব্যয় করেছি এটা বুঝাতে যে বিবর্তনবাদের বিরোধিতা এখনও টিকে থাকার মূল কারণ ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি আনুগত্য বা সহমর্মিতা। তাঁরা জানতে চান ‘কেনো এমন ঘটলো’। উত্তর না পাওয়া গেলে বলেন, ‘যেহেতু আপনি জানেন না; তাই ঈশ্বর আছেন এবং তিনি-ই এটা করেছেন’। এটা ঈশ্বরের অস্তিত্তে¡র প্রমাণ নয়; বড়জোর একটা শক্তিশালী অনুমান। ঘটনাপ্রবাহকে ‘কেনো’ দিয়ে প্রশ্ন করতে থাকলে অনন্ত অতীত পর্যন্ত যাওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। এমনও তো হতে পারে, মহাজগৎ হয়তো অনন্ত— এর কোনো শুরু ছিলনা; শেষও থাকবে না। ভৌত-অস্তিত্ত¡পূর্ণ (অ-ভৌতও হতে পারে), উদ্দেশ্যশূন্য, স্থানিকভাবে অর্থপূর্ণ একটা জগতে আমরা উদ্গত ও বিলীন হই। আমরা সহ অন্য সকল প্রাণি ও উদ্ভিদ উদ্দেশ্যহীন ও নিসর্গজ। আমরা আমাদের মস্তিষ্কের জৈব-রাসায়নিক প্রবাহ ছাড়া হয়তো কিছু নই। একটা আনআইডিন্টিফাইড ন্যাচারাল ল’ (Heinrich Rommen, The Natural Law: A Studz in Legal and Social Philosophy) প্রকৃতিতে বিরাজ করে যা অসীম বুদ্ধিমান ও অন্ধ; যেমন অসীম বুদ্ধিমান ও অন্ধ আমাদের দেহকোষ, লাউ গাছের আকর্ষী, ক্লোরোফিল বা একটা এন্টাংগেলড সাব এটমিক পার্টিকেল। প্রাণের মেকানিক্যাল পারফরমেন্সের সূত্র প্রকৃতিতে স্বতঃপ্রবৃত্তভাবে বিরাজ করে। আমাকে যিনি আলোচ্য ডকুমেন্টারিটি পাঠিয়েছেন তাঁর ধারণা, সৃষ্টিকর্তা হয়তো আমাদের জানা ৪টি ডাইমেনশনের বাইরের এমন একটা ডাইমেনশনে অস্তিত্ত¡ময় যা এই চারটিকে-ই ধারণ করে। আমাদের ফোর ডাইমেনশনাল রেফারেন্স ফ্রেম থেকে সৃষ্টিকর্তার ডাইমেনশন উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। ফলে প্রকৃত সত্যের কোনকিছু জানাও সম্ভব নয়— ততটুকু ব্যতীত, যতটুকু তিনি জানতে দিতে ইচ্ছা করেন।
hassangorkii@yahoo.com
রয়্যাল রোডস ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া, ব্রিটিশ কলম্বিয়া, কানাডা