হাসান গোর্কি : শিরোনামের বাক্যটিতে প্রশ্নবোধক চিহ্ন বসালে তার উত্তর হবে— “না”। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার একটা সংজ্ঞা এ’রকম “এটি একটি পদ্ধতিতে সংরক্ষিত তথ্যের বহির্ভূত তথ্য সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারার ক্ষমতা এবং সেই তথ্য থেকে শিক্ষা গ্রহণ ও ঐ শিক্ষা ব্যবহার করে নমনীয় অভিযোজনের মাধ্যমে বিশেষ লক্ষ্য অর্জন করা”(আন্দ্রেয়ার কাপলান এবং মাইকেল হেনলিন)। সহজ কথায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তৈরির ক্ষেত্রে কম্পিউটারের তথ্য ভান্ডারকে অনুকরণমূলক জ্ঞানীয় এককে (মিমিকেটিভ কগনেটিভ উইনিট) রূপ দেওয়া হয় যাতে করে সে মানুষের মত ভাবতে পারে। সংক্ষেপে বুদ্ধিমত্তার আভিধানিক সংজ্ঞা হলো, “জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন ও ব্যবহারের ক্ষমতা।” মনোবিজ্ঞানের দেওয়া সংজ্ঞাও এর কাছাকাছি “বুদ্ধিমত্তা হলো, তথ্য আহরণ, অভিজ্ঞতা থেকে শেখা, প্রতিক‚লতার সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়া, অনুধাবন করা এবং চিন্তাকে কারণসঙ্গতভাবে ব্যবহার করার ক্ষমতা।” ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’ আসলে সখ করে দেওয়া একটা অভিধা। যেমন, শের-ই-বাংলা ফজলুল হককে ‘বাংলার বাঘ’ বলা হয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিজে তথ্য আহরণ করতে পারে না। সে তার নিজের অস্তিত্ব অনুধাবন করে না। সে কোথায় আছে বা আদৌ আছে কিনা সেটা সে জানে না। ফলে তথ্য আহরণের আকাঙ্ক্ষা ধারণ করার সুযোগ তার নেই। তার অসহায়ত্বের কথা একবার চোখ বন্ধ করে ভেবে দেখুন, নিজের-ই দম বন্ধ লাগবে। অভিজ্ঞতা থেকে সে ততটুকুই শেখে প্রোগ্রামার যতটুকু তাকে শিখতে বলে দেন। যেমন, পাঁচ জন ব্যবহারকারী যদি ‘schedule’ শব্দের পাঁচ রকম উচ্চারণ করেন তাহলে সে সেটা মনে রাখবে।
প্রতিক‚লতার সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রেও একই কথা— পরিবর্তিত সম্ভাব্য যে অবস্থাগুলো মোকাবিলা করার তথ্য ও দক্ষতা তার মধ্যে আরোপ করা হয় তার বাইরের কোনো পরিস্থিতিতে পড়লে সে প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে না। ধরুন, আপনি একটা ফুটবলার রোবট কিনে এনেছেন। সে জানে কীভাবে প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডারকে ডজ দিতে হয়, গোলরক্ষককে ফাঁকি দিয়ে গোল করতে হয়, আছাড় খেলে কীভাবে উঠে দাঁড়াতে হয়। ধরুন আপনার মহল্লার মাঠে সে একটা উত্তেজনাপূর্ণ ম্যাচ খেলছে। মাঝপথে আপনি তাকে কোলে তুলে নিয়ে বাড়ি রওনা দিলেন। এক্ষেত্রে সে বোকা হয়ে যাবে। আপনার কোলে চড়েও সে বল খুঁজতে থাকবে। কিন্তু পাঁচ বছর বয়সী আপনার পুত্রের ক্ষেত্রে এ’রকম ঘটলে সে কান্নাকাটি করে কোল থেকে নেমে যেতো। বুদ্ধিমত্তার পূর্বশর্ত ‘জ্ঞান’। জ্ঞান হলো, কোনো বিষয়ে অভিজ্ঞতা বা অধ্যয়নের মাধ্যমে অর্জিত তথ্য ও অনুধাবন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় যে জ্ঞান থাকে তার খুব কম অংশ-ই সে ‘অভিজ্ঞতা বা অধ্যয়নের’ মাধ্যমে অর্জন করে।
সংজ্ঞা অনুযায়ী ক্যালকুলেটর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নয়; কারণ সে তার ভান্ডারে রক্ষিত তথ্যকে কোনো বাছ-বিচার ছাড়াই সরাসরি পুনরুত্পাদন করে। আমরা যখন ৯৯৯ কে ৯৯৯ দিয়ে গুণ করার জন্য বোতাম চাপি তখন ক্যালকুলেটরে জমা থাকা গাণিতিক পরিভাষা বা কলনবিধি (এলগোরিদম) স্বয়ংক্রিয়ভাবে একটিই ফলাফল উত্পাদন করে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এ’রকম কিছু প্রোগ্রামের সমন্বয় যেখানে বিকল্প ফলাফল থাকে এবং সর্বোত্তমটি বেছে নেওয়ার ক্ষমতা থাকে। ফলে তাকে কিছুটা মানুষের মতো লাগে। আমরা যদি গুগল ম্যাপে কোনো রেস্টুরেন্টের অবস্থান খুঁজি তাহলে সে যাত্রা শুরুর স্থান থেকে গন্তব্য পর্যন্ত রেখা এঁকে যাত্রা পথটি বলে দেবে। এটা ক্যালকুলেটরের কলনবিধি প্রয়োগের চেয়ে কিছুটা অগ্রসর প্রযুক্তি। রাস্তায় জ্যাম থাকলে গুগল আপনাকে বিকল্প পথ বলে দেবে। রেস্টুরেন্ট বন্ধ থাকলে সেটাও বলে দেবে “Closed, will open at 9:30, Monday”। গুগল এসিস্ট্যান্টের সাথে যদি কিছু সময় আপনার সুখ-দুঃখের আলাপ করে থাকেন তাহলে আপনার পছন্দ-অপছন্দের কথা সে মনে রাখবে। কোনো এক সন্ধ্যায় আপনি তাকে বললেন, “আমার মন খারাপ। এখন কী করতে পারি।” আপনাকে সে বাড়ির পাশের কফি শপে (যেখানে আপনি প্রায়-ই যান বলে সে জানে) যেতে বলতে পারে, সিনেমা দেখতে যেতে বলতে পারে। আবার একই প্রশ্ন যদি তাকে আপনি মাঝরাতে করেন তাহলে সে বন্ধুর সাথে ফোনে কথা বলার পরামর্শ দিতে পারে বা নজরুল সঙ্গীত শুনতে বলতে পারে; কারণ সে জানে এই নিশুতি রাতে সিনেমা হল এবং রেস্টুরেন্ট বন্ধ আছে এবং নজরুল সঙ্গীত শোনা ও বন্ধুর সাথে কথা বলা আপনার প্রিয় বিষয়। গুগল এসিস্ট্যান্ট কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার একটা উদাহরণ।
খেয়াল করে দেখুন, তাকে বস্তুত অনেকগুলো ক্যালকুলেটর জোড়া দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। তাকে মানুষের মতো মনে হয় এ’কারণে যে তার ভান্ডারে জিজ্ঞাসার কিছু বিকল্প ফলাফল আছে এবং সবচেয়ে প্রাসঙ্গিকটি বেছে নেওয়ার ক্ষমতা আছে। কিন্তু তার ক্ষমতাটি যেহেতু স্বাধীন নয় তাই তাকে বুদ্ধিমত্তা বলা এক ধরণের আদিখ্যেতা। বিজ্ঞানীরা এইটুকু তাড়ান্থড়া বা হড়বড়ির অধিকার রাখেন; কারণ, তারা যা করতে পেরেছেন সেটাও বিস্ময়কর কিছু।
১৯৯৭ সালে আইবিএমের সুপার কম্পিউটার ‘ডিপ বøæ’ যখন দাবা খেলায় বিশ্বচ্যাম্পিয়ন গ্যারি কাসপারভকে হারিয়ে দেয় তখন-ই অনেকে অনুমান করেছিলেন যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারিক জগতে শীঘ্রই বড় পরিবর্তন নিয়ে আসবে। প্রায় ২৫০০ বছর আগে চীনে উদ্ভাবিত এড় (ডল্করয়ল্প-ষ্টীঁল্ড) নামের একটা জটিল বোর্ড গেম এখনও চালু আছে। কিছুদিন আগে এর ডিজিটাল ভার্সন চালু হয়েছে। প্রাচীনকালে অভিজাত চীনা পণ্ডিতদের অপরিহার্য পছন্দ ছিলো এই খেলাটি। একটা বর্গাকার কাঠের বোর্ডে (‘গোবান’) ১৯টি উল্লম্ব এবং ১৯ টি অনুভূমিক রেখা দিয়ে ৩২৪টি ঘর এবং ৩৬১টি ছেদ তৈরি করা হয়। ১৮১টি কালো এবং ১৮০ টি সাদা গো-ইশি (সমতল, বৃত্তাকার পাথর) ছেদগুলোর ওপর স্থাপন করা হয়। এরপর কোনো একটা পাথরকে প্রতিপক্ষ যদি তার পাথর দিয়ে চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলতে পারে তাহলে ঐ পাথরটি বোর্ডের বাইরে চলে যায়। খেলার নিয়মটি সহজ। কিন্তু চাল দেওয়ার ক্ষেত্রে মোট বিকল্পের সংখ্যা অকল্পনীয় ২.১ x ১০১৭০ — যা পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বের পরমাণুর সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি। দাবার মতো অঙ্ক কষে বা পুরোনো চাল জেনে এই খেলায় জেতা যায় না এর চালের অগণিত বিকল্প ও বৈচিত্র্যের কারণে।
২০১০ সালে কয়েকজন কেমব্রিজ গ্র্যাজুয়েট নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান ‘ডিপমাইন্ড’-র তৈরি কম্পিউটার প্রোগ্রাম আলফাগো, এড় খেলায় বিশ্বচ্যাম্পিয়ন লি সিডলকে হারিয়ে দেয়। এই অভাবনীয় সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে আরও ব্যবহারিক করতে উঠে পড়ে লাগে। এর সর্ব-সা¤প্রতিক ফলাফল চ্যাটজিপিটির উদ্ভাবন। সে প্রবন্ধ, ছড়া, গান, কৌতুক, নাটক, গবেষণা প্রস্তাব লিখে দিতে পারে। “Hot dogs should be given plenty of water” এবং “Hot dogs should be eaten with mustard” এই বাক্য দু’টিতে হট ডগের ভিন্ন অর্থে ব্যবহার সনাক্ত করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ClarkesworlD ম্যাগাজিন গত সপ্তাহে অপরিচিত লেখকদের কাছে থেকে ৫০০টি সায়েন্স ফিকশন ও ফ্যান্টাসি গল্প পাবার পর এই বিষয়ের লেখা জমা নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। কারণ, এগুলো চ্যাটজিপিটির কাছে লিখে নেওয়া। আগে প্রতি মাসে গড়ে লেখা জমা পড়তো ২০টির মতো। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এখন-ই অনেক শক্তিশালী। এটি আরও অনেকদূর যাবে তাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু মানব মস্তিষ্কের সমান হতে এখনও তাকে বহু পথ পাড়ি দিতে হবে।
যখন কাজগুলিকে ভাগ করে দেওয়া হয় তখন কম্পিউটার মানব মস্তিষ্কের চেয়ে অনেক শক্তিশালী। যেমন ৯৬৮৭৫ কে ৪৫৩২৬ দিয়ে গুণ করতে দিলে কম্পিউটার নিমিষে-ই তার ফলাফল (৪৩৯০৯৫৬২৫০) বের করে ফেলবে। একজন মানুষের পক্ষে সেটা করা অনেক সময় সাপেক্ষ। কিন্তু মানব মস্তিষ্ক শুধু গণনা করে না। আবেগ, অনুভূতি, ক্ষোভ, দুঃখ, তাপমাত্রা, সূর্যালোক, নদী, সমদ্র, পাখি, প্রতিবেশী, ঘুম, হাঁটা— এ’রকম কয়েক মিলিয়ন বিষয়ে তথ্য সংরক্ষিত থাকে মস্তিষ্কে। শুধু তা-ই নয়; এই তথ্যগুলোর মধ্যে আন্তঃযোগাযোগও থাকে। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মস্তিষ্কে প্রায় ৮৬ বিলিয়ন নিউরন থাকে, এবং সেই সমস্ত নিউরন ট্রিলিয়ন সংখ্যক সিন্যাপ্স বা সংযোগ সূত্র (প্রবর্ধক) ও গিøয়াল কোষ দ্বারা সংযুক্ত। ফলে কোষগুলো তথ্যের সঞ্চয়, উপলব্ধি, ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ বিতরণ করতে পারে। মস্তিষ্ক একই সাথে হার্ডওয়্যার এবং সফটঅয়্যার হিসেবে কাজ করে।
ডিজিটাল সিলিকন-ভিত্তিক কম্পিউটারের সাথে মস্তিষ্কের তুলনা করা কঠিন; কারণ মস্তিষ্ক কীভাবে কাজ করে তা এখনও অনেকটা অজানা। যদি ডিজিটাল বৈদ্যুতিক পালস (অ্যাকশন পটেনশিয়াল) সংখ্যাকে গননায় নেওয়া হয় তাহলে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মস্তিষ্ক সেকেন্ডে প্রায় এক হাজার ট্রিলিয়ন ডাটা সঞ্চালন করে। একটা রোবোটের মাথায় যদি এই পরিমাণ ডাটা ঢুকানো হয় তাহলে তার আকার হবে ২০০০ বর্গ মিটার দৈর্ঘ্য-প্রস্থে ১২ তলা বিল্ডিঙের সমান। ধরে নেওয়া যাক, এই আকৃতির মাথা নিয়ে একটা রোবট ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে কি মানবীয় সকল বৈশিষ্ট্য ধারণ করবে? আমরা যারা বিশ্বাস করি যে ঈশ্বর পরিকল্পনা করে নিজ হাতে প্রাণিদের (বিশেষ করে মানুষ) তৈরি করেছেন তারা এই প্রশ্নে খুশি হবো। কারণ, উত্তরটা যে “না” হবে সেটা আগেই অনুমান করা গেছে। প্রথম কথা হলো সকল ধরণের আবেগ-অনুভূতি, হিসাব- নিকাশ, বিচারবুদ্ধি, কর্মদক্ষতা, সংবেদন, প্রেরণা- প্রণোদনা মানুষের সমান হওয়া সত্তে¡ও ঐ রোবটটি জানবে না যে তার অস্তিত্ত¡ আছে কিনা। কারো মৃত্যু দেখলে সে কষ্ট পাবে, শব্দ করে কাঁদবে। ব্যবস্থা থাকলে কপোলপ্লাবী অশ্রুও ঝরবে তার কৃত্রিম আঁখি যুগল থেকে। কিন্তু সে জানবে না যে সে কষ্ট পাচ্ছে এবং কাঁদছে। ফলাফলটা আমরা এ’রকম-ই দেখতে চেয়েছিলাম। কারণ এতে প্রমানিত হয় যে আত্মা বলে কিছু একটা আছে যা ঈশ্বর প্রাণিদের মধ্যে দিয়ে দেন।
এই সিদ্ধান্তে বড় একটা অসঙ্গতি বা স্ববিরোধ আছে। এখানে আমরা দুটি অসম বস্তুর তুলনা করেছি। মানুষের মস্তিষ্ক একটা জৈব সংগঠন। আর রোবটের মস্তিষ্ক একটা সিলিকন ডিস্কে অজৈব অণুর বিন্যাস। প্রাণিদের (উদ্ভিদেরও) চৈতন্যের মূলে আছে তাদের ডিএনএ-তে জৈব অণুর দীর্ঘ ও কার্যকারণ তাড়িত বিন্যাস। এই জটিল সংগঠনের পেছনে কাজ করে প্রকৃতিতে ছড়িয়ে থাকা সর্বব্যাপ্ত রাসায়নিক আসক্তি। এখন যদি প্রশ্ন করা হয় এই রাসায়নিক আসক্তি প্রকৃতিতে আছে কেনো? এ প্রশ্নের উত্তর নেই। যেমন উত্তর নেই ‘মহাবিশ্ব আছে কেনো’। পদার্থবিজ্ঞানী ডোনাল্ড লুটারমোজার মনে করেন জৈব যৌগের আনবিক সংশ্লেষণ জটিলতর হওয়ার ধাপে ধাপে প্রাণ সৃষ্টি হয়।
প্রাচীন বৈদিক ও সুমেরীয় দর্শনে পৃথিবীকে একটি জীবিত উপাদান হিসেবে মনে করা হতো। স্কটিশ বিজ্ঞানী জেমস হিউটন আঠারো শতকের শেষের দিকে পৃথিবীকে একটা সুপারঅর্গানিজম বলে মত প্রকাশ করেছিলেন।
জেমস লাভলক প্রস্তাব করেন, “পৃথিবীর সকল জীবিত প্রাণ একসাথে একটি একক জীব হিসাবে কাজ করে যা তার বেঁচে থাকার জন্য পরিবেশগত শর্তাবলীকে নির্ধারণ করে এবং রক্ষণাবেক্ষণ করে” (James Lovelock, Gaia: A New Look at Life on Earth, Oxford University Press)। ১৯৯২ সালে হ্যারল্ড জে. মোরোভিটজ তাঁর Beginnings of cellular life: metabolism recapitulates biogenesis বইয়ে দাবি করেন, “জীবন কোন একক অণূজীব কিংবা কোন প্রজাতি নয় বরং এটি হল বাস্তুতন্ত্রের একটি বৈশিষ্ট্য।” অর্থাৎ জীববিজ্ঞানী ও পদার্থবিজ্ঞানীদের (প্রায়) কেউ-ই ‘প্রাণ’কে কোনো অতীন্দ্রিয় সত্ত¡া মনে করেননি। প্রাণ সৃষ্টির কারণ ও প্রণোদনা বিষয়ে ঐক্যমত্য থাকলেও শুরুর প্রক্রিয়াটি তাদের কাছেও অস্পষ্ট। এব্যাপারে বাংলায় তৈরি করা এই দুটি ইউটিউব ভিডিওতে মোটামুটি একটা বোধগম্য ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে। যারা পত্রিকার ছাপা কপি পড়বেন তারা শিরোনাম লিখে সার্চ করলেও ভিডিও দুটি পেয়ে যাবেন: Origin of life on Earth || Part 1: https://www.youtube.com/watch?v=BBpOhUODOqc
Origin of life on Earth || Part 2: https://www.youtube.com/watch?v=aDinv1yP4T0
আর একবার শিরোনামে ফেরা যাক: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কি মানুষের স্থান নেবে? আমার ধারণা উপরের আলোচনা থেকে এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেছে। ‘প্রাণ’ এমন একটা জটিল সংগঠন যে তাকে সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। প্রকৃতিতে থাকা পারস্পরিক আসক্তি সম্পন্ন জৈব অণুর স্বতঃপ্রবৃত্ত সন্মিলন ছাড়া প্রাণ সৃষ্টির কারণ তৈরি হবে না। আর এ কাজটি গবেষণাগারে করা প্রায় অসম্ভব একটা কাজ। তাই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কখনও মানুষের স্থান নিতে পারবে না।
পুরনো প্রসঙ্গ: এই অণুচ্ছেদটি পড়ার আগে আপনি যদি উপরের দুটি ভিডিয়ো (বানান ঠিক আছে) দেখে নেন তাহলে তা কিছু অর্থ বহন করতে পারে। যারা “ঈশ্বর-তত্ত¡ ও লজিক্যাল ফ্যালাসি” (সহস্র বিস্মৃতিরাশি-১৪) পড়েছেন সাহারা মরুভূমিতে ‘আমি’ ও ‘আপনি’ নামে দু’জনের কথোপকথন তাদের মনে থাকার কথা। সেখানে আমার যুক্তি ছিলো, চন্দ্রালোক বিচ্ছুরণ, সূর্যোদয়, বাত্যাপ্রবাহ, অঙ্কুরোদগম, ধূলিঝড়, শিশু বৃক্ষের বেড়ে ওঠা- এসব কেনো ঘটছে তা যেহেতু আমরা জানি না তাই বিশ্বাস করতে হবে যে এর পেছনে অদৃশ্য কোনো শক্তি আছে। একইরকম যুক্তিতে আবার আমি বলতে পারি “বিজ্ঞান প্রাণ সৃষ্টি করতে পারেনি; এমনকি সৃষ্টি প্রক্রিয়াটা নিখুঁতভাবে ব্যাখ্যাও করতে পারেনি, তাই ঈশ্বর-ই এটা করেছেন।” এর পৃষ্ঠে আপনার যুক্তি হতে পারে, “আমি জানি না ভূমিকম্প কেনো হয়। তাহলে কি আমি ধরে নেবো দেবতা পসিডন যখন রাগ হয়ে মাটিতে গুড়ি দেন তখন ভূমিকম্প হয়? প্রকৃতিতে প্রাণ সৃষ্টির স্বতঃপ্রবৃত্ত ও স্বত:স্ফূর্ত প্রবণতার কমপক্ষে আধাআধি সাক্ষ্য বা নিদর্শন আছে। অন্যদিকে ঈশ্বরের ভূমিকা পুরোটাই বিশ্বাস নির্ভর।”
সৃষ্টিতত্ত¡ নাকি সর্বপ্রাণবাদ—এ দুয়ের মধ্যে কোনটি আমরা বেছে নেবো?” ড. ইচক দুয়েন্দের টিয়াদুর-এ আমরা একটা চেতনা-ঋদ্ধ, বাঙময় প্রকৃতির দেখা পাই। প্রাণি, উদ্ভিদ, বস্তু, নক্ষত্রনিচয়, টেবিল, পেয়ালা, নদী এমনকি অদৃশ্য ধারণাসকল পরস্পর কথা বলে; এক অদ্ভুত সর্বব্যাপ্ত চৈতন্যপ্রবাহে লীন হয় এবং সিদ্ধার্থের মতো ঈশ্বর-নিরীশ্বরের বাইরে এক ওঁ ধ্বনিতে মহাপ্রাণের অখণ্ড অস্তিত্তে¡র অর্থ তৈরি করে। ভাইয়ের আকস্মিক মৃত্যুর শোক কাটাতে যুক্তরাষ্ট্রের কানসাসের এক অখ্যাত কবি ক্লেয়ার হার্নার সর্বপ্রাণবাদ (হয়তো নিজের অজ্ঞাতে) বেছে নিয়েছিলেন। একটি কবিতা (Do Not Stand at My Grave and Weep) লিখে তিনি জিপসি ম্যাগাজিনের ডিসেম্বর, ১৯৩২ সংখ্যায় পাঠিয়েছিলেন। এই একটি মাত্র কবিতা ছাপা হবার পর মানুষের মুখে মুখে তা ছড়িয়ে পড়েছিল। কানসাস ও মিসৌরি অঙ্গরাজ্যে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় এক সময় কবিতাটি আবৃত্তি করা হতো। এই অভাজনের অক্ষম অনুবাদ:
আমার কবরের পাশে দাঁড়াবে না
ক্লেয়ার হার্নার
দাঁড়াবে না ক্রন্দশী, আমার কবরের পাশে
আমি তো সেখানে নেইÑ নির্ঘুম অবিলয় নিঃশ্বাসে
আমি সে হাজার বাতাস- অনিবার বয়ে যাই
হীরক তুষার ঝলক: অনিমেষ চারিদিকে চাই
আমার কবরের পাশে দাঁড়াবে না অশ্রুসিক্ত তুমি
আমি তো সেখানে নেই- জুড়ে আছি শ্যামলিমা, বনভূমি
আমি স্বর্ণাভ শস্যের শিরে সিত-শুক্ল সূর্যালোক
আমি মৃদু শরতের বৃষ্টি, মেঘময় প্রশান্ত-শোক
প্রদোষের স্তব্ধতা ভেংগে জেগে উঠি অবিনাশী পাখি
নীড়ের সীমানা থেকে অতি দূর মেলে ধরি সুগভীর আঁখি
অতিক্রান্ত অন্ধকারের পর আমি জ্যোতির্ময় জ্যোত্স্নার দিন
জেগে আছি জলাশয়ে, কিশলয়ে, গুল্মে তৃনে লীন
দাঁড়াবে না বিষণ্ণ কেউ আমার এ সমাধির প্রাচীর ছুঁয়ে
এইখানে আমি নেই — আমাকেই ঘিরে আছে আকাশেরা, নুয়ে।
hassangorkii@yahoo.com
রয়্যাল রোডস ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া, ব্রিটিশ কলম্বিয়া, কানাডা