হাসান গোর্কি : আমার বন্ধুদের একটা ম্যাসেঞ্জার গ্রুপ আছে। সেখানে খুলনা থেকে বেলায়েত একটা ধাঁধা পোস্ট করে সমাধানও দিয়েছে:
ধাঁধা: প্রমাণ কর যে, ২+২=৫
সমাধান: আমরা জানি, ০ = ০ বা, ২০-২০=২৫-২৫ বা, (৪×৫)-(৪×৫)=(৫×৫)-(৫×৫) বা, ৪(৫-৫)=৫(৫-৫)। ধরি, (৫-৫)=a বা, ৪a=৫a বা ৪=৫ (উভয় পক্ষ থেকে ধ বাদ দিয়ে) বা, ২+২=৫ (প্রমাণিত)।

ভুলটা যেখানে হয়েছে: শূন্য দিয়ে কোনো রাশিকে গুণ করলে সেটা সকল মান হারায়। যখন ধরা হলো (৫-৫)=a (বা ০=a) তখন ধ-র মান দাঁড়ালো ০। সেক্ষেত্রে ৪a= ৫a বা ০=০। a-র ধনাত্মক বা ঋণাত্মক কোনো মান থাকলেই কেবল সমীকরণের উভয় দিক থেকে a বাদ দেওয়া সিদ্ধ হবে। a-র মান শূন্য বলে উভয় দিক থেকে তা বাদ দেওয়া গাণিতিক ভুল। অঙ্ক হিসেবে শূন্যের (‘০’) সাথে অন্যদের পার্থক্য হলো, সে পূর্ণসংখ্যার সেট সদস্য এবং অ-ঋণাত্মক পূর্ণসংখ্যার সেট সদস্য। সহজ ভাবে বলা যায় শূন্য হচ্ছে- ১ এবং ১ এর মধ্যবর্তী একটি অনির্ণেয় মানসম্পন্ন সংখ্যা। সমীকরণে তার ভূমিকা ম্যাচের কাঠির মতো। একটা কাঠি জ্বালিয়ে এক টুকরো কাগজ পুড়িয়ে ফেলা যেতে পারে; আবার ৫০টি গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রি পুড়িয়ে ফেলা যেতে পারে। দগ্ধ হবার পর গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি এবং কাগজের টুকরা- উভয়ের মান শূন্য হবে। কিন্তু তাদের প্রকৃত মানে যে বিশাল পার্থক্য ছিল সেটা আর উদ্ধার করা যাবে না। তাই শূন্য দিয়ে কোনো রাশিকে গুণ করলে তার আদি মান বিলুপ্ত হবে। ফলে গুণ করার পরে সবসময়-ই একটা ভুল রাশি পাওয়া যাবে। এই কপট কৌশল (ট্রিক) ব্যবহার করে বেলায়েত প্রমাণ করে ছেড়েছে ২+২=৫। এটা একটা নিউমেরিক্যাল ফ্যালাসি।

ফ্যালাসি শব্দের বাংলা হেত্বাভাস বা কু-তর্ক। এটা এমন যুক্তি যা আপাতদৃষ্টিতে সমর্থনযোগ্য বলে মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে সঠিক নয়। খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতকের শেষ দিকে গ্রীসে এক ধরণের পেশাদার শিক্ষকের আবির্ভাব ঘটেছিল যারা অভিজাত স¤প্রদায়কে সদগুণ বা উৎকৃষ্ট নৈতিক মূল্যবোধ (গ্রীক ভাষায় “আরেতে”) শিক্ষা দিতেন। এঁদের বলা হতো সোফিস্তেস; ইংরেজিতে সোফিস্ট। পন্ডিত হলেও তাঁদের কোনো সুসংহত দার্শনিক চিন্তা ছিলো না। মূলত প্রচলিত মতবাদসমূহের অসংগতি তুলে ধরে তাঁরা জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলেন। তবে পরবর্তীতে সক্রেটিস ও প্লেটো সোফিস্টদের কাজকে জ্ঞানের প্রতারণামূলক ও চাতুর্যপূর্ণ প্রয়োগ বলে মনে করেছেন। বর্তমানে সোফিস্ট বলতে ক‚টতার্কিদের বুঝানো হয়, যারা আপাতদৃষ্টিতে যুক্তিযুক্ত কিন্তু আসলে ভ্রান্ত- চতুরতাপূর্ণ যুক্তির মাধ্যমে মানুষকে বিভ্রান্ত করেন। এটা অনেকটা গালির মতো, যেমন, আমাদের দেশের গ্রামাঞ্চলে ‘কমুনিস্ট’ ‘ইহুদি-নাসারা’ এখনও একটা গালি। আসলে সোফিস্টদের যুক্তিগুলো ক‚টতর্ক হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল একারণে যে সেগুলো প্রায়শ প্রচলিত ধারণার বিপরীত ছিলো; বিশেষ করে এগুলো ঈশ্বরের অস্তিত্তে¡র ব্যাপারে সংশয় প্রকাশ করেছিলো। সবচেয়ে প্রাচীন সোফিস্ট হিসেবে যার নাম জানা যায় তিনি হলেন প্রেটেগোরাস। ৪৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এবডেরায় তাঁর জন্ম। তিনি এথেন্সে এসে পেরিক্লিসের সান্নিধ্য ও অনুগ্রহ লাভ করেন। সেসময় প্রকাশিত তাঁর বই On the Gods-এ তিনি লেখেন, “দেবতারা আছেন কি নেই, আমি বলতে অক্ষম”। এতে সবাই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। তাঁর বিরুদ্ধে ঈশ্বরনিন্দার অভিযোগ আনা হয়। গ্রেফতার হবার আগেই তিনি পালিয়ে যান এবং খ্রিস্টপূর্ব ৪১০ অব্দে গালফ অব কোরিয়ান্থে নৌকা ডুবিতে মারা যান।
নৈতিকতার মূল্য সম্পর্কে প্লেটোর অভিমত হলো, নৈতিক অবধারণ আপেক্ষিক; কেননা নৈতিক অভিমতের ক্ষেত্রে সত্য বা মিথ্যা হবার প্রশ্ন দেখা না দিলেও, কোনো অভিমত অন্য অভিমতের তুলনায় বেশি উপযোগী হতে পারে। কাজেই কেউ ভ্রান্তভাবে চিন্তা করে না, এ কথা যেমন সত্য, আবার তেমনি কোনো কোনো ব্যক্তি অপর ব্যক্তির তুলনায় অধিকতর জ্ঞানী হতে পারে, এ কথাও সত্য ‘(Theaetetus’)। অন্যদিকে প্লেটোর ডায়ালগ থেকে জানা যায় (প্রেটেগোরাসের On the Gods এর হাতে লেখা একটা কপি-ই ছিল যেটা হাটে লোক জড়ো করে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল) প্রেটেগোরাস মনে করতেন, “পরম ধর্ম, নৈতিকতা, এবং ন্যায়পরায়ণতা বলে কিছুই নেই। সংবিধান, প্রণীত আইন, ভাষ্য, নির্দেশনাসমূহ ধর্মীয় ধারণার মতই আপেক্ষিক। কোনো নিয়মই অপরটির চেয়ে বেশি সত্য নয়।” খেয়াল করে দেখুন নৈতিকতার অবধারণ বিষয়ে প্লেটোর সাথে প্রেটেগোরাসের মতের পার্থক্য থাকলেও প্রেটেগোরাসের মতকে ‘ক‚টতর্ক’ বলা চলে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি জয়ী হলে হয়তো হিটলার বিশ্বের মহান অধিপতি হিসেবে আবির্ভূত হতেন। সোফিস্টরা জ্ঞানের যুদ্ধে জয়ী হলে মুক্তবুদ্ধির চর্চার জন্য পঞ্চদশ শতাব্দী (রেনেসাঁ) পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো না। রেনেসাঁর বৌদ্ধিক ভিত্তি ছিল রোমান হিউমিনিটাস ও ক্লাসিক্যাল গ্রিক দর্শন। প্রোটাগোরাস বলেছিলেন যে “মানুষই সমস্ত কিছুর পরিমাপ”। রেনেসাঁর মূল কথাও তা-ই। আমরা খেয়াল করলে দেখবো, ১৭ শতকের পরের প্রায় সব বড় দার্শনিক- বেকন, জন লক, স্পিনোজা, রুশো, কান্ট, বাক্র্লি, নীটশে, বারট্রান্ড রাসেল, কার্ল পপার, স্টিফেন হকিং (যদি আপনি তাকে দার্শনিক মানেন), কার্ল সেগান- সবাই এরকম একটা মহাজগতে কমবেশি বিশ্বাস করেছেন যা স্বতঃপ্রবৃত্তভাবে উদ্ভূত এবং বহমান (স্বয়ম্ভূ, স্বয়ংসৃষ্ট) বা অনন্ত সময়ের জন্য বিরাজমান যেখানে মানুষ (এবং প্রকৃতি ও প্রাণ) কোনো অতীন্দ্রিয় ইচ্ছার ফসল নয়।

গত দুই পর্বের লেখা (“বিবর্তনবাদ বিশ্বাসে সমস্যা কোথায়” ও “প্রাণের সংজ্ঞা”) প্রকাশিত হবার পর দুই আন্রুলি বেবির (পরিচয় প্রকাশ করছি না) সাথে কথা হয়েছে। তাদের বিশ্বাস বিবর্তনবাদের সত্যতা প্রমাণে আমি ক‚টতর্কের আশ্রয় নিয়েছি এবং প্রাণের সংজ্ঞা যেহেতু অস্পষ্ট তাই অতীন্দ্রিয় কোনো মহাশক্তি তা তৈরি করে থাকার সম্ভাবনা-ই বেশি। এই অন্তহীন মহাজগতে ধূলিকণার মতো ভেসে বেড়ানো একটা গ্রহে আমরা বাস করি। পাশের দুটি ধূলিকণার (চাঁদ, মঙ্গল) অল্প কিছু খোঁজ নেওয়া গেছে। এর বাইরের জগৎ সম্পর্কে আমরা কিছু জানি না। অতএব ঈশ্বরকে খুঁজে পাওয়ার জ্ঞানও আমাদের নেই। এই হলো তাদের বক্তব্যের সার কথা। বিবর্তনবাদ নিয়ে কয়েকটি নিবন্ধ লিখেছি। আমার বুদ্ধিতে যতোটা কুলায় ততোটা সহজ ও বোধগম্য করে লিখেছি। এখানে নতুন অনুচ্ছেদ যোগ করতে চাই না; একটা প্রশ্ন যোগ করতে চাই- মানুষের সাথে শিম্পাঞ্জির ডিএনএ-র মিল ৯৮.৮%। ঈশ্বর স্বর্গে বসে মানুষ তৈরি করার সময় কি শিম্পাঞ্জির অনুকরণে তৈরি করেছিলেন?

দ্বিতীয় প্রসঙ্গে (ঈশ্বরকে খুঁজে পাওয়ার জ্ঞান) আসি। থিওরি অব রিলেটিভিটির মহাকাশের মেট্রিক বিস্তৃতি অংশে বলা হয়েছে গ্যালাক্সিসমূহ পরস্পর থেকে ক্রমবর্ধমান গতিতে দূরে সরে যাচ্ছে এবং স্পেসটাইমের টপোলজির ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে মহাবিশ্বের সকল দিকেই পদার্থবিদ্যার নিয়ম সমভাবে কার্যকর। অর্থাৎ মহাবিশ্বের শেষ প্রান্তে গেলেও আমরা একই মৌলের সন্ধান পাবো এবং তাদের একই রীতিতে ক্রীয়াশীল দেখতে পাবো। পৃথিবীতে প্রাণ সৃষ্টির জন্য যে প্রাকৃতিক নিয়ম কাজ করেছে অন্য গ্রহে তার ব্যতিক্রম না হবার কথা। সিলিকন বা কার্বন বেজড যে প্রাণের কথা বলা হয় তা আসলে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিতে সীমাবদ্ধ। তারপরও ধরে নেওয়া যাক, আমাদের জানা মৌলের বাইরে আরও কিছু মৌল (যদিও বিগ ব্যাং মানলে এটা ধরে নেওয়া চলে না) এবং কল্পনার বাইরের কিছু ধরণের প্রাণের অস্তিত্ত¡ সেসব অঞ্চলে আছে। তাতে কি এটা অনুমান করা সিদ্ধ হবে যে ঐ প্রাণ সৃষ্টির ক্ষেত্রে ঈশ্বরের ভূমিকার অনুধাবনযোগ্য সাক্ষ্য পাওয়া যাবে? আরও সহজ করে বুঝতে চেষ্টা করা যাক:

আমি আর আপনি, দুই বন্ধু মিলে সাহারা মরুভূমির মাঝখানে একটা রিসোর্ট তৈরি করতে বাস করতে শুরু করলাম। আমি বললাম, এই মরুভূমিতে একটা প্রেতাত্মা আছে যার আদেশে বায়ু প্রবাহিত হয়, বাতাসে ধূলিকণা ওড়ে, গুল্মের কিশলয় অঙ্কুরিত হয়, বাওবাব, ব্যারেল ক্যাকটাস, হিডনোরা আফ্রিকানারা পানি ছাড়া বেঁচে থাকে এবং আমাদের ভালো মন্দও নির্ধারণ করে ঐ অদৃশ্য আধিদৈবিক শক্তি। তাঁর আদেশে এখানে সূর্য আলো ছড়ায়, চাঁদ জ্যোৎস্না বিলায়। আপনি আমার দাবি মানতে অস্বীকার করলেন এবং আমার দাবির পক্ষে দৃশ্যমান বা কমপক্ষে অনুধাবনযোগ্য (যেমন বায়ুর উপস্থিতি আমরা অনুধাবন করি) প্রমাণ দেখতে চাইলেন। আমি বললাম, “এই মরুভূমির আয়তন ১২ লক্ষ ৯৫ হাজার বর্গ কিলোমিটার। আমরা বড়জোর ১০ বর্গ কিলোমিটার দেখতে পাই। এই ক্ষুদ্র ক্ষমতা নিয়ে ঐ মহাশক্তিধর প্রেতাত্মার খোঁজ পাওয়ার আশা করা নিতান্তই বোকামি।”

খেয়াল করে দেখুন এখানে আমি কিন্তু আমাদের অজ্ঞতাকে পুঁজি করে আমার একটা কল্পনাকে বিবেচনায় নেওয়ার পরিবেশ তৈরি করে ফেলেছি। এটাকে যুক্তিবিদ্যায় বলা হয়, ফ্যালাসি ফ্রম ইগনোরেন্স বা অজ্ঞতার কুযুক্তি। আমি যুক্তি দেওয়ার পর বাকিটা নির্ভর করবে আপনার ওপর। আপনার মানসিক শক্তি কম হলে প্রেতাত্মার অস্তিত্ত¡ ও ক্ষমতা স্বীকার করে নেবেন। ধরুন, আপনার মানসিক শক্তি বেশি এবং আপনি অনুসন্ধিৎসু, নিরীক্ষাপ্রবণ ও সন্দেহপ্রবণ। আপনি বললেন, “ঘটনাগুলোয় প্রেতাত্মার হাত আছে বলে আমার মনে হয় না।” তখন আমি আমার শেষ অস্ত্রটি প্রয়োগ করবো; বলবো- “তাহলে প্রমাণ করুন প্রেতাত্মা বলে কিছু নেই।” মহা বিপদের কথা! দাবি করলাম আমি; আর প্রমাণ করতে হবে আপনাকে! প্রমাণের দায় (বার্ডেন অব প্রুফ) সবসময় তাকে নিতে হয় যে দাবি করে। আপনি যদি দাবি করেন আপনার ঘরে ঢুকে আমি ল্যাপটপ চুরি করে এনেছি তাহলে আদালত আপনাকে তার প্রমাণ দাখিল করতে বলবে। অন্য একটা সহজ উদাহরণ দেখা যাক। আমার সাথে আপনার কাল্পনিক কথোপকথন:
আমি: আমাদের বাসায় একটা অদৃশ্য বেড়াল আছে, যে এই বাসায় বসবাসকারী সকলের ভালো মন্দ দেখে।
আপনি: আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।
আমি: তাহলে প্রমাণ করুন যে এই বাসায় কোনো অদৃশ্য বেড়াল নেই। যদি না পারেন তাহলেই তো প্রমানিত হলো যে বেড়ালটি আছে।
আপনি: আমি সেটা প্রমাণ করতে পারবো না। আপনি নিশ্চিত হলেন কী করে যে বেড়ালটি আছে?
আমি: আমার বাবার কাছে শুনেছি। তিনি কখনও মিথ্যা বলেন না।
আপনি: এটা আপনার বিশ্বাস; এবার আপনার অদৃশ্য বেড়ালের প্রমাণ দিন।
আমি: আমার কাছে প্রমাণ নেই। তবে ভবিষ্যতে তো প্রমাণ পাওয়া যেতেও পারে!

ঈশ্বরের অস্তিত্ত¡ প্রমাণের জন্য আমরা যখন এরকম ফ্যালাসির আশ্রয় নেই তখন ধর্মগ্রন্থগুলোর মূল স্পিরিট থেকে দূরে সরে যাই। কোনো ধর্মগ্রন্থ বলেনি যে ঈশ্বরকে প্রমাণ করার পর বিশ্বাস করতে হবে। বরং বলা হয়েছে ঈশ্বরে বিশ্বাস হতে হবে শর্তহীন। Faith শব্দের অর্থ, strong belief in God or in the doctrines of a religion, based on spiritual apprehension rather than proof.
এখানে দেখুন প্রমাণের পরিবর্তে আধ্যাত্মিক অনুধাবনের কথা বলা হয়েছে। ঈশ্বর অতীন্দ্রিয় সত্তা। একেশ্বরবাদী দর্শনে ঈশ্বর সর্বোচ্চ সত্তা, স্রষ্টা ও আধ্যাত্মিক বিশ্বাসের প্রধান উপাস্য। তিনি অনন্ত, সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞ, সর্বত্র বিরাজমান ও সার্বজনীন। এটা বিশ্বাস করতে বলা হয়েছে; কারণ কোনকিছুই তাঁর সদৃশ নয়। কিন্তু বিলিভারদের একটা অংশ বিজ্ঞানকে প্রতিপক্ষ জ্ঞান করে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন ঈশ্বরের অস্তিত্ত¡ বিজ্ঞান দিয়ে প্রমাণের জন্য। এই প্রবণতা আধ্যাত্মিকতার মূল সূত্রের (অখণ্ড, অনমনীয়, দ্ব্যর্থহীন ও শর্তহীন বিশ্বাস) পরিপন্থী এবং দিনশেষে মানব জাতির জন্য ক্ষতিকর।

শুরুতে ‘২+২=৫’ সমীকরণটি আমরা ভুল প্রমাণ করেছি। ‘২+২=৩’ হতে পারে কী? আপেক্ষিকতা তত্ত¡ অনুযায়ী সমীকরনটি সিদ্ধ। দুটি ট্রেন সেকেন্ডে ২ লাখ কিলোমিটার গতিতে পরস্পরকে বিপরীত দিক থেকে অতিক্রম করলে তারা পরস্পরকে অতিক্রম করবে ২+২=৩ লাখ কিলোমিটার গতিতে; কারণ আলোর গতি-ই পরম গতি। বিষয়টি আমাদের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয়। একইভাবে তন্ত্র মন্ত্র ছাড়া কীভাবে জড় পদার্থ জীবে পরিনত হতে পারে সেই সমীকরণ যখন বিজ্ঞানীরা তথ্য উপাত্ত সহ উপস্থাপন করেন তখন সেটাও আমরা বিশ্বাস করতে পারি না। জড় ও জীবকে আমরা যে আলাদা বৈশিষ্ট্যে আমাদের চারপাশে দেখি তা এতই সুস্পষ্ট, প্রকট, অংসল যে আমাদের মনোজগতে তা স্থায়ী রূপ পেয়ে যায়- যা আমি নামের সত্তাটিকে প্রকৃতি থেকে উদ্ভূত একটা জৈব রাসায়নিক বিক্রিয়া ভাবতে বাধা দেয়। আমরা ভাবতে স্বস্তি বোধ করি বস্তু অচেতন সত্তা, তার প্রাকৃতিক রূপান্তর চেতনার জন্ম দিতে পারে না। আসলে আমাদের এরকম ভাবনা তৈরি হয় প্রাণ বা চেতনা সম্পর্কে আমাদের ভুল ধারণা থেকে। চেতনা যে জৈব বস্তু নির্ভর ‘পদ্ধতি’ (সেরহি এ. সকোলভ) বা ‘ঘটনা’ (এইচ. ল্যামার ব্রিডিহফট) ছাড়া অন্য কিছু নয় সেটা ‘২+২=৩’ মেলানোর চেয়ে সহস্রগুণ কঠিন।
দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, এপ্রিল ২৫, ১৯২৯ সংখ্যায় প্রকাশিত “EINSTEIN BELIEVES IN “SPINOZA’S GOD” শীর্ষক এক নিবন্ধে (আগ্রহীরা এই লিংক দিয়ে তাদের আর্কাইভে ঢুকে প্রায় শতবর্ষ বয়সী লেখাটা পড়তে পারেন: https://www.nytimes.com/1929/04/25/archives/einstein-believes-in-spinozas-god-scientist-defines-his-faith-in.html) বলা হয়েছে, “স্পিনোজার ‘সাবস্টেন্স’ (জিনিস) হচ্ছে এমন কিছু, যা অন্য কিছুর উপরই নির্ভর না করে নিজের মধ্যেই আছে। যা নিজে অস্তিত্বের জন্য অন্য কোনো ধারণার উপর নির্ভরশীল নয় এবং যা পুরোপুরি বাস্তব।” এই ওলন্দাজ দার্শনিক ১৬৭৭ সালে মৃত্যুবরণ করেছেন। মাক্স প্লাংক, নিল্স বোর, এর্ভিন শ্র্যোডিঙারদের সামসময়িক (বাংলা একাডেমি এই শব্দের বানান এভাবে শুদ্ধ করেছে) হলে তিনি হয়তো পদার্থকে ‘পুরোপুরি বাস্তব’ বলতেন না। Quantum Physics (আনন্দবাজার বাংলা করেছে ‘ক্ষুদ্রাংশিক বলবিজ্ঞান’!) মনে করে ভৌত জগত আসলে এটমিক পার্টিকেলের, অন্য কথায় তরঙ্গের বিস্তৃতি। ষোড়শ শতকের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে দার্শনিকদের এবং আঠারো শতকের শুরু থেকে বিজ্ঞানীদের ধারণায় যে ঈশ্বরের প্রতিরূপ পাওয়া যায় তার সাথে সর্বেশ্বরবাদের পার্থক্য নেই। এই ধারণা মেনে নিলে প্রাণের সচলতা এবং ঈশ্বরের সক্রিয়তা সমার্থক হয়ে যায়। বিরোধ তৈরি হয় ‘Personified God’ (এমন ঈশ্বর যার ওপর ব্যক্তি বৈশিষ্ট্য আরোপ করা হয়েছে) এর ধারণা ও বিশ্বাসের সাথে: যিনি প্রথম পুরুষে কথা বলেন, আদেশ নিষেধ দেন, পথ নির্দেশনা দেন।

আমরা ক‚টতর্ক দিয়ে শুরু করেছিলাম। সেরকম তরল একটা ক‚ট তর্ক দিয়েই শেষ করা যাক (এবারও আপনি আমার প্রতিপক্ষ):
আমি: বিজ্ঞানী ও দার্শনিকদের কথায় বিশ্বাস করে আপনি সংশয়ে ভুগছেন। বিজ্ঞানীদের বলুন একটা মাছি তৈরি করে দেখাতে।
আপনি: তারা পারবে না।
আমি: তাহলে তো এবার নিশ্চিত হলেন ঈশ্বর সর্বময় ও অবিসংবাদিত ক্ষমতার অধিকারী!
আপনি: নিশ্চিত হইনি। আপনি ঈশ্বরকে বলুন একটা মাছি তৈরি করে দেখাতে।
আমি: ঈশ্বর তো তা তৈরি করেই রেখেছেন!
আপনি: আপনি তো তাঁকে মাছি তৈরি করতে দেখেননি। অন্যদের কাছে শুনে বলছেন।
আমি: তাদের কথা আমি বিশ্বাস করি।
আপনি:‘বিশ্বাস’ আর ‘প্রমাণ’ তো এক জিনিস নয়।
আমি: এক সময় হয়তো ‘প্রমাণ’ও পাওয়া যাবে।
আপনি: এটাও আপনার বিশ্বাসের অনুক‚লে আরেকটা বিশ্বাস!
hassangorkii@yahoo.com
রয়্যাল রোডস ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া, ব্রিটিশ কলম্বিয়া, কানাডা।