সাজ্জাদ আলী : কমলা রঙের শার্ট পরা ডাবওয়ালার দোকান খুঁজে পেতে দেরি হলো না। একটি ভ্যান গাড়ির ওপর চার কাঁদি ডাব সাজানো। তার মধ্যে এক কাঁদি ডাবের সাইজ ছোট, রঙ নিপাট সবুজ। দেখেই বোঝা যায় ওরা কচি। কচি ডাবের পানি খেতে খানিকটা নোনতা, তবে অধিক উপকারি। ভ্যানের নিচে আরো বেশ কয়েক কাঁদি ডাব মজুত আছে। ডাবওয়ালার হাতে ধারালো দা। একটু বাদে বাদে তা গামছায় মুছে চকচকে রাখছে। দেখে ভয় হয়, ওটা দিয়ে অনায়াসে গলা কাটাও চলে। দুচার মিনিট পরপরই সে হাঁক ছাড়ছে, “ডাব খান, পরানডারে ঠান্ডা করেন। কচি ডাব ৬০ টাকা, নেওয়ায়ালা ডাব ৭০ টাকা।”
তাজমহল রোড ও রিং রোডের উত্তর-পূর্ব কোণের রাস্তার ওপরে ভ্যান-দোকানটি। এই দোকানের কাছেই নার্গিস আমাকে দাঁড়াতে বলেছে। ঢাকার ধুলোবালি আর গাড়ির হর্নের শব্দের সাথে আমার অভ্যাস নেই। তবে নিজের দেশের ধুলো বলে কথা, খুব আপনার লাগছে। মন চায় বেশি করে খানিকটা গায়ে মেখে নেই। ইনফ্যাক্ট ঢাকা শহর আমি চিনি না। কখনও থাকিনি এখানে। দোকানের একটু কাছে ঘেঁষতেই ডাবওয়ালা বললো, ভাইজান ডাব কাইটা দেই এট্টা? খাইতি অসুবিদা হবি না, নল আছে, চুইসা খাতি পারবেন। আবার কাঁচের গিলাসেও ঢাইলা দিতি পারবো।
আমি বিনয়ের সাথে বললাম, না ভাই, এখন ডাব খেতে ইচ্ছা করছে না। আপনার নাম কী? কতদিন হলো এই দোকান চালাচ্ছেন?
ভাইজান দোকান আমার না, আমি কর্মচারি। তয় আমার নাম কিবরিয়া।
এমন সময় একজন খরিদ্দার এসে কিবরিয়াকে জিজ্ঞাসা করলো, নেওয়াওয়ালাডার দাম কতো?
কিবরিয়া তড়িৎ আমার থেকে মনোযোগ ফিরিয়ে খরিদ্দারকে বললো, স্যার, সত্তুর টাকা। ভিতরে শক্ত নেওয়া হইছে, কচকচ কইরা চাবাইয়া খাইবেন। আর পানিও সরবতের নাগাল মিষ্টি।
আমি দুইডা নেবো, দাম কুমাইয়া নেও, বললো খরিদ্দার।
দাম কুমানুর উপায় নাই সার। বরিশালের মোকাম থেইক্যা অহন ডবল দামে মাল খরিদ করা লাগে। তয় দুইডা নিলি আপনার সুম্মানে দশ টাকা কম রাখতি পারবো। কন তো কাইটা দেই।
আইচ্চা কাটো, তয় মুখ ছাড়াইও না। আমি বাসায় নিয়া যাবো। নেওয়া যদি পুরু না হয়, আর পানি যদি মিঠা না হয়, তয় তুমার কলাম খবর আছে, একথা বলে শাশালো খরিদ্দার।
বাম হাতের তালুতে ডাব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ডান হাতের দা নিয়ে কাটছে ডাবওয়ালা। কী নিখুঁত তার প্রতিটি কোপ! ডাবের যেখানটায় সে দৃষ্টি ফেলছে, দায়ের কোপগুলো ঠিক সেখানে গিয়ে পড়ছে। একটুও এদিক ওদিক হচ্ছে না। ত্রিশ চল্লিশ সেকেন্ডের মধ্যে দুটো ডাব কাটা শেষ। খরিদ্দার হাজার টাকার নোট বের করতেই দোকানদার পড়লো বিপাকে। আমার দিকে চেয়ে বললো, ভাইজান ভাঙতি আছে?
বললাম, খুবই লজ্জিত ভাই, আমার কাছে বাংলাদেশি টাকা নেই।
একগাল হেসে সে বললো, ও আপনে তাইলে বিদেশি ভাইজান!
ঠিক তখনই আমার ফোন বেজে উঠলো। নার্গিসের ফোন। বললো, তুই কী ওখানে পৌঁছে গেছিস?
আমি একটু আগেই এসে পড়েছি রে। পথঘাট তো চিনি না, তাই রওনা দেবার সময়টা আন্দাজ করতে পারিনি, বললাম আমি।
কাল পই পই করে বললাম যে আমি তোকে পিক করে আনবো। কিন্তু তুই একা আসার গো ধরলি, বললো নার্গিস। শোন, আমার মটর সাইকেলের চাকা ফেটেছে। ওখানটায় আসতে আরো মিনিট পনেরো লাগবে। তুই ওই ডাবের দোকানটার আশেপাশে থাকিস। আমার জন্য তোকে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে, খুব লজ্জা লাগছে রে বন্ধু!
অন্তত কুড়ি বছর পরে আজ নার্গিসকে দেখবো। ওকে প্রথম দেখেছিলাম নিউইয়র্ক সিটি ইউনিভার্সিটির ক্যাফেটেরিয়ায়। চটপটে স্বভাবের স্মার্ট মেয়েটি। খাবারের প্লেট নিয়ে পাশের ফাঁকা টেবিলটাতে এসে বসলো। বাংলা কবিতা সংকলনের একখানা বই রাখলো টেবিলে। বুঝলাম, সে বাঙালি। প্রবাসে বাঙালির সাথে দেখা হওয়াটা লটারী জেতার মতোই আনন্দের। আবার যদি সে স্মার্ট তরুণী হয়, তাহলে তো হাতে চাঁদ পাওয়ার অবস্থা। একটু গলা উচিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, বাংলা বলেন?
ইংরেজির দেশে হঠাৎ বাংলা কথা শুনে নার্গিস বোধ হয় চমকে গেল। মাত্রই গালে অমলেট পুরেছে। কিন্তু তা চাবানো বন্ধ রেখে খানিকক্ষণ চেয়ে রইলো আমার দিকে। কোনো কথা বলছে না। চোখে মুখে বিস্ময়! তারপর খাবারের থালা নিয়ে আমার টেবিলে এসে বসতে বসতে বললো, আরে কী আশ্চর্য, তুমি বাংলা বলো নাকি? আমি তো ভেবেছি, এই ক্যাম্পাসে কোনো বাঙালি নেই! এখানে বসে বাংলায় কথা বলতে পারছি! কি যে খুশি লাগছে, জানো!
মনে হলো মেয়েটা যথেষ্ট খোলামেলা স্বভাবের। নইলে আমি তাকে “আপনি” সম্বোধন করলাম, আর সে কি না ‘তুমি’ করে বলছে! অবশ্য নার্গিসের সাথে ‘তুই তুকারিতে’ পৌঁছুতেও বেশি সময় লাগেনি। পারিবারিক আয়োজনে টেলিফোনে তার বিয়ে হয়েছিলো। বছরখানেক আগে সে স্বামীর স্পন্সরে নিউইয়র্ক এসেছে। কিন্তু বরের সাথে তার শিক্ষা, দিক্ষা, রুচি, মনন, কোনো কিছুরই মিল নেই। ওর স্বামী একটা ফার্মে মুরগি জবাই দেবার কাজ করে। প্রতিদিন গড়ে হাজারখানেক মুরগি জবাই করতে হয় তাকে। সপ্তাহের সাত দিন এবং প্রতিদিন বারো ঘ›ণ্টা করে তার কাজ। বরটি আল্লাহ’র বান্দা। নামাজ কালামে মনোযোগ তার। কিন্তু কাজের মধ্যে নামাজের সুযোগ নেই। তাই যোহর ও আছরের নামাজ তাকে বাড়ি ফিরে কাজা পড়তে হয়। ওদিকে নার্গিস নাচ-গান শিখে, কবিতা পড়ে বড় হয়েছে। দুজন দুই আলাদা জগতের বাসিন্দা।
একদিন ক্যাম্পাসের গাছ তলায় বসে দুজনে হটডগ খাচ্ছিলাম। কথায় কথায় জানতে চাইলাম, অ্যাই নার্গিস, তুই তোর স্বামীটিকে বিদায় করতে মাসখানেকও সময় নিলি না। ব্যপারটা কী বলতো?
আরে ধুরু, ওটার সাথে যে একটা মাস কীভাবে ছিলাম, সে আমি জানি, বলছে নার্গিস। প্রতিরাতে কাজ শেষে ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরতো। গোসলের ধার ধারবে না, আগে ডিনার খাবে। তারপর বিছানায় শুয়ে আমাকে নিয়ে টানাটানি!
ওমা, টানাটানি করতে হবে কেন? বিছানায় তো তোরও কমন ইন্টারেষ্ট আছে, নিজ গরজেই তো তোর যাওয়ার কথা, বললাম আমি।
চুপ কর ব্যাটা বেক্কেল, ক্ষেপে গেল নার্গিস। ওর সারা গায়ে মুরগির বোটকা গন্ধ। এমন একজন মানুষের সাথে আমি জড়াজড়ি করবো? কী জানিস, গোসলে ওর অনিহা। কম চেষ্টা তো করিনি। পরিচ্ছন্নতা নিয়ে ওর বোধটাই ওই রকম। অমন করেই ও বড় হয়েছে। সে নাকি অনার্স পাশ। কিন্তু কিচ্ছু লেখাপড়া জানে না। গুছিয়ে দুটো কথা বলতেও পারে না, লেখা তো বাড়ির কাছে। সামান্যতম রুচিবোধ নেই, মন ও মননের মধ্যে সংস্কৃতির কোনো চিহ্ন খুঁজে পাবি না। সকালে নাস্তা খেয়ে বের হবে। রাতে ফিরে আমার সাথে সেক্স সেরে ঘুমাবে। এর বাইরে তার কোনো জগৎ নেই।
ডাবের দোকানের পাশে দাঁড়িয়ে আছি। পুরোনো সব কথা একে একে মনে পড়ছিলো। কী প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসী ও করিৎকর্মা একজন মানুষ নার্গিস! নিউইয়র্কের মতো জায়গায় একা লড়েছে। নিজেকে দাঁড় করিয়েছে। এ মুহূর্তে খরিদ্দার নেই, ডাবওয়ালা হাক ডাক ছাড়ছে। এক সময় আমার কাছে এসে দাঁড়ালো। বললো, ভাইজান, আপনি এইখানে দাঁড়াইয়া আছেন ক্যান? কিছু কি লাগবি আপনার?
না, কিছু লাগবে না ভাই, এক বন্ধুর জন্য অপেক্ষা করছি। তিনি পথে আছেন, এসে পড়বেন এক্ষুনি। আচ্ছা কিবরিয়া, কচি ডাবইতো স্বাস্থ্যের জন্য উপকারি। দামও তো বেশি হওয়ার কথা?
জে ভাইজান, কথা ঠিকই কইছেন। তয় বুড়া ডাবের নেওয়া আর পানি খাইলে একজন মাইনসের একবেলার খাওয়া হইয়া যায়। রাস্তার ধুলাবালিওয়ালা খাবার যারা খাতি চায় না, তারা এট্টা বুড়া ডাব খায়। সেজন্যি ওর চাহিদাও বেশি, আর দামও বেশি।
সারা ঢাকা শহরেই কি তাহলে কচি ডাবের দাম কম, জিজ্ঞাসা করলাম আমি।
তা কবার পারবো না ভাইজান। তয় আমার মালিকের এগারোডা দোকান আছে। মুহাম্মাদপুর থেইক্যা ধানমন্ডি পর্যন্তু এই দোকানগুলান। এই্ এলাকায় কচি ডাবের দাম কম।
বলো কি কিবরিয়া? এগারোটা দোকান একজনের? সব দোকানই কি এই তোমারটার মতো ভ্যানের ওপর?
ভাইজান, আমার মালিক ভারি ভালো মানুষ, ম্যালা চটপইট্যা। ব্যবসাডা খুব বোঝে। কত্ত রকমের যে ব্যবসা আছে তার! সব খবর অবশ্যি আমি জানি না। তয় লঞ্চ আছে দুখান। ঢাকা-বরিশাল লাইনে চলে।
আমি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু কিবরিয়ার সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। সে বলেই চলেছে, তয় ডাবের ব্যবসা খুব ভাল ভাইজান। এট্টু টাকা-পয়সা জমাবার পারলি নিজি এট্টা দোকান দেবো। এই ছোট্ট দোকানডায় দৈনিক আট/দশ হাজার ট্যাকা বিক্রি হয়। আমার বেতন ডেইলি পাঁচশো, এলাকার সরকারি দলের চান্দা পাঁচশ, আর মালামাল কিনার যা খরচ। মালিকির ডেইলি হাজার/দুইহাজার তো থাহেই।
এমন সময় একখানা মটর সাইকেল এসে থামলো আমাদের পাশেই। কিবরিয়া বেশ ব্যতিব্যস্ত হয়ে চালককে সালাম দিলো। তারপর মটর সাইকেলখানা ঠেলে নিয়ে ভ্যানের পাশে দাঁড় করালো। চালক মাথার হেলম্যাট খুলতেই দেখি নার্গিস! টাইট জিন্স পরনে। বয়স বেড়েছে, কিন্তু স্মার্টনেস একটুও কমেনি। আমাকে দেখে তার চোখে মুখে কী যে খুশির ঝিলিক! একেবারে বুকে জড়িয়ে ধরে কানের কাছে মুখ এনে বললো, তোকে খুঁজে পাওয়ার আশা তো ছেড়েই দিয়েছিলাম। ভাগ্যিস দুনিয়ায় ফেসবুক এসেছে।
আমিও ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে বললাম, এখন ছাড় নার্গিস। একেবারে বিছানার স্টাইলে জড়িয়ে ধরেছিস। চারিপাশের লোকজন তো চেয়ে আছে আমাদের দিকে! এটা তো আর নিউইয়র্ক না, ঢাকার রাস্তায় জড়াজড়ি তো হালাল না!
হালাল না বলেই তো চুমু দিচ্ছি না। আচ্ছা চল, এখানে আর না। ম্যালা কথা বলার আছে, শুনবোও। কত্ত কাল পরে আমরা আবার একসাথে হলাম, বলতো? বাইক কি তুই চালাবি?
আমি পেছনে বসতেই সে একটা হেলমেট এগিয়ে দিলো নার্গিস। রওনা হবার আগে কিবরিয়ার কাছে সেই বেলার কেনাবেচার খবর নিলো। চলতে চলতে আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, দুপুরে কী খাবি বল? আর জাপটে ধরে রাখিস আমাকে, রাস্তাঘাটের যা অবস্থা!
(লেখক বাংলা টেলিভিশন কানাডার নির্বাহী)