ইউসুফ কামাল : স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায়
দাসত্ব শৃংখল বল কে পরিবে পায়।
উপরোল্লখিত লাইনটি প্রখ্যাত লেখক রংগলাল বন্দোপাধ্যায়ের পদ্মিনী উপাখ্যানের অংশ বিশেষ, মুলতঃ ইংরেজ বিরোধী স্বদেশী যুগের বিপ্লবীদের মধ্যে তখন এই কথাগুলি প্রচন্ড উদ্দীপক শক্তি হিসেবে কাজ করতো। স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে তারা তখন ফাঁসির কাষ্ঠে যেতেও কুন্ঠাবোধ করতো না।
‘৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে আমাদের বাংলার দামাল ছেলেরাও স্বদেশীদের ভাব ধারায় দল মত নির্বিশেষে দেশ মাতৃকাকে রক্ষার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো। প্রথমে দেশের অভ্যন্তরে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চেষ্টা করেছিলো নিজেদের ব্যক্তিগত অস্ত্রশস্ত্র ও নানান স্থান থেকে সংগ্রহ করা অস্ত্র দিয়ে। পরবর্তিতে ভারতীয় বাহিনী যখন মিত্র বাহিনী নাম দিয়ে সরাসরি পাকিস্তানী বাহিনীর সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পরলো তখন কিন্তু যুদ্ধটা হয়ে গেল এক রকম ভারত বনাম পাকিস্তানের যুদ্ধ।
তখন দেশ ছিলো পাকিস্তানী সরকারের অধীনে, তাই মহকুমা ও জেলা পর্যায় থেকে পাকিস্তানী ভাব ধারার সহায়ক শক্তি হিসাবে অবাঙালি বিহারী ও অস্বচ্ছল স্থানীয় কিছু বাঙালি যুবকদেরকে এরা রাজাকার হিসেবে রিক্রুট করে। এদেরকে সরকারের তরফ থেকে বেতন ভাতাও দেওয়া হতো আর সেটা সরাসরি সার্কেল অফিসাররা নিয়ন্ত্রণ করতো। এদের কাজ ছিলো প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণাধীন কিছু অতি উৎসাহী কর্তা, অবাঙালি ব্যাক্তিদের ইচ্ছা মাফিক লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও বিশেষ করে অমুসলিম স¤প্রদায়ের উপর নির্যাতন চালানো। কর্তা ব্যাক্তিদের নির্দেশ মতো অমুসলিম বিশেষ করে হিন্দু স¤প্রদায়ের লোক ও সমাজের বড় বড় বাঙালি ব্যবসায়ীদেরকে ধরে এনে গুম করে দিতো, হিন্দু গ্রামগুলোতে লুট পাট চালিয়ে ওদেরকে হত্যা করে পরে তাদের বাড়িঘর পর্যন্ত জ্বালিয়ে দিতো। এমনি অসংখ্য ঘটনা আমরা তখন ঘটতে দেখেছি। প্রথম দিকে জ্বালাও পোড়াও করে আতংক সৃষ্টি করে রাখাই ছিলো এদের কাজ, পরবর্তিতে এদেরকে সড়ক এ রেল পথের ব্রীজ ও কালভার্ট পাহারার কাজ নিয়োজিত রাখা হতো।
স্থানীয় অবাঙালিদের মধ্যে যারা নেতৃস্থানীয় ছিলো তারা আবার বুদ্ধি করে সামাজিকভাবে এলাকায় গ্রহণযোগ্য কিছু বয়স্ক শ্রেণীর বাঙালিদেরকে ‘পিস কমিটি’র প্রধান হিসাবে নিযুক্ত করেছিলো। বিষয়টা ছিলো বাঙালি দিয়ে বাঙালির উপর খর্গ চালানো। দেশ স্বাধীন হওয়ার অব্যবহিত আগে কিছু অবাঙালি দেশ ত্যাগ করে পাকিস্তানের করাচীতে চলে যায়। আবার কিংছু সংখ্যক অবাঙালি আত্মসমর্পন করে বিভিন্ন ক্যাম্পে আশ্রয় নেয় আর কিছু সংখ্যক পার্শ্ববর্তী দেশে আশ্রয় গ্রহণ করে। যারা দেশ ত্যাগ করে অন্য দেশে আশ্রয় নিতে পেরেছে নিঃসন্দেহে তারা ভাগ্যবান।
আমার দেখা খালিদ খান সেই ভাগ্যবানদের মধ্যে একজন। যার সন্তানেরা এখন আমেরিকার বড় শহরে চাকুরী করে। সে খানে তারা স্ব স্ব ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত। পরবর্তিতে খালিদ খানের সাথে আমার দু’একদিন কথা হয়, পরিচিতি একটু গভীর হওয়ার পরে আমি রীতিমতো চমকে উঠলাম যখন শুনলাম খালিদ খান এর পিতা ষাট এর দশকের দিকে আমার দেশের বাড়ি রাজবাড়ীর রেলওয়েতে চাকুরী করেছেন। মজিদ খান সে সময় রেলওয়ের লোকোশেড এর ইনচার্জ হিসেবে দায়িত্ব পালন করে গেছেন আর থাকতেন শহরের ভিতরের রেলওয়ে কোয়ার্টারে।
বাস্তবতা হলো যারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাস করেন তারা জানেন, বিদেশে বাস রত বাঙালিরা যে সমস্ত দেশে বাস করে তারা তখন মোটামুটি উন্মুক্ত বিশ্বের অধিবাসী হয়ে যায় এবং বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাভাষিদের সাথে নিজেরা বন্ধুর মতো মিশে যায়। সেদিন তেমনি এক নেইবারহুডের বাসায় আমন্ত্রিত হয়ে যাওয়ায় পর আমি খালিদ খানসহ আরো কয়েকটা দেশের মানুষকে পেলাম। আর সেটা দেখে আমি আবার নতুন করেই উপলদ্ধি করলাম বিদেশে এসে সবাই একে অন্যের অনেক কাছাকাছি যেয়ে পৌঁছতে পারে।
পাকিস্তানী, ভারতীয়, জর্দানি, আমি বাংলাদেশীসহ আলজিরিয়ান ও সিরিয়ান ছয় জন মানুষ এক সাথে এক রুমে বসে বুঝলাম সত্যিই পৃথিবীটা একটা গ্লোবাল ভিলেজ। বিদেশ বিভূয়ে এমনি করেই ছয়টি দেশের ছয় রকম চরিত্রের মানুষ এক সাথে বসে নতুন একটা সম্পর্কের সৃষ্টি করতে পারে তার নাম ‘ভ্রাতৃত্ববোধ’। যা বিদেশে বেঁচে থাকার জন্য একটা অত্যাবশ্যকীয় শক্তি। (চলবে)
ইউসুফ কামাল : কেটি, টেক্সাস, ইউএসএ