হাসান গোর্কি : পৃথিবী সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে- এই তত্ত¡ প্রচার করায় ব্রæনোকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল; বৃদ্ধ গ্যালিলিওকে কারাগারে বাস করতে হয়েছিল। শপথপূর্বক এই ‘মিথ্যা’ দাবি পরিত্যাগ করার শর্তে অবশ্য তিনি মৃত্যুর আগের কয়েক বছর মুক্ত জীবন কাটিয়েছেন। ইতিহাসের এই অভিজ্ঞতা থেকে কিনা আমরা জানি না ডারউইন প্রাকৃতিক নির্বাচনের বিষয়টি বুঝতে পারার পরও প্রায় তিন দশক চুপ করে ছিলেন। বিউগলে চড়ে তাঁর দ্বিতীয় সমুদ্র যাত্রা শেষ হয় ১৮৩১-র অক্টোবরে। দীর্ঘ অনুসন্ধান থেকে অর্জিত তাঁর এই উপলব্ধি- আবিস্কার- অনুধাবন তিনি গুটিকয়েক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সাথে আলোচনা করেছিলেন। যতদূর জানা যায়, ১৮৪২ সালে ডারউইন তাঁর বইয়ের প্রথম সংস্করণের পাণ্ডুলিপি পুরোপুরি তৈরি করে রেখে দিয়েছিলেন। অন্যদিকে আরেক বিখ্যাত বৃটিশ প্রকৃতিবিদ আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস ডারউইনের মতই জাহাজে করে আমাজন নদীর উপত্যকা, মালয় দ্বীপপুঞ্জ ও ইন্দোনেশিয়ায় যান এবং বিভিন্ন প্রাণি ও উদ্ভিদের বৈচিত্র্য ও পরিবর্তনের ধারা নিয়ে গবেষণা করেন। এসময় তাঁর একটা বড় আবিষ্কারও আছে। তিনি লক্ষ করেন যে ইন্দোনেশীয় দ্বীপপুঞ্জের পূর্ব অংশের প্রাণিরা এশীয় ধরণের আর পশ্চিম অংশের প্রাণিরা অস্ট্রালেশীয় ধরণের।
ইন্দোনেশিয়ার পূর্ব-পশ্চিম বিভক্তকারী এই জীব- ভৌগলিক রেখাকে বর্তমানে ওয়ালেস রেখা বলা হয়। যাহোক, ওয়ালেস ১৮৫৮ সালে On the Tendency of Species to form Varieties; and on the Perpetuation of Varieties and Species by Natural Means of Selection নামে একটা গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। এরপর অনেকটা তড়িঘড়ি করে ১৮৫৯ সালের নভেম্বরে ডারউইন তাঁর বই On the Origin of Species by Means of Natural Selection, or the Preservation of Favoured Races in the Struggle for Life (যার বাংলা করলে দাঁড়ায় “প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে প্রজাতির উৎপত্তি অথবা জীবন সংগ্রামে আনুক‚ল্য প্রাপ্ত গোত্রের সংরক্ষণ বিষয়ে”) প্রকাশ করেন।

থিওরি অব রিলেটিভিটি আইনস্টাইনের একক তত্ত¡। কিন্তু বিবর্তনবাদে অবদান আছে অনেক বিজ্ঞানী-দার্শনিকের। প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত¡ দেওয়ার মাধ্যমে ডারউইনের অবদান সবচেয়ে বেশি। তাঁর পিতামহ ইরাসমাস ডারউইন ছিলেন চিকিৎসক। কিন্তু তাঁর নেশা ছিলো প্রকৃতি নিয়ে গবেষণা করা। প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বংশগতির পরিবর্তনের বিষয়টি তিনি ডারউইনের আগে চিন্তা করেন। ইরাসমাস ডারউইনের মৃত্যুর (১৮০২) ৭ বছর পর ডারউইনের জন্ম (১৮০৯)। ডারউইন এডিনবার্গ মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়েও সেখানে পড়েননি। তিনি হয়তো পিতামহের চিন্তার লিখিত-অলিখিত নির্যাস দিয়ে প্রভাবিত হয়েছিলেন। যেমন ১৯৮২ সালে চিকিৎসাক্ষেত্রে নোবেল পেয়েছিলেন সুনে বার্গস্ট্রম। তাঁর সন্তান সান্তে প্যাবো পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে ২০২২ সালে চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল পেয়েছেন (এখানেও বংশগতি!)। প্রাকৃতিক নির্বাচন (অন্য কথায় বিবর্তন) বিষয়ে প্রথম স্পষ্ট ধারণা প্রকাশ করেন ইরাকের দার্শনিক আল জাহিজ। তার আসল নাম ছিল আবু উসমান আমর বাহার আলকানানি আল-বাসরি। তবে ইতিহাসে তিনি আল জাহিজ নামেই বেশি পরিচিত। তাঁর লেখা গ্রন্থটির নাম কিতাব আল-হায়ওয়ান অর্থাৎ প্রাণীদের বিষয়ে বই। এই বইয়ে তিনি লিখেছেন, “নিজেদের বেঁচে থাকা নিশ্চিত করতে গিয়ে পরিবেশের নানা কারণে প্রাণীরা নতুন নতুন বৈশিষ্ট্য ধারণ করে এবং এভাবেই তারা নতুন নতুন প্রজাতিতে রূপান্তরিত হয়।” তিনি আরো লিখেছেন, “যেসব প্রাণী প্রজনন ঘটিয়ে টিকে থাকতে পারে তারা তাদের সফল বৈশিষ্ট্যগুলো তাদের পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যেও ছড়িয়ে দিতে পারে।”

চিত্রটি ডয়েচে ভেলের ওয়েব সাইট থেকে সংগৃহীত

লক্ষ করলে আমরা দেখবো আধুনিক বিবর্তনবাদের মূল কথাটা তিনি ডারউইনের এক হাজার বছর আগে লিখে গিয়েছেন। এটা তিনি করতে পেরেছিলেন একারণে যে তার জন্ম হয়েছিল ৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে, দক্ষিণ ইরাকের বসরা শহরে, মুতাজিলাহ আন্দোলনের সময়- যখন ধর্মতাত্তি¡ক কিছু মতবাদের পাশাপাশি যুক্তির চর্চার ওপর জোর দেওয়া হচ্ছিল। আব্বাসীয় খলিফা আল মামুনের শাসনামলে মুতাজিলাহ মতবাদ সর্বব্যাপ্ত গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। এমনকি খলিফা আল মামুন নিজেও এই মতবাদের অনুসারী ছিলেন। মুতাজিলাহ হলো ইসলামী ধর্মতত্তে¡র একটা বিতর্কিত শাখা যা কারণ ও যুক্তিকে সত্য অন্বেষণের পাথেয় মনে করতো। প্রায় দুইশ’ বছর (৮ম থেকে ১০ শতাব্দী) বসরা ও বাগদাদে এই মতবাদের প্রাধান্য ছিল। মুতাজিলারা কুরআনকে আল্লাহর অস্তিত্বের অংশ বলে মনে করতেন না, বরং আল্লাহর অন্যান্য সৃষ্টির মতই সংশোধনযোগ্য সৃষ্টি বলে মনে করতেন। তারা প্রাচীন গ্রীকদের মতই মানুষের স্বাধীন ইচ্ছায় বিশ্বাস করতেন এবং মনে করতেন আল্লাহ মানুষের ভাগ্য পূর্বনির্ধারণ করতে পারেন না। বরং মানুষ আল্লাহর ইচ্ছার বাইরেও সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। প্রাকৃতিক নির্বাচন বিষয়ে আল-জাহিজের ধারণা তার পরবর্তী অন্যান্য মুসলিম চিন্তাবিদদেরও প্রভাবিত করেছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন আল-ফারাবি, আল-আরাবি, আল বিরুনী এবং ইবনে খালদুন। তবে এই মতবাদ প্রসার লাভ করেনি ইসলামী সৃষ্টি তত্তে¡র (ক্রিয়েশনিজম) সাথে তা মৌলিকভাবে বৈপরীত্যমূলক বলে। ক্রিয়েশনিজম এমন এক ধর্মীয় বিশ্বাস যাতে মনে করা হয় ঐশ্বরিক ইচ্ছা থেকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ও প্রাণের সৃষ্টি হয়েছিল যা বিবর্তনবাদের ধারণার পুরোপুরি বিপরীত।

বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তক থেকে বিবর্তনবাদ বাদ দেওয়ার যে দাবি উঠেছে তার পেছনেও এই কারণটিই মূলত কাজ করছে।

উপরের আলোচনা থেকে আমরা বুঝেছি বিবর্তনবাদ হঠাৎ করে গড়ে ওঠা কোনো তত্ত¡ নয়। প্রাচীন গ্রীক ও রোমান সভ্যতায় জীববিজ্ঞানের একাডেমিক আলোচনা শুরুর আগে থেকে দর্শনের বলয়ে এমন কিছু প্রস্তাবনার অস্তিত্ব ছিলো। সক্রেটিস-পূর্ব গ্রিক দার্শনিক এনাক্সিম্যান্ডার ও এম্পেডকলস মনে করতেন এক প্রকারের জীব অন্য প্রকারের জীব থেকে সৃষ্টি হতে পারে। রোমান কবি লুক্রেটিয়াস এম্পেডকালসের চিন্তাধারাকে অনুসরণ করে একটি গ্রন্থ রচনা করেন — দে রেরাম ন্যাচুরা (বাংলা হতে পারে ‘বস্তুর প্রকৃতি বিষয়ক’)। সেখানে তিনি বলতে চেয়েছেন বস্তুর প্রকৃতি অন্তর্গতভাবে রূপান্তর প্রবণ; ফলে ‘প্রাণের (যাকে তিনি বস্তুর সচল রূপ বলে মনে করেছেন) মধ্যেও পরিবর্তনের প্রবণতা কাজ করে। তবে তার প্রেষণা আসে প্রয়োজন থেকে। এরিস্টটল সকল প্রাকৃতিক বস্তুকে নির্ধারিত প্রাকৃতিক সম্ভাবনার বাস্তবায়নরূপে বিবেচনা করেছিলেন। তাঁর এই তত্ত¡কে ফর্ম থিওরি বা গঠন তত্ত¡ বলা হয়ে থাকে। এই তত্তে¡ প্রাণকে স্বর্গীয় মহাজাগতিক আদেশ পালন বা বাস্তবায়নের জন্য উদ্দিষ্ট বলে মনে করা হয়নি। বরং প্রাণের উৎপত্তি, বিকাশ ও অভিযোজনকে প্রাকৃতিক দৈব ধারাবাহিকতা মনে করা হয়েছে।

দৈবক্রমে প্রাণ সৃষ্টি হবার সম্ভাবনা কতো কম তার একটা গাণিতিক হিসাব রিলিজিয়াস এপোলজিস্টরা প্রায়-ই দিয়ে থাকেন। সেখানে দেখা যায় যে অনুসঙ্গগুলো দৈবক্রমে মিলে গেলে এমিনো এসিড এবং তা থেকে প্রোটিন ও প্রাণ সৃষ্টি হতে পারার সম্ভাবনা লক্ষ- কোটি- বিলিয়ন- ট্রিলিয়ন ভাগের এক ভাগ। যে পদ্ধতিতে তারা হিসাব করেন সেখানে কিছু চাতুরি আছে। সে আলোচনায় যাচ্ছি না। এপোলজিস্টদের হিসাব নির্ভুল ধরে নিলেও প্রকৃতির দৈবচয়ন নীতির কোনো হানি হয় না। সহজ করে বুঝতে চেষ্টা করা যাক— বৈকাল হ্রদে বসবাসকারী একটা অণুজীবের সাথে বান্দারপুচ পর্বতশৃঙ্গের পাদদেশে অবস্থিত যমুনোত্রী হিমবাহে বসবাসকারী একটা অণুজীবের দেখা হবার সম্ভাবনা কতো? আমি যদি বলি লক্ষ- কোটি- বিলিয়ন- ট্রিলিয়ন ভাগের এক ভাগ তাহলে আপনি হয়তো সন্তুষ্ট থাকবেন; কারণ এই প্রশ্নের একটা বড় ত্রæটি আপনি লক্ষ করেননি: আপনি খেয়াল করেননি যে এখানে আমি ঘটনাটা ঘটার জন্য কোনো সময়সীমা বেঁধে দেইনি। ফলে সেটা তাৎক্ষণিক (ধরা যাক ১ লক্ষ বছরের মধ্যে) ঘটার সম্ভাবনার কথা আপনি বিবেচনায় নিয়েছেন। তাহলে এক লক্ষ- কোটি- বিলিয়ন- ট্রিলিয়ন বছরে সেটা ঘটার সম্ভাবনা এক কোটি- বিলিয়ন- ট্রিলিয়ন ভাগের এক ভাগে নেমে আসে। এবার হিসাব করুন অনন্ত সময় কালের মধ্যে এটা ঘটার সম্ভাবনা কতো।

আরও সহজ করে বুঝতে চেষ্টা করা যাক। আপনি টরোন্ট থেকে প্রতিবছর ঢাকার বই মেলায় যান। আমিও যাই। মেলায় প্রতিদিন ৫০ হাজার মানুষ যায়। একদিনে আমাদের দেখা হবার সম্ভাবনা ৫০ হাজার ভাগের এক ভাগ। অর্থাৎ জীবদ্দশায় আমাদের দেখা হবার সম্ভাবনা নাই বললেই চলে। কিন্তু আমরা যদি অনন্তকাল ধরে প্রতি বছর বইমেলায় যেতে থাকি তাহলে কি দেখা হয়ে যেতে পারে? হ্যাঁ। সে সম্ভাবনা যে অনেক তা বুঝতে পারা কঠিন নয়। কোনো ঘটনার জন্য ঈশ্বরের তো কোনো তাড়াহুড়ো নাই। তাঁর তো বছর দিয়ে সময় গণনার দরকার নাই। আর ঈশ্বরের পরিবর্তে যদি প্রকৃতি দায়িত্বটা পালন করে থাকে তাহলে তো ধৈর্যের দরকার-ই পড়ে না। পৃথিবীতে প্রাণি সৃষ্টি করতে দেরি হচ্ছে কেনো সে বিষয়ে তাঁর/তার কাছে কেউ কৈফিয়ত তলব করবে না। আসলে সমস্যা হলো আমরা এক চতুর্মাত্রিক ভৌত জগতে বাস করে ত্রিমাত্রিক উপকরন দিয়ে তাকে বুঝতে চেষ্টা করছি। আমরা মেজারিং টেপ দিয়ে একটা ইটের তিনটি মাত্রা- দৈর্ঘ্য- প্রস্থ -উচ্চতা মাপতে পারি। কিন্তু এর গায়ে যে সময় লেপ্টে আছে তাকে মাপতে পারি না। এমনকি পরিমাপযোগ্য সময়ের দৈর্ঘ্য বেশি হলে সেটাও আমাদের বোধগম্যতার বাইরে থেকে যায়। যে কারণে বিবর্তনবাদ বুঝতে পারাটাও কঠিন হয়।

বিবর্তনের আলোচনাটা আমরা শুরুই করি নরবানর (এপ) থেকে। কিন্তু শুরু হওয়া উচিৎ এক কোষী প্রাণি থেকে। কারণ আমাদের আদিপিতা তারাই। শুরুতে বিবর্তনবাদকে মেনে নেওয়ার ক্ষেত্রে বাধা ছিলো এর প্রত্যক্ষণ- অযোগ্যতা। কিন্তু পরে বিবর্তনের পক্ষে অফুরন্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ হাজির করেছেন বিজ্ঞানীরা— প্রাণ রাসায়নিক প্রমাণ, কোষবিদ্যা বিষয়ক প্রমাণ, শরীরবৃত্তীয় প্রমাণ, জীবাশ্ম বা ফসিলের প্রমাণ, সংযোগকারী জীবের প্রমাণ, ভৌগোলিক বিস্তারের প্রমাণ, প্রতœতাত্তি¡ক প্রমাণ, তুলনামূলক অঙ্গসংস্থানের প্রমাণ, শ্রেণিকরণ সংক্রান্ত প্রমাণ, নিষ্ক্রিয় বা বিলুপ্তপ্রায় অঙ্গের প্রমাণ ছাড়াও অত্যন্ত সাক্ষ্যমূলক ও প্রামানিক উপাত্ত পাওয়া গেছে ‘আণবিক জীববিদ্যা’, জেনোমিক্স এবং সাইটোজেনেটিক্স থেকে। ২০২২ সালে আধুনিক মানুষের বিলুপ্ত আত্মীয় নিয়ান্ডারথালের জিনের পূর্ণাঙ্গ বিন্যাস তৈরি করে নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন ড. সেভান্তে পেবো। ফলে বিবর্তনের সত্যতা নিয়ে বিজ্ঞানী মহলে কার্যত আর কোনো বিতর্ক নেই। কিছু বিতর্ক আছে প্রক্রিয়া বিষয়ে। যেমন মিউটেশনের অনুঘটক, অভিযোজনের প্রেষণা বা প্রজাত্যায়নের পেছনে জিন প্রবাহের ভূমিকা নিয়ে বিজ্ঞানীরা কিছু ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন। এই ভিন্নমত অস্বাভাবিক নয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, পরমাণু বোমা তৈরি করে তা ব্যবহারও করা হয়ে গেছে। কিন্তু পরমাণুর গঠন নিয়ে এখনও বিজ্ঞানীদের মধ্যে ভিন্নমত আছে।

বিবর্তন নিয়ে বিতর্কটা একাডেমিয়া থেকে পরিপূর্ণ নির্বাসিত হয়েছে মূলত ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে সাইটোজেনেটিক্স (ক্রোমোজোমের গঠন এবং কার্যকারিতার সাথে উত্তরাধিকারের অধ্যয়ন) ও আণবিক জীববিদ্যা’র আবির্ভাবের পর। সংশয়ের অবশিষ্ট ক্ষুদ্র অংশগুলো এর পর দূর হয়েছে। বিতর্কটা টিকে আছে ইউ টিউব, ফেসবুক সহ কিছু সামাজিক মাধ্যমে এবং মূল ধারার বাইরের কিছু পত্রিকা- ম্যাগাজিনে। চাঁদে মানুষ আসলেই গিয়েছে কিনা তা নিয়েও এরকম বিতর্ক আছে। তাই বিতর্ক টিকে থাকার অর্থ এটা নয় যে বিবর্তন তত্ত¡ নিয়ে সন্দেহ আছে। তবে এটা নিশ্চিত যে বিতর্কটা সহজে থেমে যাবে না। শিক্ষায় পশ্চাৎপদ ও ধর্মীয় বিশ্বাসে পূর্ণ ভারত উপমহাদেশ, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার কিছু দেশে আরও শতাব্দীকাল টিকে থাকতে পারে। এখনও মূলত এ অঞ্চলগুলোতেই এটা চালু আছে। এতে আসলে বড় কোনো ক্ষতি নেই। এই বিতর্ক মানুষের বিজ্ঞান মনস্কতাকে বাধা দিতে পারবে না। কালো জিরা সকল রোগের মহৌষধ এটা মনে প্রাণে বিশ্বাস করা মানুষদের ৯৯.৯৯% জ্বর হলে প্যারাসিটামল খায়। যারা প্রতিদিন শিব লিঙ্গে গঙ্গাজল, কাঁচা দুধ এবং চন্দন অর্পণ করে পুজো করেন এবং রোগমুক্তির আশায় ১০৮ বার মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র
(ওঁ ত্রম্বকং য্জামহে সুগন্ধিং পুষ্টিবর্ধনম্।
উর্বারূপমিব বন্ধনান মৃতৌমোক্ষীয় মামৃতাত!!)
জপ করেন তারাও দিনশেষে ফার্মেসিতে ওষুধ কিনতে যান।

প্রমিথিউস স্বর্গ থেকে মানুষের জন্য আগুন চুরি করে এনেছিলেন। অলিম্পিয়ান দেবতাদের রাজা জিউস ক্ষিপ্ত হয়ে প্রমিথিউসকে ককেশাসের এক খাড়া পর্বতগাত্রে অনন্তকালের জন্য শৃঙ্খলিত করে রাখার নির্দেশ দেন। প্রতিদিন একটি ঈগল এসে শেকলবদ্ধ প্রমিথিউসের কলিজা ঠুকরে ঠুকরে খেতো। রাতে আবার প্রমিথিউসের আধা খাওয়া কলিজা প্রতিস্থাপন করা হতো। পরদিন ঈগলটি আবার এসে তার কলিজা খেতো। অবশেষে হেরাক্লিস তাকে মুক্ত করেন এবং মর্যাদাপূর্ণ জীবনের আস্বাদ দেন। বিশ্ব সভ্যতায় এই কাহিনীর অবদানকে কি আমরা অস্বীকার করবো? আমরা যদি এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিংকে সভ্যতার মাপকাঠি ধরি তাহলে এই গল্পের মূল্য নেই। কিন্তু সভ্যতার মাপকাঠি হওয়া উচিৎ প্রযুক্তি, শিল্প, সাহিত্য, প্রচলিত বিশ্বাস, রুপকথা, উপকথা — সব-ই। একইভাবে বিবর্তনবাদের বিপরীতে এডাম এন্ড ইভ স্টোরির যে আকাশচুম্বী অবদান আছে তা আমরা অনুধাবন করি না; কারণ এই উপলব্ধি পরিমাপের কোনো মাপকাঠি নেই।

সোভিয়েত রূপকথার একটা গল্প শুনুন: দাওয়ায় ছিলো এক আঁটি কাঠ। আঁটির ওপর উড়ে বসলো মুরগী। বসতেই আঁটি খুলে পৈঠায় কাঠ ছড়িয়ে পড়লো। আঁতকে উঠলো মুরগী, ক্যাঁকক্যাঁকিয়ে ছুটলো উঠোন দিয়ে। ছোটে আর ক্যাঁক ক্যাঁক করে:
“আকাশ ভেঙে পড়েছে গো! আকাশ ভেঙে পড়েছে!”
“কে তোকে বললে?” জিজ্ঞেস করলে মোরগ।
“নিজে চোখে দেখেছি!নিজে কানে শুনেছি!”
মোরগ ভাবলে, ‘তাহলে তো ঠিকই!’ দু’জনে মিলে ছুটলে ঘন বনের দিকেৃ
(ননী ভৌমিকের অনুবাদ। সেখানে ক্রিয়াপদগুলো এভাবেই লেখা হয়েছে।)

গল্পটা আমি ইচ্ছা করে শেষ করলাম না। খেয়াল করে দেখুন গল্পের শেষটা জানতে আপনার অনেক ইচ্ছা হচ্ছে। এমনও হতে পারে পুরা আর্টিকেলের এই অংশে এসে আপনার বেশি ভালো লাগতে শুরু করেছিল। এ থেকে প্রমাণ হয় না যে আপনি গল্পটা বিশ্বাস করেছেন। তাই এরকম ভাবতে দোষ নেই যে কল্পনাশ্রয়ী হলেও রুপকথা মানব সভ্যতার জন্য অনেক মূল্যবান কিছু; বিশেষ করে তাতে যদি স্বর্গ থাকে।
hassangorkii@yahoo.com
রয়্যাল রোডস ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া, ব্রিটিশ কলম্বিয়া, কানাডা।