অনলাইন ডেস্ক : তুরস্কে ভয়াবহ ভূমিকম্পে ধ্বংস্তূপের নিচে চাপা পড়াদের উদ্ধারে সময় ফুরিয়ে আসছে দ্রুত। এরমধ্যে উদ্ধারকারীদের কাজ আরও কঠিন করে তুলছে তুষারপাত ও বৃষ্টি।

তুরস্ক ও সিরিয়ার সীমান্তে সোমবার ভোরের ভূমিকম্পে ৫ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে, আহত হয়েছে ১৫ হাজারের বেশি মানুষ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সতর্ক করে দিয়েছে মৃতের সংখ্যা নাটকীয়ভাবে বেড়ে যেতে পারে। জীবিতদের উদ্ধারে উদ্ধারকারী দলগুলো তাদের তৎপরতা জোরদার করেছে।

আদানা নামে একটি শহরে রাতভর ভারী যন্ত্রপাতির সাহায্যে উদ্ধার কাজ চলেছে। ধসে পড়া ভবন এবং কংক্রিটের বিশাল স্ল্যাবগুলো আলোকিত করে রাখছেন উদ্ধারকারীরা।

তুরস্কের গোটা দক্ষিণাঞ্চল জুড়ে এই একই দৃশ্য।

যখন কাউকে জীবিত উদ্ধার করা যাচ্ছে বা কারও লাশ পাওয়া যাচ্ছে উদ্ধারকারীরা কাজ বন্ধ রেখে ‘আল্লাহু আকবর’ বলে চিৎকার করে উঠছেন।

গোটা আদানা শহরে এখন গৃহহীন মানুষ। ঘরবাড়ি টিকে গেছে এমন অনেকে ফের ভূমিকম্পের ভয়ে ঘরেও ফিরতে চাচ্ছেন না। খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করছেন এমন অনেকের পায়ে জুতা নেই, ভালো শীতবস্ত্র নেই, ফোনের চার্জার নেই। এদিকে সপ্তাহ শেষে তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে নামবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থার (ইউএসজিএস) তথ্য অনুযায়ী, স্থানীয় সময় সোমবার ভোর ৪টা ১৭ মিনিটে গাজিয়ানতেপ শহরের কাছে ভূপৃষ্ঠের ১৭.৯ কিলোমিটার নিচে ৭.৮ মাত্রার ভূমিকম্পটি আঘাত হানে।

পরে আরও একটি শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানে, রিখটার স্কেলে যার মাত্রা ছিল ৭.৫। এর কেন্দ্রস্থল ছিল কাহরামানমারাস প্রদেশের এলবিস্তান নামক জেলায়।

মঙ্গলবার সকালে ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থলের কাছাকাছি তুরস্কের মারাস শহরের প্রধান সড়কে যান চলাচল বন্ধ ছিল।

গাড়িগুলো খুব ধীরগতিতে সামনের দিকে এগোতে পারছে। ভেজা রাস্তায় লাল ব্রেক লাইটের আলো প্রতিফলিত হচ্ছে বারবার। খুবই স্বল্পসংখ্যক উদ্ধারকারী এখন পর্যন্ত দক্ষিণ তুরস্কের এই অংশে পৌঁছাতে পেরেছেন।

উদ্ধারকাজের জন্য প্রয়োজনীয় নানা সরঞ্জাম বোঝাই করে গাড়িতে ওই শহরে যাওয়ার পথে একটি দলের একজন সদস্য বিবিসিকে বলেন, আমরা জীবিতদের উদ্ধারে কাজ শুরু করার অপেক্ষায় ছিলাম। কিন্তু সেখানকার পরিস্থিতি কতটা খারাপ সে সম্পর্কে কোনো ধারণা তখনো তাদের নেই।

তুরস্কের দুর্যোগ ও জরুরি ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ (এএফএডি) জানিয়েছে, এ পর্যন্ত ৪ হাজার ৭শ ভবন থেকে ৮ হাজার মানুষকে উদ্ধার করা হয়েছে।

এদিকে আফটারশক অব্যাহত থাকায় কিছু এলাকায় উদ্ধারকারীরা খালি হাতে ধ্বংসস্তূপ খনন করে যাচ্ছেন। কিন্তু তীব্র ঠান্ডায় সে কাজও ব্যাহত হচ্ছে।

বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দক্ষিণাঞ্চলীয় হাতায় প্রদেশে ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে সাহায্যের জন্য এক নারীর আর্তনাদ শোনা গেছে।

ডেনিজ নামে এক বাসিন্দা কাঁদতে কাঁদতে বলেন, তারা শব্দও করছে, কিন্তু কেউ আসছে না।

তিনি আরও বলেন, ‘এখানে সব ধ্বংস হয়ে গেছে, সব। আল্লাহ… তারা ডাকছে, ওরা বাঁচাও বাঁচাও বলছে, কিন্তু আমরা তাদের বাঁচাতে পারছি না। আমরা পারব কীভাবে, সকাল থেকে এদিকে কেউ আসেইনি।

নিউক্যাসলের হয়ে ১০৭টি ম্যাচ খেলা ঘানার ফুটবলার ক্রিশ্চিয়ান আতসুকে হাতায়ে শহরের একটি ভবনের ধ্বংসস্তূপ থেকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে বলে তার্কিশ রেডিওকে জানিয়েছেন তার ম্যানেজার মুস্তাফা ওজাত।

আতসু এখন খেলেন তুর্কি ক্লাব হাতায় স্পোরের হয়ে। ক্লাবের ডিরেক্টর তানের সাভুত এখনও ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা আছেন বলেও জানিয়েছেন ওজাত।

ভূমিকম্পের কেন্দ্রের কাছের একটি শহর তুরস্কের ওসমানিয়েত। বৃষ্টির কারণে সেখানে উদ্ধারকাজ ব্যাহত হচ্ছে। বৃষ্টির সঙ্গে রয়েছে ঠান্ডাও, তারমধ্যে শহরটি বিদ্যুৎবিহীন অবস্থাতেও ছিল।

তীব্র ঠান্ডা (হিমাঙ্কের সমান তাপমাত্রা) থাকা সত্ত্বেও একটি পরিবার আবার ভূমিকম্পের ভয়ে রাস্তাতেই থাকছে। যখনই কোনো আফটারশক অনুভব করছে পরিবারটি রাস্তার মাঝে চলে যাচ্ছে।

ওই শহরের এক হোটেল মালিক বিবিসিকে বলেছেন, ভূমিকম্পের রাতে তার হোটেলে ১৪ জন অতিথি ছিলেন, মাত্র সাতজনকে পাওয়া গেছে।

বিভিন্ন দেশ উদ্ধার প্রচেষ্টায় সহায়তা করা শুরু করেছে। কিন্তু ভূমিকম্প তুরস্ক জুড়ে তিনটি বিমানবন্দরের বড় রকমের ক্ষতি করেছে। এটিও সাহায্য সরবরাহের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।

সিরিয়ায় এখন পর্যন্ত অন্তত ১৬শ জনের নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। তুর্কি সীমান্তের শিবিরগুলোতে লাখো শরণার্থীর বাস।

সাহায্যের জন্য আন্তর্জাতিক আবেদনের পর ৪৫টি দেশ থেকে সাড়া পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন তুরস্কে অনুসন্ধান ও উদ্ধারকারী দল পাঠাচ্ছে। নেদারল্যান্ডস ও রোমানিয়ার উদ্ধারকারীরা ইতোমধ্যে রওয়ানা হয়েছে। যুক্তরাজ্য বলছে তারা ৫৬ জন বিশেষজ্ঞ, সরঞ্জাম ও উদ্ধারকারী কুকুর পাঠাবে।

ফ্রান্স, জার্মানি, ইসরায়েল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইরানের মতো তুরস্ক ও সিরিয়া দুই দেশকেই সাহায্যের প্রস্তাব দিয়েছেন।

তুরস্ক বিশ্বের অন্যতম সক্রিয় ভূমিকম্প প্রবণ অঞ্চলে অবস্থিত।

১৯৯৯ সালে দেশটির উত্তর-পশ্চিমে একটি ভূমিকম্পে ১৭ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। ১৯৩৯ সালে পূর্বাঞ্চলীয় এরজিনকান প্রদেশে ভূমিকম্পে ৩৩ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়।

সোমবারের ভূমিকম্পটি এতই শক্তিশালী ছিল যে তা তুরস্ক ছাড়াও সাইপ্রাস, লেবানন ও ইসরায়েলের মতো দূরের দেশেও অনুভূত হয়।

সূত্র : বিবিসি।