বিদ্যুৎ সরকার: সেদিন হঠাৎ করে সুতপার কথা মনে পড়ে গেল। বিগত ত্রিশ বছরে একবারও যার কথা আমার মনে হয়নি। কিশোরগঞ্জে পাশের বাড়িতে ওরা থাকত। তখন কিশোরগঞ্জ উপজেলা হিসেবেও বেশ পরিচিত ছিল এর ব্যবসা- বাণিজ্য, খেলাধুলা, সাংস্কৃতি কর্মকান্ডের জন্যেই। সুতপরা তিন বোন- অনুপমা, নিরূপমা ও সুতপা। সুতপা ছিল সবার ছোট। সন্ধ্যেতে তিন বোনই গান শিখতো ওস্তাদজীর কাছে, তাদের একটি গান আমি প্রায়ই শুনতাম এবং ভালও লাগতো- তুমি যে সুরের আগুন লাগিয়ে দিলে মোর প্রাণে। তখন খুবই কঠিন মনে হতো। তবে শুনতে শুনতে ভাল লেগে যেতো এবং এক সময় কয়েটি গান মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল আমার। তখন পাড়ায় পাড়ায় সাংস্কৃতি অনুষ্ঠান হতো, নাটক হতো শীত এলে, পাড়ার ছেলে মেয়েরাই এতে অংশগ্রহণ করতো। সবাই চাঁদা দিয়ে অনুষ্ঠান আয়োজনে সহযোগিতা করত। বড়রা গুরু দায়িত্বগুলো পালন করতো। আমরা শুধু বড়দের নির্দেশের অপেক্ষায় থাকতাম কখন কি করতে হবে আমাদের। সুতপা অনুষ্ঠানে নিজেই হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান করত প্রায় চোখ বুজেই, মিষ্টি কন্ঠে। গান শেষে সবাই যখন জোড়ে হাততালি দিত আমি অবাক হয়ে শুনতাম আমার ভীষন ভাল লাগত। কেন এত ভাল লাগত আমি বুঝতাম না, জানতাম না। সুতপা ও আমি একই ক্লাসে পড়তাম। যার দারুন প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে ওর সাথে দেখা হওয়ার সুযোগ হয়ে যেতো আমার। আর যেহেতু পাশের বাড়িতে ওরা থাকতো মা আমাকে প্রায়ই পাঠাতো ভাল কিছু রান্না হলে দিয়ে আসার জন্য। তখনও সুতপার সাথে দেখো হতো কথা হতো, নরম স্বভাবী নদীর মতোন তার চলাচল। শীতের সকালগুলোতে পূজোর ফুল কুড়োতে যেতো সুতপা। আমিও যেতাম, ফুল কুড়োতে কুড়োতে নানান কথার বিনিময় – যেন সুগন্ধ মাখা ফুলের সরভি ছড়াতো চারপাশে। যখন শিউলী ফুলগুলো উঁচু ডাল থেকে খঁসে পড়তো তখন অবাক হয়ে চেয়ে চেয়ে দেখতাম দু’জনে। কেমন করে ধীরে ধীরে, ঘুরে ঘুরে খাসের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে। ফুল ঝরে পড়ার এ দৃশ্য দু’জনে উপভোগ করতাম। কোন ফুলটি কত দেরিতে মাটিতে স্পর্শ করে সেটাই ছিল দেখার বিষয়। টুপ টুপ বিনম্র প্রায় নিঃশব্দ কোন ধ্বনি আমার হৃদয়ে প্রতিধ্বনিত হতো তখন। ভোরের রোদের ম্লান উপস্থিতি, কুসুম গরম রোদে উষ্ণতা ঘরে ফেরার ইঙ্গিত বয়ে আনত। আমরাও ফিরে আসতাম নিজ বাসভূমে। পরবর্তী ভোরের আশায়, সূর্যদয়ের মত হেসে।
অজানা এক ঝলক সুখের পরশ সমস্ত দেহ ছুঁয়ে যেত তখন। রাত পোহালে সুতপা’র দেখা পাব, এ লক্ষে রাতের অন্ধকারকে গুলতির মতো টেনে আবার ছেড়ে দিতাম নির্ভুল নিশানায়।
পয়ষট্রি সালের এক চাঁদ পোড়ানো রাতে সুতপারা সবাই চলে গেল ওপার বাঙলায়। কেউ জানতে পারেনি কেন তাদের এভাবে চলে যেতে হয়ে ছিল। সেদিন সকাল থেকেই সুতপার প্রিয় বিড়ালটি আমাদের বাসায় এসে ঘুর ঘুর করছিল। কেন একবারও সুতপা আমাকে বলেনি যে ওরা চলে যাচ্ছে। তারতো পঞ্চম শ্রেণীর বৃত্তি পরীক্ষা দেয়ার কথা ছিল। তবে কী সে আর পরীক্ষা দেবে না? পাড়ার অনুষ্ঠানে সুতপা আর গান গাইবে না? সাত সকালে শিউলি ফুল ঝড়ে পড়ার দৃশ্য আর দেখা হবে না এক সাথে? শিউলি ফুলের সকল সুবাস বুঝি ছড়িয়ে পড়ল পৃথিবীর সকল প্রান্তে আকাশে বাতাসে। শেষ সুঘ্রাণটুকু টেনে নিলাম পাজর ভরে। একি ভুল ভাললাগার, ভুল দহন! এক বুক শূন্যতায় ভরে থাকে হৃদয় সারাক্ষণ। সুতপা তোমার দিগন্তে এখনও কী শিউলী ফুল ফোটে, সুবাস ছড়ায়? টরন্টোর আকাশে কোন দিনই শিউলি ফুল ফোটবে না, তুমি জেনে রেখো সুতপা।
বিদ্যুৎ সরকার : লেখক ও আলোকচিত্রী, টরন্টো, কানাডা