ইউসুফ কামাল : সতের.
সম্পর্কটা বাকী জীবনের জন্য ধরে রাখার জন্য সবার ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফল মিললো তৃতীয় দিনে। উর্মিলা অসীম ধৈর্য্যের সাথে তিনটে দিন এক হাতে সামলে নিয়েছে সব কিছু। অফিস থেকে ইলার সাথে নিজেও ৭ দিনের ছুটির ব্যবস্থা করে নিয়েছে কোথাও যেন কোন সমস্যা না হয়। শাহেদ দেখলো উদারমনা একজন নারীকে, কি ভাবে একা সব কিছু গুছিয়ে নিচ্ছে। সবাই জানে আমেরিকা ব্যক্তি স্বাধীনতার দেশ, প্রাপ্ত বয়স হবার পর তাদের মতামতের উপর কারো খবরদারির সুযোগ নেই। রাষ্ট্রীয়ভাবেই সবাইকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে নিজের পছন্দের পথ বেছে নেওয়ার। আঠারো বছর হওয়ার পর সন্তান ইচ্ছা করলে পিতা মাতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আলাদা থাকতে পারে, এ বিষয়ে কারো কোন রকম প্রতিবন্ধকতা করার অবকাশ নেই। এটা রাষ্ট্রীয়ভাবেও স্বীকৃত। শাহেদ বুঝে নিয়েছে ইলার জীবনে এখন আর তার বিকল্প কেউ নেই, পরিবারের সবার উপর তার অভিমানের কারণে সে সবার থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছে। মাঝ সমুদ্রে নিরবিচ্ছিন্ন এক দ্বীপের মতো দাঁড়িয়ে আছে একাকী জীবন যুদ্ধরত এক সৈনিকের অবয়বে। ইলার পারিপার্শ্বিক সব কিছু জেনে বুঝেই উর্মিলা ওকে হাতে ধরে সংগ্রাম করতে শিখিয়েছে, শিখিয়েছে কি ভাবে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকা যায়। বুঝেছিলো মেয়েটাকে বাঁচানোর এটাই একমাত্র পথ। না হলে কোথায় কোণ অন্ধকারে যে হারিয়ে যাবে ভেবে ও শিউরে উঠেছিলো।

শাহেদ বর্তমান পর্যন্ত আগাগোড়া সব কিছু চিন্তা করে অবাক হয়েছে উর্মিলার মতো এমন মানুষ পৃথিবীতে এখনও আছে? যেটা সত্যিই বিরল। ছোট শিশুকে আঙ্গুল ধরে হাঁটতে শেখানোর মতোই ইলাকে পরম যত্নে বেঁচে থাকতে শিখিয়েছে। যেমন শিখিয়েছে কি ভাবে ব্যস্ত শহরের ব্যস্ত সড়কে একা জেব্রা ক্রসিং দিয়ে রাস্তা পার হতে হয়। ছোট বোনের আদর স্নেহসহ সার্বক্ষণিকভাবে দুহাতে আগলে রেখেছে। ইলা মাঝে মাঝে ভাবে, জীবনে হয়তো এমন কোন পূণ্য সে করেছিলো যাতে উর্মিলার মতোন এমন একজন তার জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। আপন বোনের মতো ওকে বিপদ সংকুল পথ পার করে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সাহায্য করে যাচ্ছে। ওর নিজের দিক থেকে এখন সামান্যতম অবহেলা ইলার জীবনে ডেকে আনতে পারে মহাবিপর্যয়, এটা শাহেদ বুঝে ফেলেছে। তাই সব কিছু মিলিয়ে ইলার জীবনে সামান্যতম ক্ষতি হোক শাহেদ সেটা এখন আর কোন মতেই মেনে নিতে পারবে না। অদ্ভুত এক ভালোবাসাময় মমত্ববোধ ওর প্রতি গড়ে উঠেছে শাহেদের, আমেরিকা এসে এবার ইলাকে দেখার পর থেকে সেটা যেন আরো বেশি করে অনুধাবন করতে পারছে। চেহারায় একটা নিস্প্রভ ভাব ফুটে উঠেছে, যেটাতে শাহেদ প্রথম দেখাতেই প্রচন্ড কষ্ট পেয়েছে। কষ্ট পাওয়ার সাথে সাথে শাহেদ এ জন্যে সরাসরি নিজেকেই দায়ী মনে করলো। মনে পড়লো কলেজে আসা যাওয়ার সময় ছাড়াও ক্লাস না থাকলে ছাত্রছাত্রীদের সাথে কলেজের পুকুর পাড়ে বসে গল্প করে সময় কাটাতো। জীবনের রংগীন স্বপ্নের সূচনাগুলো বোধ হয় তখন থেকেই ডানা মেলতে শুরু করেছিলো অতি সংগোপনে। কেউই কাউকে মুখে প্রকাশ না করলেও ভিতরে ভিতরে তখনই বেশি করে ভালো লাগতে শুরু করেছিলো।

ল’ইয়ারের সাথে আলোচনার সময় উর্মিলা শাহেদকে সাথে করে নিয়ে গিয়েছিল পরিস্থিতি সহজ করার জন্য। আর হলও তাই শাহেদ থাকাতে অনেক বিষয়ে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে আসা সহজ হলো। উর্মিলা আর তার ল’ইয়ার দু’জন মিলে দু’জনের আইডি, এভিডেভিটসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংযোজন করে দ্রæততম সময়ের মধ্যে সব কিছু প্রস্তুত করে ফেল্লো যাতে কোর্টে কোন সমস্যা না হয়। আর কোন সমস্যাও হলো না, সব কিছু ঠিকঠাক মতোই সম্পন্ন হয়ে গেলো। কোর্ট দু’জনের সম্মতি নেওয়ার মধ্য দিয়ে নতুনভাবে দাম্পত্য সম্পর্কের স্থায়ী রুপ প্রদান করে দিলো। আড়ম্বরহীন এক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে দুজন প্রবেশ করলো জীবনের কাংখিত অধ্যায়ে। নতুন এক দৃশ্য প্রত্যক্ষ করলো শাহেদ ইলা আর উর্মিলার দিকে তাকিয়ে। ইলাকে জড়িয়ে ধরে উর্মিলা বলে উঠলো, এবার আমায় ছুটি দাও। চোখে তখন ওর আনন্দের অশ্রু। ইলা আরো জোরে জড়িয়ে ধরলো উর্মিলাকে বল্লো, আমি পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ার আগ পর্যন্ত তোমার কোন ছুটি নাই, তুমি না থাকলে আমার কি হবে? তোমার সাথে যে আমার জন্ম জন্মান্তরের সম্পর্ক, তুমিই এখন আমার সব কিছু। তুমি ছিলে বলেই আমি নিজেকে আবার খুঁজে পেয়েছি। সবাইকে ফিরে পেয়েছি সেই সাথে পেয়েছি নতুন করে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা।

তড়িৎ গতিতে দৃশ্যটা সবার মধ্যেই সংক্রমিত হয়ে গেলো। সবাই যেন আবেগ প্রবন হয়ে উঠলো। আবেগে ইলা ওকে ছাড়তেই চাইছে না, শাহেদের মনে হলো বিবাহ পরবর্তি কন্যা বিদায়ের মূহুর্তের মা মেয়ের সেই চিরাচরিত দৃশ্য যেন। দু’জনের চোখেই সেই একই অশ্রুধারা যেটা দুঃখের নয়, আনন্দের। (শেষ)

ইউসুফ কামাল : কেটি, টেক্সাস, ইউএসএ