অনলাইন ডেস্ক : কভিড ও ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক সংকট চলছে। স্থানীয় মুদ্রার তুলনায় বেড়েছে ডলারের দাম। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। তাই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের পক্ষ থেকে অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসপণ্য আমদানি নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ‘বিলাসপণ্য’ হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় শতভাগ এলসি মার্জিনের আওতাভুক্ত করা হয় গাড়ি আমদানি। কিন্তু তাতে গাড়ি আমদানি ঠেকানো যাচ্ছে না। গত অর্থবছরে (২০২১-২২) আগের অর্থবছরের চেয়ে ছয় হাজার ৭৯৯টি গাড়ি বেশি আমদানি হয়েছে। মোট গাড়ি আমদানিতে পাঁচ বছরের মধ্যে রেকর্ডও হয়েছে গত অর্থবছরে।

সূত্র জানায়, সরকারের নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই ২০২১-২২ অর্থবছরে রেকর্ডসংখ্যক গাড়ি আমদানি হয়েছে দেশে। এদিকে বিলাসপণ্যের এলসি নিয়ন্ত্রণ করায় এলসি ছাড়াই গাড়ি আনছেন ব্যবসায়ীরা। ফলে এলসিবিহীন গাড়ি আমদানি ব্যয় কিভাবে শোধ হবে এবং চট্টগ্রাম কাস্টমস কিভাবে শুল্কায়ন করবে, তা নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, মূল্যস্ফীতি মোকাবেলা, ডলারের বাজার স্থিতিশীল রাখা এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন ঠেকাতে ২০২২ সালের ১১ এপ্রিল পণ্য আমদানিতে লাগাম টানে ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। পরে ৪ জুলাই দেশের মুদ্রা ও ঋণ ব্যবস্থাপনা অধিকতর সুসংহত রাখার লক্ষ্যে মোটরকার (সেডান কার, এসইউভি, এমপিভি), ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিকস হোম অ্যাপ্লায়েন্স, স্বর্ণ ও স্বর্ণালংকার, মূল্যবান ধাতু, মুক্তা ও তৈরি পোশাক আমদানিতে এলসির শতভাগ নগদ মার্জিন সংরক্ষণের নির্দেশ দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু এত কড়াকড়ির মধ্যেও গাড়ি আমদানির রেকর্ড হয়েছিল ২০২১-২২ অর্থবছরে।

সূত্র বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে ৩৪ হাজার ৭২১টি গাড়ি আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে মোংলা বন্দর দিয়ে ২০ হাজার ৮০৮টি গাড়ি আমদানি হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে একই সময়ে ১৩ হাজার ৯১৩টি গাড়ি আমদানি হয়েছে, যা বিগত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। ডলার সংকটেও বিলাসপণ্য গাড়ি আমদানি বাড়ায় রিজার্ভের সংকট বাড়তে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

এদিকে ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে ২৭ হাজার ৯২২টি গাড়ি আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে মোংলা বন্দর দিয়ে ১৪ হাজার ৪৭৪টি গাড়ি এসেছে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ১৩ হাজার ৪৪৮টি গাড়ি আমদানি হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে গাড়ি এসেছে ১৭ হাজার ৯৩টি, এর মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দর ও মোংলা বন্দর দিয়ে যথাক্রমে চার হাজার ৮০০টি এবং ১২ হাজার ২৯৩টি গাড়ি এসেছিল। এর আগের অর্থবছরে অর্থাৎ ২০১৮-১৯ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে গাড়ি খালাস হয়েছিল ১২ হাজার ৫০১টি ও মোংলা বন্দর দিয়ে গাড়ি এসেছিল ১২ হাজার ৬৯৫টি। অর্থাৎ ২০১৮-১৯ অর্থবছরে গাড়ি এসেছিল ২৫ হাজার ১৯৬টি।

জানা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরেও গাড়ি আমদানি অব্যাহত রয়েছে। বৈশ্বিক সংকটে জাপানে গাড়ির দাম হ্রাস পাওয়ায় আমদানিকারকরা নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই গাড়ি আমদানি করছেন। যদিও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে বিপাকে পড়ছেন উদ্যোক্তারা।

এনবিআর সূত্রে জানা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরের শুধু নভেম্বর মাসেই দেশে ৬৫০টি গাড়ি এলসিবিহীনভাবে আমদানি হয়েছে। আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান এইচএনএস অটোমোবাইলস, মরিয়ম এন্টারপ্রাইজ, জিএম ট্রেডিং, এসএসআরএ এন্টারপ্রাইজ ও নাগোহা করপোরেশন গত ১০ ও ২২ নভেম্বর ভেসেল লোটাস লিডার ও মালয়েশিয়া স্টার জাহাজে করে ৯৩৪টি গাড়ি আমদানি করে। আমদানি হওয়া গাড়িগুলোর মধ্যে ৫৮৫টি চালানের মাধ্যমে আমদানি করা হয়। এর মধ্যে আমদানি-রপ্তানি নীতি অনুযায়ী করা হয়েছে ২৮৪টি, বাকি ৩০১টি চালানের এলসি নেই। এই ৩০১টি চালানের বিপরীতে গাড়ি এসেছে ৬৫০টি। এখন এলসিবিহীন গাড়ি চালানের শুল্কায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে এলসি ও এলসিবিহীন গাড়িগুলো চট্টগ্রাম কার শেডে রয়েছে।

আমদানি নীতি আদেশ আমদানি-রপ্তানি আইন ১৯৫০ অনুযায়ী, কোনো পণ্য বিদেশ থেকে আমদানি করতে হলে সঠিকভাবে পণ্যের শনাক্তকরণ কোড (এইচএস) উল্লেখ করে অনুমোদিত বাণিজ্যিক ব্যাংকে এলসি বা ঋণপত্র খোলার মাধ্যমে আমদানি করতে হবে।

আমদানি সাধারণ ম্যানিফেস্টো (আইজিএম) অনুযায়ী, পণ্যের বিবরণ সঠিক থাকলে রপ্তানিকারকের দেশ থেকে পণ্য জাহাজীকরণ করে আমদানিকারকের বন্দরে পণ্য আনলোড করা হয়। সব ধরনের আমদানির ক্ষেত্রে পণ্য, পণ্যের মোড়ক ও কনটেইনারের গায়ে ‘কান্ট্রি অব অরিজিন’ সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হয়। কিন্তু ৬৫০টি গাড়ির ক্ষেত্রে যথাযথ পক্রিয়া পরিপালন করা হয়নি।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এর আগেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে এলসিবিহীন গাড়ি আমদানি করা হলেও ডলার সংকট না থাকায়, পণ্য বন্দরে পৌঁছানোর পরেও এলসি করায় কোনো ধরনের জটিলতা সৃষ্টি হয়নি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা গেছে, আমদানিকারকরা গাড়ি আমদানির পথিমধ্যে এলসি সম্পন্ন করে গাড়ি খালাস করেছেন। কিন্তু এবার ডলার সংকটের কারণে গাড়ি আমদানি সম্পন্ন হলেও এলসি করা সম্ভব হয়নি, যার কারণে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। এলসিবিহীন গাড়িগুলোর আমদানিকারকরা এলসি খোলার চেষ্টা করছেন বলে জানা যায়।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সূত্রে জানা যায়, এলসিবিহীন আমদানীকৃত গাড়ির বেশির ভাগই আমদানি করেছেন গাড়ি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান এইচএনএস অটোমোবাইলসের স্বত্বাধিকারী শহিদুল ইসলাম। গত ১০ ও ২২ নভেম্বর আমদানি করা ৯৩৪টি গাড়ির মধ্যে তাঁর প্রতিষ্ঠানের নামে রিকন্ডিশন্ড গাড়ি এসেছে ২৫টি। মরিয়ম এন্টারপ্রাইজ, জিএম ট্রেডিং, এমএসআরএ এন্টারপ্রাইজ ও নাগোহা করপোরেশনের নামে যথাক্রমে ১৯, ১২, ১০ ও ১০টি গাড়ি এসেছে। এই ৭৬টি গাড়ি ছাড়াও বাকি গাড়িগুলো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে এসেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনবিআরের একজন কর্মকর্তা বলেন, এলসি ছাড়া গাড়িগুলো এলেও অবৈধভাবে অর্থ পরিশোধের কোনো সুযোগ নেই। কারণ হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পরিশোধ করা গেলেও গাড়ি ছাড়ানোর কোনো বৈধ কাগজপত্র পাবেন না আমদানিকারকরা। এই লোকসানের মাধ্যমে কোনো আমদানিকারক গাড়ি আমদানি করবেন না। তিনি বলেন, বৈশ্বিক মন্দার কারণে গাড়ির মূল্য কমে যাওয়ায় অধিক লাভের আশায় এলসি ছাড়াই গাড়িগুলো আমদানি করা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।

জানতে চাইলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, দেশে এখন ডলার সংকট চলছে। বিষয়টি মাথায় রেখে অপ্রয়োজনীয় কিংবা কম প্রয়োজনীয় কিছু আমদানি নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা সাময়িক হিসেবে নিতে হবে। সেটা হতে হবে আমদানি বিকল্প বাজার সৃষ্টির উদ্দেশ্যে।