ডঃ বাহারুল হক : মরে যাওয়া কত সহজ! শুধু নেমে পড়লেই হলো। হাজারটা উপায় চোখের সামনে খোলা। অথচ বেঁচে থাকা কি কঠিন! পদে পদে বাঁধা, পদে পদে বিড়ম্বনা। তারপরও মানুষ বেঁচে থাকে। বেঁচে থাকতে চায়। জীবনের প্রতি তার প্রবল আকর্ষণ প্রকাশ করে যায়। কঠিন কে মানুষ আপন করে নেয় এবং তার মাধ্যমে প্রকাশ করে মানুষ হিসেবে তার অমিত শক্তি; এখানেই তার বিশেষত্ব। মানুষ বিশেষ বলেই সব বাধা-বিপত্তি, সব দুঃখ-কষ্ট, সব অত্যাচার-নিপিড়ন-অবিচার-অপমান, সহ্য করে, সব প্রতারনা-বঞ্চনা-বিড়ম্বনা ভুলে ক্রমাগত শক্তি সঞ্চয় করে চলে শুধুই বাঁচার লক্ষে, শুধুই বেঁচে থাকার জন্য। বার বার কখনো দৃপ্ত কণ্ঠে কখনোবা নিরবে বলে যায়, সে মানুষ, সে কঠিনের পূজারী। যে পরাজয় মেনে নেয়, হতাশার কন্টক বিছানো চাদরে নিজেকে মুড়িয়ে কোন কিছুর দিকে বা কারো দিকে না তাকিয়ে মৃত্যুর মত অতি সহজিয়া কিছুকে আলিঙ্গন করে সে তো মানুষই নয়। তার মানব জনম বৃথা। অবশ্য, দুঃখে তো বটেই কেউ কেউ কোন কোন সময় পরম সুখে থেকেও মরণের প্রতি আকর্ষিত হয়ে পড়ে। এই যেমন রবীন্দ্রনাথ। ১৮৮১ সনে। যৌবনের থৈ থৈ জলে হাত পা মেলে ভাসমান সুদর্শন ২০ বছর বয়সী এই জমিদারপুত্র হঠাৎ জানান দিলেন মরণের প্রতি তার গভীর টান। তিনি লিখলেন-
“মরণ রে, উঁতু মম শ্যাম সমান। উঁহু মম মাধব উঁহু মম দোসর। তুহু মম তাপ ঘুচাও।
মরণ তু আও রে আও।” মাঝে মাঝে আপনার আমার ভাবনাও এই নন্দিত জমিদার পুত্রের ণিকের সেই ভাবনার সাথে একাকার হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথের মত আপনি আমি সবাই বলি- “দু র! আর বাঁচতে ইচ্ছা করে। ইচ্ছা হয় মরে যাই”। কিন্তু এসবই কথার কথা। আমরা মরি না। আমরা শেষ পর্যন্ত জীবনের পথেই হাঁটি। রবীন্দ্রনাথও জীবনের মায়া ত্যাগ করেন নি। ১৮৮১ সনে যে মরণকে শ্যাম এর মত ভালোবেসেছিলেন সেই তাকে তাড়িয়ে দিয়ে তিনি জীবন নিয়ে বেঁচে ছিলেন আরো ৬০ বছর, ১৯৪১ সাল পর্যন্ত। এমন কি জীবনের বেলা শেষেও তিনি তার জীবনকে আরো দীর্ঘায়িত করার জন্য বিধাতার কাছে প্রার্থনা করেছিলেন। তার সে প্রার্থনা, আকুতি অতি চমৎকারভাবে তিনি প্রকাশ করেছেন ‘জীবনদেবতা’ নামক তার অসাধারণ এক কবিতায়। রবীন্দ্রনাথ, আমি, আপনি সবাই যে মানুষ। আর মানুষের অবিরাম প্রচেস্টাতো বেঁচে থাকার জন্য, মরণের জন্য নয়। নিরন্তর প্রার্থনা করে যাচ্ছি- পরম দয়াময় যেন সবাইকে দীর্ঘ জীবন দান করেন; বেঁচে থাকার বিরামহীন সংগ্রামে লিপ্ত প্রত্যেকটা মানুষ যেন পরম দয়াময়ের অশেষ কৃপা লাভ করেন।
রবীন্দ্রনাথ ১৯১৩ সনে নোবেল প্রাইজ পেলেন। প্রাইজ পাওয়ার পরই বঙ্গীয় কমিউনিস্টরা হৈ চৈ চিৎকার জুড়ে দিল- কেন রবীন্দ্রনাথকে প্রাইজ দেয়া হলো? এ প্রাইজতো রবীন্দ্রনাথ কিছুতেই পেতে পারেন না। তিনিতো শোষিত, শ্রমজীবি, বঞ্চিত, প্রলেতারিয়েত শ্রেণীর মানুষের জন্য কিছু লিখেন নাই। তিনি গান কবিতা যা লিখেছেন সবইতো ঘুমপাড়ানিয়া। সবই সুবিধাভোগি, এলিট শ্রেণীর মানুষের জন্য। এভাবে তীর্যক কথায় রবিন্দ্রনাথকে তুচ্ছ ছোট করার অবিরাম প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছিলেন কমিউনিস্টরা। রবীন্দ্রভক্তরা মর্মাহত প্তি। তারা রবীন্দ্রনাথকে বললেন- গুরুদেব, কিছু বলুন, এভাবেতো চলতে পারে না। আর তো সহ্য করতে পারছি না।
রবীন্দ্রনাথ ধীর শান্ত গলায় শুধু বললেন
আমার কবিতা সে জানি আমি,
গেলেও বিচিত্র পথে, হয়নি সে সর্বত্রগামী।
কি অকপট স্বীকারোক্তি! বড় মানুষেরা এরকমই হয়। তারা কখনো বলে না- আমি সম্পূর্ণ, আমার কোন ভগ্নাংশ নাই, আমি সব জানি, সব বুঝি, সব দিয়েছি, সব শুনেছি, সব আমি করেছি।
আগামী ২২ অক্টোবর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। অগ্রীম ভোট প্রদান ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচন। নির্বাচিত হবেন টরন্টো শহর ব্যাপি বিভিন্ন ওয়ার্ডের জন্য সিটি কাউন্সিলর। প্রচারের ধুম লেগেছে। শহরের যেখানেই যাই চোখে পড়ে প্রার্থীদের নাম পোস্টার। এটা ইমিগ্র্যান্টদের শহর। ফলে কত রকমের নাম চোখে পড়লো! কোন কোন নামতো উচ্চারণই করতে পারি না। ভালো লাগলো যে এসব নামের ভিড়ে চৌধুরী / ভূঁইয়া জাতিয় নামের ও দেখা মিললো। মহসিন ভূঁইয়া, জিয়া চৌধুরী। আরো পেলাম ফেরদৌসী বারী, সুমন রায় এদেরকেও। বাঙালিদের কেউ দাবায়া রাখতে পারবে না। সব খানে তারা সরব, নির্বাচনমুখী। তবে শহর ব্যাপি দেখা এত এত নামের মধ্যে একটা নাম আমাকে বিশেষভাবে আকর্ষণ করেছে। নামটি হলো মাইকেল আর্টস। মাইকেল আর্টস-কে আমি চিনি না। তবে মনে হয় খোঁজ নিলে জানবো মাইকেল আর্টস দুটি পুত্র সন্তানের জনক। একটি পুত্র সন্তানের নাম মাইকেল সাইন্স অপর পুত্র সন্তানের নাম মাইকেল কমার্স। আমরা কত রকমের নাম রাখি। জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার নামে নাম রাখলে কেমন হয়? তবে টরন্টোর এক বাঙালির আছে এক ছেলে আর এক মেয়ে। নাম শুনবেন তাদের? সম্পূর্ণ বাংলা নাম। ছেলেটির নাম সবুজ বাগান- আর মেয়েটির নাম চন্দ্র কথা। কেন এমন নাম রাখলেন জানতে চাইলে ভদ্রলোক বললেন- মোলায়েম সুরে অকারণে “ইয়োর গুড নেম, প্লিজ” বলে কেউ পরোভাবে তাদের (তার দু’সন্তানের) ধর্ম জেনে নেবে, সে সুযোগ আমি আর রাখলাম না। এই নাম শুনার পর কেউ বুঝতে পারবে না তাদের ধর্ম কী।
কানাডার ভ্যানকুভার নগরীতে ১৯০৮ সনে প্রতিষ্ঠিত ব্রিটিশ কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির বিশ্বের সেরা ২০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে অন্যতম একটি কানাডায় এটা ২য় স্থানে ব্রিটিশ কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির অনেক ডিপার্টমেন্টের একটি হলো ডিপার্টমেন্ট অব এশিয়ান স্টাডিজ প্রচুর আগ্রহ নিয়ে গেলাম দেখতে গিয়েতো অবাক নয়ন জুড়ানো এক ভবন অপরুপ আর্কিটেকচারাল ডিজাইন, অনেকটা থাই, কম্বোডিয়ান আদি বাসগৃহের মত দোতলা বহু ক বিশিষ্ট বিরাট ভবন কিন্তু, পুরা ভবনটিকে বাহির থেকে এমন ভাবে ঢেকে দেয়া হয়েছে যে বাহির। থেকে দেখলে মনে হবে চৌচালা একটি মাত্র ঘর ছাদসহ বাহিরটা পুরোটাই কাঠের ভবনের প্রবেশ পথটা বিরাট বিরাট গাছে এমন ভাবে ভরা যে ওটাকে বন বলা যায় আমার মনে হচ্ছিল ইউনিভার্সিটি ছেড়ে বনে ঢুকেছি সে বনের মধ্যে মূল ভবনের সামনে হঠাৎ দেখি প্রমাণ সাইজের পাথরের এক মূর্তি। দূর থেকে দেখে মনে হলো ওটা ঠাকুর। কাছে গিয়ে দেখি হাঁ, ঠাকুরই তো মনে মনে ভাবলাম এই ডিপার্টমেন্টের সামনে এশিয়ার ঠাকুর থাকবে এটাতো স্বাভাবিক চারদিকে হাঁটলাম; ঠাকুর ছাড়া আর কাউকে পেলাম না। বিস্মিত হলাম, ঠাকুরের মত বিশ্বখ্যাত মানবতো এশিয়ায় অনেক আছে। সাহিত্যে নোবেল পাওয়া আছেন- জাপানের ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা, কাযু ইশিগুরু এবং ক্যানবুরো ওই; চায়নার মু ইয়ান এবং গাও জিনজিয়ান অথচ বিশ্বখ্যাত এই বিশ্ববিদ্যালয় সবার মধ্য থেকে শুধুমাত্র আমাদের ঠাকুরকে তার বুকে জায়গা দিল! মনে মনে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে ধন্যবাদ দিলাম; বাঙালি বলে আমি খুব আনন্দ ও গর্ব অনুভব করলাম ‘ঠাকুর পাড়া থেকে সোজা চলে গেলাম বায়োডাইভার্সিটি মিউজিয়াম দেখতে সেখানে দেখার কত কিছু! কি ই বা দেখলাম! কাস চললে প্রতিদিন প্রায় অর্ধল ছাত্র-ছাত্রীর পদচারণায় এ বিশ্ববিদ্যালয় থাকে মুখরিত স্বপ্ন জাগানিয়া ব্রিটিশ কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি এদিক ওদিক ঘুরে ফিরে দেখতে আমার কোন অসুবিধা হয়নি কারণ, ব্রিটিশ কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির প্রাক্তন ছাত্র আমার জামাতা স্বপ্নিল সারাণ আমাদের সাথে ছিল।
দাঁত দিয়ে নখ কাটা একটা বাজে অভ্যাস। কারো কারো আছে এ অভ্যাস। এ অভ্যাসের দাসের। চেয়ে দাসী বেশি। কুমিল্লায় এ অভ্যাসের জন্য এক ছাত্রীকে সরাসরি ধমক দিয়ে যে বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছিলাম (সে কান্না শুরু করে দিয়েছিল) সেটা স্মরণ করে আমি এ ব্যপারে ছেলে মেয়েদেরকে সতর্ক করার ধরন পাল্টে ফেলেছি। ইউনিভার্সিটিতে একদিন ১ম বর্ষের কাস নিচ্ছি। দেখি এক ছাত্রী সমানে নখ কাটছে। কী করি, কীভাবে বলি? একেবারে সহজ সমাধান। ব্ল্যাক বোর্ডে লিখে দিলাম- “দাঁত দিয়ে নখ কাটবে না। এটা খুব বিশ্রী একটা অভ্যাস”। ব্যাস! হয়ে গেল।
এতেই কাজ হয়ে গেল। তাকে আর কোন দিন দেখিনি এ কর্মটি করতে। অবশ্য কাসের বাহিরে করতো কিনা কে জানে!!