সাজ্জাদ আলী : (সম্প্রতি সাতখণ্ড রামায়ণ লেখা শেষ করেছি। জগৎ সংসারে লেখার বিষয়ের তো আর অভাব পড়েনি। তবুও কেন “রামায়ণ” লিখলাম? বইয়ের শুরুতে তার কারণও লিখেছি। বাংলা কাগজের পাঠক বন্ধুদের জন্য আজ শুধু সেই “কারণটুকু” লিখলাম)

রামায়ণের কিছু কাহিনী শৈশবে দাদীর মুখে শুনেছিলাম। এই যেমন রামের বীরত্ব, সীতার সতীত্ব, লক্ষণের আনুগত্য, রাবণের দুরাচার ইত্যাদি … । সেই থেকে ওই সব পুরাণকাহিনী আরো জানতে মন চায়। কৈশোরে রামায়ণ বইখানা প্রথম হাতে এলো। কিন্তু তা পড়তে যেয়ে বিশেষ সুবিধা হলো না। সেটি ছিলো কৃত্তিবাস পন্ডিত মহাশয়ের রচনা। কাব্যগাথায় লেখা সেই কাহিনী আমার জন্য মোটেই সহজবোধ্য ছিলো না। যতদূর মনে পড়ে তার সূচনাটা ছিলো এরকম,
“গেলোক বৈকুন্ঠ পুরী সবার উপরে
লক্ষীসহ তথায় আছেন গদাধর।
তথায় অদ্ভুত বৃক্ষ দেখিতে সুচারু
যাহা চাই, তাহা পাই, নাম কল্পতরু।”

কারণটা ঠিক বুঝি না, তবে পুরাণকাহিনী দাদীর ভাষায় শুনতেই মনে চায়। পন্ডিতদের কঠিন কথায় ওগুলো ভাল লাগে না, আবার তা বুঝেও উঠি না। যাই হোক, তারও বহুবছর পর কলেজের সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় একখানা রামায়ণ পুরস্কার পেলাম। হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য মহাশয়ের গদ্য অনুবাদ ছিলো সেটি। পড়া শুরু করলাম। ওরে বাপরে! সে তো কাব্যের থেকেও জটিল! একেবারে মাথা ঘুরে যাওয়ার মতো বাংলা। কঠিন সব শব্দ, আর জটিল জটিল বাক্য। এক কথায় বলা যায় বাংলা ভাষার একজন সুপণ্ডিত লেখক, তার ‘পণ্ডিত পাঠকদের’ জন্য বইখানা লিখেছেন। ওর পাঠোদ্ধার আমার কাজ নয়। সেই বইয়ের শুরুর একটু নমুনা বলছি,
“মহর্ষি বাল্মীকি তপোনিরত স্বাধ্যায়সম্পন্ন বেদবিদগণের অগ্রগণ্য মুনিবর নারদকে সম্বোধনপূর্বক কহিলেন .. .. ..,” ইত্যাদি ইত্যাদি।

এ বইয়ের কয়েকটি চ্যাপ্টার পড়েছিলাম। কিন্তু প্রতি লাইনে অন্তত একবার করে বাংলা ডিকশনারির পাতা উল্টাতে হচ্ছিলো। এমন করে কী আর পড়া আগায়, বলুন? মাতৃভাষায় আমার দুরবস্থা তখনই প্রথম বুঝতে পারলাম। ওই বইখানা আমার জন্য সুখপাঠ্য ও বোধগম্য হতে পারতো যদি হেমবাবু এভাবে একটু সহজ করে লিখতেন,
“বেদশাস্ত্রের সুপন্ডিত মুণিবর নারদকে মহর্ষি বাল্মীকি কহিলেন ….,”

সেবারেও রামায়ণ পড়া এগুলো না। বছর পনেরো আগে রাজশেখর বসু মহাশয়ের সারানুবাদ করা রামায়ণখানা হাতে এলো। বসুবাবু অন্যদের তুলনায় সহজ ভাষায় কাহিনীগুলো লিখেছেন। কিন্তু বাংলা অভিধান দূরে ঠেলে তার রচনাও পড়া চলে না। প্রতি পাতায় অন্তত পাঁচসাতটা শব্দের অর্থ বুঝতে ডিকশনারির দরকার হচ্ছিলো। আমি জানি যে বাংলা ভাষায় আমার দখল তলানিতে পড়ে আছে। কিন্তু ভালো বাংলা যারা জানেন, তারাও বিভিন্ন লেখকদের লেখা রামায়ণ দুচার পাতা পড়ে দেখতে পারেন। দেখবেন কোনোটাই সাধারণ পাঠকদের জন্য উপযোগী নয়।

চন্দ্রবতী, ষষ্ঠিবর, গঙ্গাদাস, নিত্যানন্দ আচার্য, শঙ্কর কবিতীর্থ, রামনন্দ ঘোষ, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী প্রমূখ মহাজনেরা বাল্মীকির রামায়ণখানা বাংলা ভাষায় লিখেছেন। অতি উঁচু মার্গের লেখক তাঁরা। সাধারণ পাঠকশ্রেণী সে সব লেখা ছুঁতে পারেন না।

তো বছর সাতেক আগে হঠাৎ একদিন মনে হলো, সাধারণের ভাষায় রামায়ণ লিখবো। কিন্তু মনে হলেই তো আর লেখা যায় না! সে তো এক মহাযজ্ঞ। ‘মহাযজ্ঞ’ শুধু লিখবার বিবেচনায় নয়। রামকে, রাবণকে, রামায়ণকে সঠিকভাবে জানবার বিবেচনায়ও বটে। ওদিকে মনের চাওয়া না মেটালে মনটা বেজার হয়। শুরু করলাম রামায়ণ সংক্রান্ত রেফারেন্স বই জোগাড় এবং তা পড়ার কাজ। ঢাকা, টরন্টো, কলকাতা, দিল্লী, কাঠমুন্ডু, ত্রিপুরা থেকে বন্ধুরা এ সংক্রান্ত বইপত্র পাঠিয়ে আমাকে সমৃদ্ধ করলেন।

কাঠমুন্ডু প্রবাসী ভারতীয় বন্ধু তর্করত্ন জগদীশ আচার্য দিনের পর দিন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা কানে ফোন ঠেকিয়ে আমার জ্ঞানপিপাসা মিটিয়েছেন। একটানা সাড়ে পাঁচ বছর বিষয়টির ওপর নিরলস পড়াশুনা চললো। অতঃপর এ বছরের (২০২২) শুরুতে মনে হলো, এবার কলম ধরা যায়। গত সাড়ে দশ মাসে সেই লেখার যজ্ঞ শেষ হলো। এখন পাঠক বন্ধুরা যদি রামায়ণকাহিনী পড়ে আনন্দ পান, তবেই ‘যজ্ঞফল পেলাম’ মনে করবো।

অকারণে বইয়ের কলেবর বৃদ্ধি না হয় সে দিকটা লক্ষ্য রেখেছি। আদিকান্ড থেকে শুরু করে অযোধ্যা, অরণ্য, কিষ্কিন্ধ্যা, সুন্দর, যুদ্ধ, ও উত্তরকান্ডসহ সাতটি পর্বই ধারাবাহিকভাবে বর্ণিত হয়েছে। সাধারণ পাঠকদের কথা মনে করেই এ বই লেখা। তবে গবেষকশ্রেণীর পাঠকরাও বিশেষ বঞ্চিত হবেন না। আর যারা ধর্মকথা মনে করে পড়বেন, তারা ভক্তিমার্গে পৌঁছাবেন। আবার যাদের পূরাণকথা জানার আগ্রহ, তারাও তৃপ্ত হবেন।

টরন্টো প্রবাসী অগ্রজ অধ্যাপক সুজিত দত্ত রেফারেন্স বই ধার দিয়েছেন। লেখা কেমন এগুচ্ছে, নিয়ম করে সে খবর রেখেছেন। এমন পণ্ডিতজন পেছনে আছেন, তা ভেবে মনে জোর পেয়েছি। অনুজপ্রতিম সজীব (তবলাশিল্পী সজীব চৌধুরী) লক্ষাধিক শব্দের এই লেখার প্রথম পাঠক। প্রতিটি পৃষ্ঠা সে মনোযোগ দিয়ে পড়েছে। কাহিনী তরতর করে এগুলো কিনা, পুনরাবৃত্তি হলো কিনা, এত বড় কাহিনীর কোথাও সংযোগ কেটে গেল কিনা ইত্যাদি বিষয়গুলো সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছে। গল্পের চলন কোথাও যদি মন্থর মনে হয়েছে, তবে সজীব আমাকে দিয়ে তা ঝরঝরে করিয়ে ছেড়েছে।

বন্ধু সুপ্তি (চিত্রশিল্পী নুরুন্নাহার সুপ্তি), মনের মাধুরী মিশিয়ে মলাটের ছবিখানি অগ্রিম এঁকে রেখেছেন। পশ্চিম বাংলার পুরুলিয়ার বন্ধু শম্পা বন্দ্যোপাধ্যায় সঠিক প্রতিশব্দগুলো বাছাই করে দিয়েছেন। বন্ধু আমিনুর রহমান সোহেল, অমৃতা রায়, মানজুমান আরা, ফাতিমাতুজ্জোহরা লাভলী প্রমুখ মাঝেমধ্যেই খবর নিয়েছেন যে লেখা কদ্দুর এগুলো। আমি ক্লান্ত হয়ে পড়লে, কফি, বিরিয়ানী, প্রেমময়কথা ইত্যাদি উপকরণে ওরা আমাকে চাঙা রেখেছেন। সবার কাছে কৃতজ্ঞ আমি।

পাঠক বন্ধুদের কেমন লাগলো তা জানার অপেক্ষায় রইলাম।

সাজ্জাদ আলী
সিটি অব টরন্টো, কানাডা
Email: mdsazzadali@yahoo.com