হাসান গোর্কি : আমরা যারা জীবনের বড় অংশ বাংলাদেশে কাটিয়ে প্রবাস জীবন শুরু করেছি বাংলাদেশ নিয়ে তাদের মানসিক সংশ্রব দেশে বাস করা মানুষদের চেয়ে কম নয়; বরং কখনও তা তাদের ছাপিয়ে যায়। স¤প্রতি ‘রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারের রূপরেখা’ দিয়েছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। রূপরেখার শেষ বাক্যে বলা হয়েছে, “রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের এই রূপরেখা অধিকতর সমৃদ্ধ করিতে আপনাদের গঠনমূলক পরামর্শ জাতীয় বৃহত্তর স্বার্থে আমরা সাদরে গ্রহণ করিব।” এই লেখায় আমি কিছু পরামর্শ উপস্থাপন করতে চাই। এক শব্দে বর্ণনা করতে চাইলে বলতে হবে, রূপরেখাটি ‘সুলিখিত’। অল্প কিছু পরিবর্তনসহ বাস্তবায়ন করা গেলে এই রূপরেখা ভালো ফল দিতে পারে। শুরুতে চারটি ত্রæটির কথা বলা যাক। ভূমিকায় বলা হয়েছে, “দেশের জনগণের হাতেই দেশের মালিকানা ফিরাইয়া দেওয়ার লক্ষ্যে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে জয়লাভের পর বর্তমান ফ্যাসিস্ট সরকার হটানোর আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলসমূহের সমন্বয়ে একটি ‘জনকল্যাণমূলক জাতীয় ঐকমত্যের সরকার’ প্রতিষ্ঠা করা হইবে। উক্ত ‘জাতীয় সরকার’ নিম্নলিখিত রাষ্ট্র রূপান্তরমূলক সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণ করিবে:।”

দেশে যে “অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন” অনুষ্ঠিত হবে, রূপরেখার প্রণয়নকারীরা সেটা কিসের ভিত্তিতে ধরে নিয়েছেন তা স্পষ্ট নয়। একই বাক্যে নিশ্চিত করা হয়েছে যে ‘ফ্যাসিস্ট সরকার’ হটানোর আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলসমূহ নির্বাচনে জয়লাভ করবে। এই সিদ্ধান্তমূলক ধারণা রুপরেখায় থাকা উচিত নয়। তৃতীয়ত, এখানে জাতীয় সরকারে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণের সম্ভাবনা নাকচ করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে এটা ‘জাতীয় সরকার’ না হয়ে একটা বহুদলীয় মোর্চা হয়ে উঠবে। রূপরেখার শেষে লেখা হয়েছে “শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ঘোষিত ‘১৯ দফা’ এবং দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ঘোষিত বিএনপির ‘ভিশন-২০৩০’–এর আলোকে এই রূপরেখা প্রস্তুত করা হইয়াছে।” এই বক্তব্য জাতীয় সরকারের ধারণার সাথে কিছুটা অসঙ্গতিপূর্ণ। অংশগ্রহণমূলক একটা জাতীয় সরকার বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এ’ধরণের ঘোষণা অন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে নিরুৎসাহিত করতে পারে। এর বাইরে উত্থাপিত রুপরেখাটি অত্যন্ত গঠনমূলক ও বাস্তবানুগ। তবে আমার মতে এর বাস্তবায়ন হওয়া উচিত দুই দফায়। প্রথম দফায় ২ নম্বর ধারা এবং দ্বিতীয় দফায় বাকি ২৬ টি ধারা। একটা গল্প দিয়ে শুরু করা যাক:

যুদ্ধে হেরে যাবার পর সেনাপতি রাজধানীতে প্রত্যাবর্তন করেছেন। রাজার দরবারে এ বিষয়টি পর্যালোচনার জন্য সেনাপতিকে ডাকা হলো। রাজা সেনাপতিকে যুদ্ধে হারার কারণ জিজ্ঞেস করলেন। সেনাপতি বললেন, যুদ্ধে হারার ৩৩ টি কারণ চিহ্নিত করা গেছে, মহারাজ। প্রথম কারণ, বন্দুক ও কামান ছিলো; কিন্তু গুলি ও গোলা ছিলনা। দ্বিতীয় কারণ, রাজা সেনাপতিকে থামিয়ে দিয়ে বললেন।
আপনি থামুন; বাকি ৩২ টি কারণ আর বলার দরকার নাই।

রুপরেখার ২ নম্বর দফায় বলা হয়েছে, “প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতির বিপরীতে সকল মত ও পথের সমন্বয়ে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, বৈষম্যহীন ও স¤প্রীতিমূলক ‘রেইনবো নেশন’ প্রতিষ্ঠা করা হইবে। এই জন্য অব্যাহত আলোচনা, মতবিনিময় ও পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে ভবিষ্যৎমুখী এক নতুন ধারার সামাজিক চুক্তিতে পৌঁছাইতে হইবে। এই জন্য একটি ‘ন্যাশনাল রিকনসিলিয়েশন কমিশন’ গঠন করা হইবে।“ অন্তর্ভুক্তিমূলক ‘রেইনবো নেশন’ প্রতিষ্ঠা করতে চাওয়া এবং আওয়ামীলীগের মতো বৃহৎ রাজনৈতিক দলকে তার বাইরে রাখার চিন্তা পরস্পরবিরোধী।
বিএনপির এই রুপরেখায় ২৭ টি দফা আছে। শুধু ২ নম্বর দফাটি বাস্তবায়ন করা গেলে বাকি ২৬ টি বাস্তবায়নে আর কোনো বাধা থাকবে না। আর এটি বাস্তবায়ন করা না গেলে বাকিগুলো বাস্তবায়নের কোনো সুযোগ নেই। ব্যাপারট অনেকটা উপরের গল্পের যুদ্ধে গুলি শেষ হয়ে যাবার মতো। রূপরেখাটির বড় ত্রæটি হলো এতে বিএনপি ধরে নিয়েছে যে দেশে একটা অবাধ নির্বাচন হবে এবং তাতে তারা জয়লাভ করবে। নিকট অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি, এরকম আশা করা বোকামি। বৈরিতার অবসান না হলে সুষ্ঠু নির্বাচনের সম্ভাবনা খুব-ই কম। আগামী সংসদ নির্বাচন আসতে এখনও এক বছর বাকি। ‘ন্যাশনাল রিকনসিলিয়েশন কমিশন’এখন-ই গঠন করে শুধু ২ নম্বর ধারাটি বাস্তবায়ন করা গেলে একটা অংশগ্রহণমূলক সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব হতে পারে এবং নির্বাচনের পর জাতীয় সরকার গঠন ও কল্পিত ‘রেইনবো নেশন’ গঠন করা সম্ভব হতে পারে। তখন বাকি ২৬টি ধারা বাস্তবায়ন করবে নির্বাচন পরবর্তী জাতীয় সরকার। বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কটের মূল কারণ নির্বাচনী ব্যবস্থা ভেঙে পড়া নয় বরং এটা বেশ কিছু বৈরিতা, বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসামূলক ঘটনার উপজাত। শুধু একটা সুষ্ঠু নির্বাচন করা গেলেই যে সংকটের সমাধান হবে না এই সহজ সত্যটি বিএনপি স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করেছে বলেই দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দল হিসেবে রূপরেখাটি জাতির সামনে হাজির করেছে। আমার মতে, ‘ন্যাশনাল রিকনসিলিয়েশন কমিশন’ এর প্রথম কনভেনশন হতে হবে শুধু বিএনপির রূপরেখায় উল্লেখিত ২ নম্বর ধারাকে ভিত্তি করে।

সেখানে, ইতিহাসবিদ, শিক্ষাবিদ, আইনজ্ঞ, গণমাধ্যম ও প্রধান রাজনৈতিক দলসমূহ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা থাকবেন। সপ্তাহ বা পক্ষকালব্যাপী (মাসব্যাপীও হতে পারে) আলোচনায় শুধু সেই বিষয়গুলো থাকবে যা প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দূরত্ব তৈরি করেছে। যেমন, ১৫ আগস্ট, ৩ নভেম্বর ও ২১ আগস্টের হত্যাকান্ড, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি, বাকশাল, রক্ষীবাহিনী, গণবাহিনী, সামরিক শাসন (’৭৫- ’৯০), যুদ্ধাপরাধের বিচার, ২০১৪, ১৮-র নির্বাচন— এসব বিষয়ে দলগুলো তাদের ব্যাখ্যা ও বর্তমান অবস্থান উপস্থাপন করবে। রাজনৈতিক দলগুলো এবং অন্য সবগুলো পক্ষ এই ঘটনাপ্রবাহে তাদের দায় স্বীকার করে ভবিষ্যতে সকল পক্ষের প্রতি সৎ থাকার অঙ্গীকার করলে একটা আস্থার পরিবেশ তৈরি হতে পারে। ‘প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতি’ থেকে মুক্তি পেতে ‘ন্যাশনাল রিকনসিলিয়েশন কমিশন’ প্রথম কনভেনশনে যে কয়টা বিষয় বিবেচনায় নিতে পারে তার একটা তালিকা করা যাক:

বঙ্গবন্ধু ও চার নেতা হত্যাকান্ড: বঙ্গবন্ধু এবং তার পরিবারের প্রায় সব সদস্যকে যারা হত্যা করেছে, তারাই স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করে আওয়ামীলীগ নামের রাজনৈতিক দলটির অস্তিত্বকে বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিয়েছিল। হত্যাকারীদের দায়মুক্তি ও পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল, ২১ বছর আওয়ামীলীগ টিকে ছিল অনেকটা নিষিদ্ধ সংগঠনের মতো, রেডিও-টেলিভিশনে নিষিদ্ধ ছিলেন বঙ্গবন্ধু ও চার জাতীয় নেতা। এই ঘটনাগুলো দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে যে দূরত্ব তৈরি করেছিল তা এখনও সমান শক্তিতে টিকে আছে। যেমন বঙ্গবন্ধুসহ স্বাধীনতার পাঁচ স্থপতির হত্যাকান্ডের নিন্দা না করে বিএনপি এক ধরণের দ্ব্যর্থক বা অস্পষ্ট ব্যাখ্যা দেয় যা থেকে বুঝতে অসুবিধা থাকে না যে এই ঘটনায় তারা খুশি। এ বিষয়ে বিএনপির অবস্থান আরও স্পষ্ট হয়, খালেদা জিয়ার দ্বিতীয় মেয়াদের শাসনামলে। এ সময় বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার বন্ধ করে রাখা হয়েছিল। রাজনৈতিক অবস্থানগত এই দূরত্বের অবসান কীভাবে হতে পারে সেটা কমিশনের আলোচনায় বেরিয়ে আসবে।

একুশ আগস্টের গ্রেনেড হামলা: ১৯৯৫ সালে বিরোধী দলসমূহের তত্ত¡াবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নিয়ে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছিলেন খালেদা জিয়া। তত্ত¡াবধায়ক সরকারের দাবি মানতে তিনি বাধ্য ছিলেন না। তৃতীয় বিশ্বের রাজনীতিতে এই ধরণের রাজনৈতিক মহানুভতার উদাহরণ বিরল। কিন্তু ২০০৬ সালে তিনি তত্ত¡াবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে পছন্দের ব্যক্তি (বিচারপতি কে এম হাসান) ছাড়া অন্য কারো কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে রাজি ছিলেন না কেনো? একুশ আগস্ট (২০০৪) গ্রেনেড হামলার মূল লক্ষ্য ব্যর্থ হবার পর বিএনপি নেতৃত্ব হয়তো অনুমান করেছিলেন সামনের দিনগুলো তাঁদের জন্য সংকটময় হবে। আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় গেলে তারেক জিয়া ফেঁসে যাবেন এবং বড় শাস্তির মুখোমুখি হবেন। সে’কারণে যে কোনো মূল্যে পরবর্তী দফায় ক্ষমতায় যাওয়া ‘বিএনপি’র জন্য জরুরি ছিল। ২০২৩- এর নির্বাচনে আওয়ামীলীগের জন্য ক্ষমতায় যাওয়া এর কাছাকাছি কিছু কারণে জরুরি হয়ে পড়েছে। তারা নিশ্চিত হতে চায় বিরোধী দলে গেলে আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের পটভূমিতে তৈরি হওয়া চমৎকার একটা গণতন্ত্রের আবহ যেভাবে আমূল পাল্টে গেছে তা ফিরিয়ে আনা আসলে কঠিন। ২০০৮ সালে ক্ষমতায় যাবার পর আওয়ামীলীগ বিএনপিসহ সকল প্রতিপক্ষের রাজনৈতিক অধিকার হরণ করে কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করেছে। এখন দলটি পয়েন্ট অব নো রিটার্ন- এ পৌঁছে গেছে বলে নির্বাচনী ব্যবস্থাকে পর্যুদস্ত করে ফেলেছে। এর সমাধান মাঝখান থেকে চাইলে পাওয়া যাবে না। কমিশনে সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে সকল পক্ষের মনে এই বিশ্বাসের জন্ম দেওয়া জরুরি যে বিরোধী দলে থাকলে তারা হামলা বা নির্যাতনের শিকার হবে না।
স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃতি: শুনতে হালকা উপাদান মনে হলেও আসলে স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি বৈরিতার বড় উপাদান। দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের বিতণ্ডার অন্যতম বিষয় মুক্তিযুদ্ধ। বিএনপি যে ন্যারেশন তৈরি করেছে তাতে বলা হচ্ছে আওয়ামী লীগ নেতারা ভারতে বসে ‘লাল পানি’ পান করে ফুর্তি করেছেন আর সাধারণ মানুষ বাঙালি সৈন্যদের সাথে নিয়ে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে। এটা সত্যের অপলাপ। সাধারণ মানুষ বলতে তখন কেউ ছিল না। যে জনগন প্রতিরোধ করেছিল তারা আওয়ামীলীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ বা ছাত্র ইউনিয়নের নেতা, কর্মী বা কমপক্ষে সমর্থক ছিল। তারা নৌকা মার্কা ভোট দিয়েছিল এবং ১২০০ মাইল দূরবর্তী কোনো এক নির্জন কারা প্রকোষ্ঠে বন্দী নেতার নামে ‘জয় বাংলা’ ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দিয়ে যুদ্ধ করেছিল। খালেদা জিয়া- ফখরুল ইসলামও ১৯৭০-র নির্বাচনে নৌকা মার্কায় ভোট দিয়েছিলেন (এর বাইরে কিছু অনুমান করা বিদ্বেষমূলক হবে)। ‘পলায়নকারী’ নেতারাই ‘আত্মসমর্পণকারী’ নেতাকে প্রধান করে প্রবাসী সরকার গঠন করেছিলেন এবং পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পরাশক্তির সরাসরি ও তিন পরাশক্তির পরোক্ষ বিরোধিতাকে মোকাবিলা করে দেশ স্বাধীন করেছিলেন।

তারাই ভারতে পলায়নকারী সেনাসদস্যদের মধ্যে থেকে সেক্টর কমান্ডার নিয়োগ করে মাস মাস ৪০০ টাকা বেতন দিয়েছিলেন। সাধারন পরিষদের ভোটাভুটিতে যুদ্ধ বিরতির পক্ষে বা পাকিস্তানের অখণ্ডার পক্ষে ভোট পড়েছিল ১০৪টি। বিপক্ষে ভারত এবং রাশিয়া সহ মাত্র ১০ টি রাষ্ট্র ভোট দিয়েছিল। এইসব প্রতিক‚লতা মোকাবিলা করেছিলেন ভারতে পলায়নকারী আওয়ামীলীগ নেতারাই। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস যতটা বিস্তারিত এবং অনুপুঙ্খভাবে সংরক্ষিত হয়েছে তার নজির সম্ভবত পৃথিবীতে বিরল। জিয়াউর রহমানের নির্দেশ ও নির্দেশনায় হাসান হাফিজুর রহমানের সম্পাদনায় ১৫ খন্ডে রচিত ১৫ হাজার পৃষ্ঠার স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র এক কথায় এক অনন্য ও অভাবিতপূর্ব দলিল। কমিশনের বৈঠকে সকল পক্ষ সত্য ইতিহাসের উৎস হিসেবে এটাকে মেনে নিলে বৈরিতার একটা বড় উপাদান বিলুপ্ত হবে।

জাতীয় নেতাদের মর্যাদা: বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। তিনি সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত আমাদের জাতির পিতা। কিন্তু তাঁকে মর্যাদা দিতে গিয়ে আওয়ামী লীগ অন্য জাতীয় নেতাদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করে চলেছে। শারমিন আহমেদ তাঁর বই নেতা ও পিতা তে যুক্তরাষ্ট্রের আদলে বাংলাদেশে ফাউন্ডিং ফাদারস নির্বাচনের ব্যাপারে মত দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতার আসনে রেখে শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, মোহাম্মদ কামারুজ্জামান ও কমরেড মনি সিংকে ফাউন্ডিং ফাদারস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া যেতে পারে। বাংলাদেশের সব টাকায় এখন বঙ্গবন্ধুর ছবি আছে। সবচেয়ে বড় অংকের টাকায় তাঁর ছবি রেখে বাকিগুলোতে ফাউন্ডিং ফাদারদের ছবি ছাপা হলে জাতি হিসেবে আমাদের মর্যাদা বাড়বে। বিএনপিতে অনেক মুক্তিযোদ্ধা আছেন। এর প্রতিষ্ঠাতাও একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তারা আওয়ামীলীগকে স্বাধীনতা যুদ্ধের একক দাবিদার হতে দিচ্ছেন কেন! বিএনপি যদি ‘জয় বাংলা’ ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দিয়ে ৭১-র প্রবাসী সরকারের পাঁচ নেতার ছবি তাদের অফিসে টানিয়ে দেয় তাহলে আওয়ামীলীগ তো তাতে বাধা দিতে পারবে না! এতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষ-বিপক্ষ বিতর্ক অনেকটাই স্তিমিত হয়ে যাবে এবং এ বিষয়ে বৈরিতারও অবসান হবে।

রাজনৈতিক আবেগ: বিএনপি দেশের প্রথম বা দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল। এর সদস্যদের আবেগ, আনুগত্য ও ভালবাসার কেন্দ্রবিন্দু জিয়াউর রহমান। তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধের ১৭ জন সেক্টর কমান্ডারের একজন। তিনি জেড ফোর্সের অধিনায়ক ছিলেন, ২৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন (তার আগে এরকম ঘোষণা অন্য দু’জনও দিয়েছেন; সেটা অন্য প্রসঙ্গ), কামালপুরের যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন, সিলেট দখল করার সময় জেনারেল কে.ভি. কৃষ্ণরাওয়ের বাহিনীর পাশাপাশি তার বাহিনী বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধ করেছে এবং সর্বোপরি যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তিনি বীর উত্তম খেতাব পেয়েছেন। তিনি শাসক হিসেবে অবৈধ ছিলেন, কিন্তু এটা ভুলে গেলে চলবে না যে তিনি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের প্রবর্তক যা এদেশে খুবই জনপ্রিয় একটা রাজনৈতিক দর্শনের ধারা। জিয়া বা তার মত বীর যোদ্ধাদের অবদানকে অস্বীকার করলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কলুষিত হয় এবং নিচুতা প্রকাশ পায়। বিস্তর সুযোগ থাকা সত্বেও জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করেননি। তাঁর নির্দেশে হাসান হাফিজুর রহমান ১৫ খন্ডে যে স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র সংকলন করেছেন সেটা ছিল বিস্ময়কররকম পক্ষপাতহীন।

পক্ষান্তরে আওয়ামীলীগ নেতারা তাকে পাকিস্তানের চর বলে কুৎসা রটানোর চেষ্টা করেছেন, তাকে ‘মেজর রিট্রিট’ বলে ব্যঙ্গ করা হয়েছে। এমনকি সংসদেও তাকে নিয়ে কুরুচিপূর্ণ আলোচনা হয়েছে। আওয়ামীলীগের কর্তৃত্ববাদের সমালোচনা করায় মহান মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকীকে রাজাকার বলা হয়েছে। প্রথম পতাকা উত্তোলনকারী আ.স.ম. আব্দুর রবকে স্বাধীনতার অনুষ্ঠানে ডাকা হয় না। তারেক জিয়া বঙ্গবন্ধুকে ‘পাক বন্ধু’ বলে পরিচয় দেন। বৈরিতার অবসান চাইলে প্রস্তাবিত কমিশনে এই ধরণের ক‚ট তর্ক ও বিদ্বেষ থেকে সবাইকে সরে আসার নিশ্চয়তা দিতে হবে। এর পরের কাজ হবে বিএনপি ঘোষিত রূপরেখার বাকি ২৬ দফা নিয়ে আলোচনা শুরু করা। কনভেনশনের দ্বিতীয় ধাপে আলোচনায় প্রধান এজেন্ডা হিসেবে আসতে পারে, তত্ত¡াবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন; যুক্ত হতে পারে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট ও ভোটের সংখ্যানুপাত ভিত্তিক আসন বণ্টন। শুরুতেই বলেছি রূপরেখাটি সুচিন্তিত ও সুলিখিত। এতে সমস্যার প্রায় সকল ক্ষেত্র চিহ্নিত করে সমাধানের পথ বলা হয়েছে। সরকার সহ সকল পক্ষের উচিত বিএনপির এই চমৎকার উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়ে সেটাকে বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে নেওয়া।
hassangorkii@yahoo.com
রয়্যাল রোডস ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া, ব্রিটিশ কলম্বিয়া।