সাজ্জাদ আলী : ছবিখানার দিকে চেয়ে আছি তো আছিই। চোখ আজ পলক ফেলতেও নারাজ।মাটির ঢিবির ওপর বসে আছে সে। লাল মাটির ঢিবি, টকটকে লাল! কোনো কাঁকর নেই সেই মাটিতে।বসার ভঙ্গি আমুদে। দেখে বলে দেওয়া যায়, সেলালমাটির কন্যা। চোখে উদাস চাউনি। কী দেখছে, নাকি কিছুই দেখছেনা, তা বোঝা দায়। পরনের প্যান্ট হাঁটু পর্যন্ত। স্যান্ডেল খুলে উদোম পা মাটিতে রেখেছে। ঝুরঝুরেলাল মাটিরা যেন সেই অপেক্ষায় ছিলো। পায়ের পাতাজোড়া মাটির মধ্যে খানিকটা ডুবেআছে। কী সৌভাগ্য ওই মাটির! অমন কোমল স্পর্শ পাওয়ার আকাঙক্ষা মনে তো জাগেই। কিন্তু পা-ওয়ালী তো আমার থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে বাংলার সেই রাঢ় অঞ্চলে!
তার ডিজিটাল অ্যালবাম থেকে একটার পর একটা ছবি উল্টে উল্টে দেখছি। ওর শরীরের বাঁকগুলো কী মোহনীয়! আমার মানষচোখ ছবির প্রতিটি অঙ্গ ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়। যত দেখি,আকুলতা ততই বাড়ে। কাঙ্গাল মন ক্রমেই অশান্ত হয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে তার ছবিগুলো প্রতিমার রূপ নিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। অবচেতনে আমি কাছে ঘেঁষে যাই। এক সময়ে তার কাঁধে কনুইয়ের ভর রাখি। ভয় হয়, সে বুঝি রেগে গেল! কিন্তু না, তার ঠোঁটে সম্মতির হাসি দেখি। সাহস বেড়ে যায়। ওর একখানা হাত টেনে নিয়ে পালিশ লাগানো নখেআঙ্গুল বুলাতে থাকি। হাসতে হাসতে বলে, নকল না, আসল নখই। তুমি একটু চেপে দিলেও খসে পড়বে না! আমি তো চেপেই দিতে চাই, সখী! কিন্তু কেন যেনপেরে উঠি না!
পরের ছবিখানিতেতার মুখখানা পাতার আড়ালে। বেশ আড়ালেই বলতে হবে। ওই মুখ অনেক দেখা না হলে বুঝতেই পারতাম না যে এটা তার ছবি। ফুলের ভারে শিমুলের একখানা ডাল ন্যুয়ে পড়েছে। সে ডালে পাতায় ঘেরা তিনছড়া ফুল। ছবিতে দেখা যায়, ফুলের গন্ধ না শুঁকে সে পাতার গন্ধ নিচ্ছে। তিনটি পাতার ফাঁক ঠেলে ওর লম্বা নাকটি চতুর্থ পাতাটির গন্ধ শুঁকছে। আর সুযোগ পেয়ে দুষ্টু পাতারা ওর নাকে পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে। আমার কী তবে পাতা হয়ে জন্মানোই উচিত ছিলো? কখনও কী তবে আমাদের নাকদুটি ‘নিঃশ্বাস দূরত্বে’ আসবে না? লালমাটির এই নারীর জন্য আমাকেকি তবে জন্মান্তর অপেক্ষা করতে হবে?
গত বছরে তারজন্মদিনের শুভেচ্ছা বার্তায় লিখেছিলাম, “একটি মিঠা-চুমুরইলো তোমার জন্য।”এমন রোমান্টিক কথা আগে কখনও বলিনি ওকে। পরক্ষণেই সংশয় এবং লজ্জা আমাকে ঘিরে ধরলো। কি জানি, এই বিদ্যাধরী হয়তো আমায় হ্যাংলা ভাববে। সাথে সাথেই আরো দুটো লাইন লিখে পাঠালাম,“যদি গ্রহণে আপত্তি থাকে, তবে বার্তাটি মুছে দিও। তবুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুদোহাই তোমার,ক্ষেপে যেও না!”জবাব পাঠাতে দেরি করলো না। লিখলো, এমন উপহার শুধু তুমিই দিলে। ওটি গুছিয়ে রাখলাম।
স্বর্গলাভের জন্য লোকের মরতে হয়, কিন্তু আমার হয় না।
সেকি বাড়ির কাছে? হাজার হাজার মাইল দূরে তার দেশ। কিন্তুমনটা খুব উড়োতাড়া হয়েছে। ঠিক করেছি, নতুন বছরের প্রথম ছুটিতেইওর কাছে যাবো। অনেক খরচাপাতি করে টিকিটও জোগাড় হয়েছে। কিন্তু যার জন্য যাবো, তাকে সে খবরটি জানাতে পারছি না। নানা ভাবনা আসছে মনে। সেখানে গিয়ে তার অস্বস্তির কারণ হয়ে না উঠি? তার তো গোছানো ঘর আছে, চাকুরিতে যাবার তাড়া আছে। রক্ষণশীল একটা সমাজের বাসিন্দা সে। এমনও তো হতে পারে, কোনো রক্তচক্ষু তাকে পাহারায় রাখে সারাক্ষণ! ভার্চুয়াল চেনাজানায় সে প্রেমময় বটে। কিন্তু মুখোমুখি তেমনটা তো নাও হতে পারে। আবার তার ব্যক্তিইচ্ছা কতটা স্বাধীন, তাও তো জানা নেই। নিজপ্রতিক‚লতার সীমানা ডিঙ্গিয়ে সে কতখানি আমার ক‚লে ভিড়তে চাইবে?
আমিই বা তাকেকতটা চাই? তাও তোঠিকঠাক জানি না। তবে যদি তার হাসিমাখা মুখখানা দেখতে পাই, একান্তে কিছু কথা হয়, সেই তো অনেক। উপরন্তু যদিএকগুচ্ছ শিমুল ফুল ওর চুলে গুঁজে দেওয়া যায়, তো বেশ হবে। আর সুযোগ হলে তার চোখ থেকে চশমাজোড়া খুলে নেবো। তারপর মুখখানা কাছে থেকে দেখবো। অনেকক্ষণ ধরে, অনেকবার।মানুষের ‘জীবনের পূর্ণতা’ নিয়ে তার চিন্তাটা কী? এক ফাঁকে তাও শুনে নিতে চাই। একদিন বলছিলো সে শুক্তো রেঁধে খাওয়াবে। মনে সে লোভও আছে বৈকি।
লক্ষ হাজার শব্দের টেক্সট লিখে দুজন দুজনকে চিনেছি। দুএকবার ফোনালাপও হয়েছে। আমার পরিস্থিতি ওর থেকে ভিন্ন। অতি উদার একটি সমাজের বাসিন্দা আমি। ব্যক্তির ভাললাগাই যেখানে শেষ কথা। গৃহে থেকে একজন মানুষ যতটা বাউল হতে পারে, আমি ততটাই। ওরমধ্যে বাউলানি হওয়ার তীব্র ছটফটানি দেখেছি আমি। মন বলে, আমার দোতারার সাথে সে ঠিকই গান ধরবে।
জীবনের নিভৃত চাওয়াগুলোর সাথে সামাজিকতার নিত্য বিরোধ। সমাজ হলো ব্যাকরণের বই। শুধুই ভুল ধরে আর চোখ রাঙায়। তার পাতায় পাতায় সমাস, কারক আর ক্রিয়াপদের ছড়াছড়ি।নির্জীবেরা সে ব্যাকরণ মেনে জীবন কাটাতে পারে। কিন্তু জীবনে যার বৈচিত্র চাই, প্রাণ যার উচ্ছ¡লতায় ভরা, ফুল পাশে ঠেলে যে পাতার ঘ্রাণনেয়; তাকে বেঁধে রাখার সাধ্য কার?
নতুন বছরের সম্ভাষণে আমি যেন স্পষ্ট শুনতে পাই, গীতবিতানের পাতা খুলে সখী গাইছে,
“সেদিন যেন তোমার ডাকে ঘরের বাঁধন আর না থাকে–
অকাতরে পরানটাকে প্রলয়দোলায় দোলাতে চাই।”
(লেখক বাংলা টেলিভিশন কানাডার নির্বাহী)