শারমীন শরীফ : জাহানারা ইমামের বড় ছেলে রুমির জন্ম হয় ১৯৫১ সালের ২৯ শে মার্চ, এবং ছোট ছেলে জামির জন্ম হয় ১৯৫৪ সালের ২রা সেপ্টেম্বর। তাদের সুবিন্যস্ত সুশৃংখল অত্যন্ত সুখী জীবনে ছন্দপতন ঘটে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে। ২৫শে মার্চের পর বাংলাদেশের তরুণরা যখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে তখন রুমি মাকে মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অংশগ্রহণ আকাঙ্খার কথা ব্যক্ত করে। এক দিকে ছেলের দেশ প্রেম অন্যদিকে সৈনিক জীবনের সম্ভাব্যচিত্র কল্পনা করে জাহানারা ইমাম শঙ্কিত হয়ে পড়েন। এ ঠিক মাসখানেক পরে নিশ্চিত সাফল্যময় জীবন গড়ার জন্য রুমির আমেরিকায় এলিনয় ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে ভর্তি পর্ব সমাপ্ত হয়েছিল। কিন্তু রুমির ইচ্ছের কাছে পরাজয় মেনে সেই সাথে দেশও জাতির স্বার্থে জাহানার ইমাম রুমিকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেবার অনুমতি দেন। ১৯৭১ সালের ৭ই মে রুমি মুক্তিযুদ্ধে চলে যায়। যাবার সময় ছোট্ট একটি ব্যাগে দু সেট কাপড় তোয়ালে সাবান স্যান্ডেল আর দুটো অসাধারণ কাব্যগ্রন্থ জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা আর সুকান্ত সমগ্র এবং সাথে কয়েকশো টাকা এই নিয়ে রুমি পা বাড়ায় রণাঙ্গনের দিকে এবং দুই নম্বর সেক্টরে যুদ্ধে যোগ দেয়।

মুক্তিযুদ্ধে তথ্যসংগ্রহ ছিল পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রাথমিক পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ কাজ এবং এ ব্যাপারে সহযোগিতায় সদা সক্রিয় ছিলেন জাহানারা ইমাম পরিবার। ব্রিজ, কালভার্টের তালিকা বা ব্রিজের ঠিক কোন কোন পয়েন্টে এক্সপ্লোসিভ বেঁধে উড়িয়ে দিলে ব্রিজ ভাঙবে অথচ দেশের স্বাধীন হবার পরে খুব সহজেই সেটা মেরামত করা যাবে তার বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ ও সময় মত সরবরাহের দুঃসাহসিক কাজটি ঢাকায় বসে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে করে দিয়েছেন তাঁর স্বামী ইঞ্জিনিয়ার শরীফ ইমাম।

২৫শে আগস্ট ১৮ ও ৫ নম্বর ধানমন্ডিতে এক বীরত্বপূর্ণ সফল অ্যাকশনের অন্যতম নায়ক রুমিকে ২৯ আগস্ট বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি মিলিটারিরা। একই সাথে জামি ও শরীফ ইমামকেও বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায় হানাদার বাহিনী। দু’দিন দু’রাতব্যাপী অমানুষিক নির্যাতন ও সীমাহীন দুর্ভোগ আর কষ্টভোগ করে রুমি ছাড়া বাদ বাকি সবাই ফিরে আসেন। পাক বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে শহীদ হন রুমি। রুমির শহীদ হওয়ার খবর পেয়ে বাবার শরীফ ইমাম দেশের স্বাধীন হওয়ার দু’দিন আগে অর্থাত ১৪ই ডিসেম্বর হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে জাহানারা ইমাম হারালেন তাঁর, প্রিয় সন্তান রুমি এবং স্বামীর শরীফকে। প্রাণ প্রিয় সন্তান রুমিকে ঘিরেই জাহানারা ইমাম রচনা করেন তাঁর অমর গ্রন্থ ‘একাত্তরের দিনগুলি’।

১৯৮৬ সালে ‘একাত্তরের দিনগুলি’ প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে দেশে-বিদেশে তিনি ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। এই এই বইটি তাঁকে নিয়ে যায় বাংলার মানুষের হৃদয়ের কাছাকাছি। রাতারাতি রুমির মা থেকে দেশের আপামর জনসাধারণের কাছে জাহানারা ইমাম রূপান্তরিত হন শহীদ জননীতে। ৮০ দশকের শুরুতে ১৯৮২ সালে তিনি আক্রান্ত হন দুরারোগ্য ক্যান্সারে। প্রতিবছর একবার যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে চিকিত্সা নিতে হতো তাঁকে। একমাত্র সন্তান সাইফ ইমাম জামী তার স্ত্রী এবং দুকন্যা তখন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছিল।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলে ঘাতক দখলদার বাহিনী পালিয়ে গেলেও তার অধিকাংশ দালাল গা ঢাকা দিয়েছিল দেশের অভ্যন্তরে, লুকিয়ে থাকা রাজাকারেরা প্রথমে গোপনে গোপনে এবং পরে প্রকাশ্যে তাদের কর্মতত্পরতা শুরু করে। তাদের কর্মতত্পরতা রুখবার জন্য এবং জনগণের মাঝে মুক্তির যুদ্ধের চেতনা বিকাশের লক্ষ্যে ১৯৯২ সালের ১৯শে জানুয়ারি জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ১০১ সদস্য বিশিষ্ট ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’ গঠিত হয়। এর পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী প্রতিরোধ মঞ্চ, চৌদ্দটি ছাত্র সংগঠন, প্রধান প্রধান রাজনৈতিক জোট, শ্রমিক, কৃষক এবং সাংস্কৃতিক জোট সহ ৭০টি সংগঠনের সমন্বয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটির আহ্বায়িকা হিসাবে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সময়োপযোগী। তাঁর নেতৃত্বে ১৯৯২ সালের ২৬ শে মার্চ গণ আদালত গঠনের মাধ্যমে একাত্তরের ঘাতক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক ঐতিহাসিক বিচার কার্যসভা অনুষ্ঠিত হয়। সেদিন লাখো জনতার উপস্থিতিতে গণ আদালতে জাহানারা ইমাম ছিলেন ১২জন বিচারক মন্ডলীর প্রধান। গণআদালতে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে উত্থাপিত হয় সুনির্দিষ্ট ১০টি অভিযোগ। এ দশটি অপরাধ মৃত্যুদণ্ডযোগ্য বলে রায় দেয় গণ আদালত। সমবেত জনতার পক্ষ থেকে গণআদালতের রায় কার্যকর করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান শহীদ জননী।

জাহানারা ইমাম

গণআদালতের সাফল্যের পরে তত্কালীন বিএনপি সরকার জাহানারা ইমামের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনে এবং অজামিনযোগ্য একটি মামলা দায়ের করে। পরে অবশ্য হাইকোর্ট তাঁর জামিন মঞ্জুর করে। ১৯৯২ সালের ১২ই এপ্রিল জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে লাখো জনতার মিছিল গণআদালতের রায় কার্যকর করার দাবি সংবলিত একটি স্মারকলিপি জাতীয় সংসদের মাননীয় স্পিকার, সরকার প্রধান ও বিরোধী দলীয় নেত্রীর কাছে পেশ করেন। ১০০ জন সংসদের গণ আদালতের রায়ের পক্ষ সমর্থন আন্দোলনের ক্ষেত্রে একটি নতুন মাত্রা সংযোজন করে। পরবর্তীকালে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় বাস্তবায়িত হয় বিভিন্ন কর্মসূচি। এ কর্মসূচির মধ্যে ছিল হরতাল, মাসব্যাপী গণস্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযান, গণসমাবেশ, মানববন্ধন, সংসদ অভিমুখে যাত্রা, অবস্থান ধর্মঘট ও মহাসমাবেশ। এসব আন্দোলন-সংগ্রাম করতে গিয়ে তিনি অনেকবার পুলিশি নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হন। তাঁর এই আপষহীন ভূমিকার কারণে দেশ-বিদেশেও ব্যাপক আন্দোলন ও কমিটি গড়ে ওঠে। এদিকে পত্রপত্রিকায় ব্যাপকভাবে এ-বিষয়ে লেখালেখির কারণে তিনি আন্তর্জাতিক মহলেও খ্যাতি লাভ করেন। জাহানারা ইমাম ১৯৮৮ সালে ‘লেখিকা সংঘ’ পুরস্কার এবং ১৯৯০ সালে ‘বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার’ লাভ করেন।
১৯৯৪ সালের ২রা এপ্রিল শহীদ জননী কে চিকিত্সার জন্য আবারও আমেরিকাতে পাঠানো হয়। ২২ শে এপ্রিল ওখানকার চিকিত্সকরা জানান তার অবস্থা সংকটাপন্ন। ২২শে জুনের পর তার অবস্থার ক্রমাবনতি ঘটতে থাকে। অবশেষে ১৯৯৪ সালের ২৬ শে জুন রবিবার বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৭টায় যুক্তরাষ্ট্রের ডেট্রয়েট শহরের সাইনাই হসপিটালে ৬৫ বছর বয়সে ঘাতক-দালাল বিরোধী আন্দোলনের পুরোধা শহীদ জননী জাহানারা ইমাম শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর ওপর থেকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা প্রত্যাহার না করা হলেও বাংলাদেশের সরকারের রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী তাঁর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে পত্রিকায় বিবৃতি দেন।

তার মৃত্যুতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি ২৮ শে জুন থেকে ৪ঠা জুলাই পর্যন্ত শোক সপ্তাহ এবং ৬ জুলাই জাতীয় শোক দিবস পালন করে।

৪ জুলাই বিকেলে তাঁর মরদেহ বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সমন্বয় কমিটির নেতৃবৃন্দের সঙ্গে শহীদ জননের লাশ গ্রহণ করেন জাতীয় সংসদের তত্কালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা। ৫ই জুলাই সকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শহীদ জননের কফিন রাখা হয় জনগণের শেষ শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য। সর্বস্তরের জনগণ সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত শহীদ জননীর প্রতি শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। দুপুরে জোহরের নামাজের পর জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে হাজার হাজার জনতার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয় তাঁর নামাজে জানাযা। জানাযা শেষে শহীদ জননী কে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী ও মুক্তিযোদ্ধা গোরস্থানের সমাহিত করা হয়।

মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাস, সাহিত্য, সংস্কৃতি, সমাজ সর্ম্পকে আগ্রহী আর জাহানারা ইমামের নাম শোনেননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। যার ডায়েরিতে বাংলাদেশের জন্মের নিমর্ম স্মৃতি মলাটবন্দি, তা শুধুই স্মৃতিচারণা নয়, ইতিহাসের অসামান্য দলিলও বটে। স্বাধিকার আন্দোলন থেকে স্বাধীনতার জন্য সাধারণ মানুষ যে নিপীড়নের স্বীকার হয়েছেন পাকিস্তানিদের মাধ্যমে তার হৃদয়গ্রাহী বয়ান।

জাহানারা ইমামের জীবন দর্শন তার মহিমা,ত্যাগ বর্তমান প্রজন্মের হৃদয় এক জ্যোতির্ময় চেতনার সৃষ্টি করেছে। তিনি নিজেকে যেমন প্রদীপের সাথে তুলনা করেছিলেন ঠিক তেমনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি বাঙালির অন্তরকে দীপ্তময় করে গেছেন। এই মহানুভব মমতাময়ী শহীদ মাতার প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা।