ভজন সরকার : বিজ্ঞান বলে এ বিশ্ব ক্রমেক্রমে ধ্বংসের দ্বারে উপনীত হচ্ছে। বিবর্তনবাদ বলে লক্ষাধিক বছরে বিবর্তনের ফলে একই প্রজাতির জীবের উদ্ভব হবে সেটারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। অর্থাত এ বিশ্ব এবং মানুষ উভয়ই নশ্বর; উভয়েরই ধ্বংস অবশ্যম্ভাবী। তবে মানুষ, মানুষ-সৃষ্ট এ সভ্যতা কিসের নির্ভরতায় বাঁচবে?

এ অনিশ্চয়তা থেকেই বোধহয় প্রতিটি ধর্মে এক অলৌকিক অবিনশ্বর জগতের প্রতি মানুষকে প্রলুব্ধ করা হয়েছে। অথচ মৃত্যুর পরের এ জগতের অস্তিত্ব অবান্তর এবং অবিশ্বাস্য। তবুও কোটি কোটি মানুষ এ কাল্পনিক ফ্যান্টাসিতে বিশ্বাস করেই বেঁচে আছে। বেঁচে আছে শুধু নয়, বিশ্বাসে-বিশ্বাসে পারস্পারিক দ্বন্দ-সঙ্ঘাতেও মেতে আছে।

কিন্ত প্রশ্ন থেকেই যায়, এতো নশ্বরতা মধ্যে,এতো অনিশ্চয়তার মধ্যে মানুষ তাহ’লে কী নির্ভরতা নিয়ে বেঁচে থাকবে? এ বিশ্ব একদিন ধ্বংস হবে। মানুষ একদিন মানুষই থাকবে সেটাও অনিশ্চিত। ধর্মে দেখানো অলৌকিক জগত সেটাও অবাস্তব কল্পনা। তবে মানুষের বেঁচে থাকার অবলম্বনটা তাহলে কী?

অনেকের মতো আমিও মনে করি, সেটা অবশ্যই বিশ্বাস। সে বিশ্বাস এই যে, এ বিশ্ব এবং আমি একে অপরের পরিপূরক। আমার কাছে আমি ছাড়া এ বিশ্বের যেমন কোনো অস্তিত্ব নেই। আবার এ বিশ্ব ছাড়াও আমার কোনো অস্তিত্ব নেই। তাহলে আমি যখন এ বিশ্বে থাকবো না, তখন কী হবে?

হ্যাঁ, সেখানেই বিশ্বাসের প্রয়োজন। প্রতিটি মানুষের এ বিশ্বাস রাখা উচিত যে, আমার মৃত্যুর পরেও এ বিশ্বের কোথাও না কোথাও আমি আমার অস্তিত্বটুকুন যেন রেখে যেতে পারি। যেদিন এ বিশ্ব বিলীন হবে- আমার অস্তিত্বও যেন লীন হয় সেদিনই, তার আগে নয়।
আবার সবাইকে যে নিজের অস্তিত্ব রেখে যেতে হবে এমন বাধ্যবাধকতাও যে আছে তারও কোনও যৌক্তিক কারণ নেই। তবে একটা দায়বদ্ধতা তো আছেই।

আমাদের প্রত্যেকের জন্ম এক ক্ষণিকের অথচ হঠাত-পাওয়া ধনের মত। মানুষের জন্মের কথাই যদি ধরি, তা লক্ষ-কোটি সম্ভাবনার মধ্যে একটি ঘটে যাওয়া সম্ভাবনামাত্র। বাবা এবং মায়ের শুক্রাণু এবং ডিম্বানুর অসংখ্য অসংখ্য সম্ভাবনা থেকে হঠাত-সম্ভব একটি ঘটনামাত্র। জন্মের প্রথম ক্ষণটি অনিশ্চিত হলেও, শুক্রাণু-ডিম্বানুর মিলনের পর থেকে সবগুলো মুহুর্তই কিন্তু পরম ভালোবাসা এবং আদর যতেœ লালিত।

মায়ের গর্ভাবস্থার সেই দিনগুলো থেকে বেড়ে ওঠার সময়ের প্রতিটি মুহূর্ত, এমনকি জীবনের শেষ ক্ষণটিও কিন্তু কারও না-কারও পরম স্নেহের স্পর্শে-সিক্ত। আর এই পরম স্নেহের স্পর্শ দান করে চলেছে মানুষ, প্রকৃতি, এমনকি আমাদের চারপাশের সব কিছুই। তাই এই দানের প্রতিদান দেওয়াও কি মানুষের কর্তব্য নয়? আর এই প্রতিদানের নামই নানান সময়ে নানান রকমভাবে বলা হয়েছে; কোথাও মানবপ্রেম কোথাও দেশপ্রেম, কোথাও জীবেপ্রেম।
আমরা পড়েছিলাম, ‘জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর’। এই “ঈশ্বর” শব্দটি স্বার্থের ক‚টকৌশলে বন্দি হয়ে অলৌকিকতায় রূপ নিয়েছে। অথচ ‘ঈশ্বর’ শব্দটির মানে এখানে নিতান্তই ইহজাগতিক। ‘ঈশ্বর’-কে আমরা যেদিন থেকে ইহজগত থেকে অলৌকিক জগতের বাসিন্দা করে ফেলেছি, সেদিন থেকেই শুরু হয়েছে বিপত্তি।

আর এ বিপত্তি বাধিয়েছেন এবং এখনও বাধাচ্ছেন আমাদের সমাজেরই বুদ্ধিমান মানুষ, তাঁদের নিজ নিজ স্বার্থে। এটা নির্দ্বিধায় বলাই যায়, নিজেদের বেঁচে থাকার কৌশলে। তাই তো ধর্মবিশ্বাসের প্রণেতাদের স্মৃতি বেঁচে আছে নামে-যশে-প্রতিপত্তিতে।, অথচ বিলীন হয়ে গেছে, ধ্বংস হয়ে গেছে ধর্মকে বিশ্বাস করে অযূত বিশ্বাসী মানুষ। হিংসা এবং আধিপত্যের আগুনে বেঘরে প্রাণ গেছে মানুষের। এখনও যাচ্ছে।

ওদিন এক হাসপাতালে শুয়েছিলাম। অজ্ঞান করার আগে কী পরম যত্নে ও মমতায় ডাক্তার নার্সরা কথা বলছিল। ওপরে তাকিয়ে দেখি পুরো ছাদে জ্বলজ্বল করছে ইলেক্ট্রনিক বোর্ড। একটি বিরাট কৃষ্ণচূড়া গাছ। ফুলে ফুলে ছেঁয়ে গেছে। ফুল আর পাতার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে নীল আকাশ। এক পাশে এক টুকরো সাদা মেঘ। একেবারে মন ভরিয়ে তোলা দৃশ্য। আমি জানি একটু পরেই অচেতন হয়ে যাব। আমি হয়ত ফিরে এসেছি। অনেকেই ফিরে আসেন না আর। তাই বোধহয় শেষ সময়টুকু একটু প্রকৃতির আনন্দে মন ভাল করার জন্যেই এমন ব্যবস্থা।

আমাদের এই জীবন মহাকালের তুলনায় নিমেষ মাত্র। এ পৃথিবীতে লক্ষ-কোটি বছর ধরে প্রাণ আছে। মানুষ আছে সেও কয়েক লক্ষ বছর তো হবেই। আমি-আপনি মরে যাওয়ার পরে লক্ষ-কোটি বছর হয়ত পৃথিবীতে মানুষ থাকবে। তাই আমার-আপনার এ বেঁচে থাকা পৃথিবীর জন্য কোনও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ই নয়। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ যা সেটি হল আমার-আপনার এই বেঁচে থাকাকে এই পৃথিবীর মানুষ, প্রকৃতি-জীবের জন্য পরিপূরক করে রাখা। আর সেটিই হওয়া উচিত মানুষের ধর্ম।

অথচ কী চতুর কৌশলে মানুষকে যুগ যুগ ধরে যা ধর্মবিশ্বাস হিসেবে শেখান হয়েছে, তা আসলে এক অলৌকিকতার প্রতি অন্ধ আবেগ এবং যুক্তিহীন ক‚পমন্ডকতা; যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানুষকে দাঁড় করায় একে অপরের বিরুদ্ধে। অথচ জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত আমাদের প্রত্যেকের বেঁচে থাকার পেছনে আছে এক পারস্পারিক প্রেম ও ভালোবাসা। আর সে প্রেম ও ভালোবাসার উত্সস্থল মা, মানুষ, প্রকৃতি এবং জীবজগত , এক কথায় এই মহাবিশ্ব।

(ভজন সরকার : কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, কানাডা)