ইউসুফ কামাল : ১৩.
প্রথম দর্শনেই উর্মিলাকে ভালো লাগলো শাহেদের, দেখলো সামনে কয়েকটা ফাইল পড়ে আছে মনে হয় কিছু কাজ জমে আছে। ইঙ্গিতে একটু বসতে বলে দুইজন ষ্টাফের পার্সোনাল ফাইলে কিছু জরুরি নির্দেশনা দিয়ে বাকী ফাইলগুলো একপাশে সরিয়ে রাখলো। শাহেদ বুঝলো এত বড় একটা প্রতিষ্ঠানের এইচ আর ডিপার্টমেন্ট এর কাজ সামলানো খুব একটা সহজ বিষয় নয়। ইলা ওকে বলেছে উর্মিলা এই ডিপার্টমেন্টের দ্বিতীয় ব্যাক্তি হলেও মূল কাজগুলো সেই করে থাকে। ফাইলের কাজটা মোটামুটি শেষ করে রিভলবিং চেয়ার ঘুরিয়ে সরাসরি তাকালো শাহেদের দিকে। শাহেদ বুঝলো উর্মিলা তাকে পাকা জহুরীর দৃষ্টিতে পরিমাপ করে নিলো।
মুখে একটা সন্তুষ্টির ছায়া নিয়ে বল্লো, এখন বলুন শাহেদ কেমন আছেন? আপনার সাথে দেখা করার জন্য আমি অনেক আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম। শাহেদও ঠিক যেন কিছু বলার জন্যই প্রস্তুত হয়ে ছিলো- সাথে সাথেই বল্লো, আমি নিজেও মনে মনে আপনাকে ধন্যবাদ দেওয়ার জন্য দিনের পর দিন অপেক্ষা করছিলাম। একটা অসহায় মানুষকে যে ভাবে হাতে ধরে যুদ্ধ করতে শিখিয়েছেন, বেঁচে থাকতে আশা যুগিয়েছেন তার তুলনা হয় না। কত বড় মহৎ একটা কাজ আপনি করেছেন, এমন একটা বিশ্বাসের জায়গা সৃষ্টি করেছেন আমার আর ইলার কাছে যার তুলনা হয় না। শুধু ইলাই নয় আমি নিজেও আপনার একজন একনিষ্ঠ ভক্ত হয়ে গেছি।
শাহেদের কথায় উর্মিলা খুশী হয়ে বল্লো, তাই নাকি, এ কথা ইলা জানে তো? সাবধান! পাশের চেয়ারে বসা ইলাকে দেখিয়ে উর্মিলা জোরে হেসে উঠলো। তা হলে তো এ কথার পর কফি খাওয়াতেই হয়, বলে রুমের কোণায় রাখা ‘কফি মেকার’ এর দিকে তাকিয়ে চেয়ার থেকে উঠতে যেতেই ইলা দ্রুত চেয়ার থেকে উঠে বল্লো, তুমি বসো আমি কফি বানিয়ে আনছি।
শাহেদ ওদের দু’জনের সম্পর্কের আন্তরিকতা দেখে বেশ খুশী হলো, দুই দেশের দু’জন সম্পূর্ণ অচেনা মানুষ বিশেষ একটা ঘটনার আকস্মিকতায় একত্রে মিশে একটা নতুন বন্ধনের সৃষ্টি করেছে যা ভাবলে সত্যিই বিস্মিত হতে হয়। শাহেদের মনে হলো বয়সের দিক দিয়ে উর্মিলা হয়তো ইলার থেকে কিছুটা বড়ই হবে, কিন্তু স্বাস্থ্য সচেতন বলে সেটা সহজে ধরা যায় না। ইলা যে ওকে যথেষ্ট সমীহ আর সম্মান দিয়ে সম্পর্কটা বজায় রাখতে চেষ্টা করে, শাহেদ সেটা দুজনের ব্যবহারেই প্রমাণ পেলো। ইলা কফি বানিয়ে ওদের দু’জনের সামনের টেবিলে রেখে নিজের কফির মগ হাতে করে শাহেদের পাশের চেয়ারে যেয়ে বসলো। ইলার চোখে মুখে খুশীর ঝিলিক দেখে উর্মিলা বলেই ফেল্লো, তোমার এই খুশীর চেহারা এত দিন কোথায় লুকিয়ে রেখেছিলে বলো তো! আমি তোমার মুখে কোনো দিন হাসি দেখেছি বলে তো মনে পড়ে না। হঠাৎ করে কি যে হয়ে গেলো ওর, বলেই জোরে হেসে উঠলো। উর্মিলা যোগ করলো, প্রথম দেখাতেই ইলার মুখ দেখে কেন জানি আমার খুব মায়া লেগেছিলো, বুঝতে পেরেছিলাম ও জীবনের সরল পথটাতেই চলতে অভ্যস্ত। আমার মোটেই বুঝতে দেরী হয়নি ও কোন ধরনের মানুষ, ওর মধ্যে প্রবঞ্চনার কোন ছাপ নেই। সহজ সরল একটা মানুষ যার মধ্যে কোন কৃত্তিমতা নেই বরং মনে প্রাণে সেটাকে ঘৃণাই করে। আপোষ করতে পারেনি বিধায় একাকী অচেনা পথে পা বাড়ানোর মতো দুঃসাহস দেখিয়েছিলো। উর্মিলা যোগ করলো মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই ওর মধ্যে এত জেদ আর আত্মসম্মান বোধ। আর মানুষ হিসাবে ও আমার চেয়েও অনেক গুনে ভালো, সেটা স্বীকার করতে আমার বিন্দুমাত্র লজ্জা নাই।
সত্যিই আমি ওকে অনেক স্নেহ করি, নিজের ছোট বোনের মতো ভীষণ মায়া পড়ে গেছে ওর প্রতি আমার, কেমন করে যেন আমাকে সম্পূর্ণ বশীভূত করে ফেলেছে। আমি ওকে অসম্ভব বিশ্বাস করি, ওর সামনে সেটা বলতে আমার কোন দ্বিধা নাই। বিশ্বাসটা জিনিষটা অনেকটা বৃক্ষের মতো, যার নীচে মানুষ নির্ভয়ে আশ্রয় ও ভরসা করতে পারে। সত্যিই আমি ওর উপর অনেক বিষয়ে নির্ভর করতে পারি। ও সত্যিই একজন নিরহংকারী ভালো মানুষ। শাহেদ আপনি সঠিক মানুষটাকেই চিনেছেন। এত চাপা স্বভাবের মানুষ তিন বছর একত্রে পার করেছি অথচ মাত্র গত সপ্তাহে আমাকে আপনার কথা বলেছে। বিগত তিনটা বছর পাশাপাশি থেকেছি, এক সাথে পথ চলেছি ঘুণাক্ষরেও আপনার কথা বলেনি। একটা বিষয় পরিস্কার বুঝেছি, ওর মনের ভিতর আপনি ছাড়া আর কেউ ঢুকতে পারেনি এবং পারবেও না। শাহেদ এই বিশ্বাসী, জেদী মানুষটারে বেঁধে রাখবেন। আপনাকে ছাড়া ও বিকল্প কোন চিন্তা করে না, সেটা আমি হলফ করে বলতে পারি।
আপনার ছায়া ওর উপর থেকে কখনো যদি সরেও যায় আমি কেন কেউই আর ওকে ধরেও রাখতে পারবে না। আপনার উপস্থিতি কল্পনায় সাথে করে, সম্পূর্ণ একাকী এতটা দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে। এটা কি ভাবে ও পেরেছে আমি মাঝে মাঝে চিন্তা করে অবাক হয়ে গিয়েছি, ওর মুখের দিকে তাকিয়ে মাঝে মাঝে ভাবি ও কেমন করে অসম্ভবকে সম্ভব করে নিয়েছে? একটা ধর্মীয় পার্থক্য আপনাদের মধ্য আছে সেটা আমি ওর চাকরীর নেওয়ার বায়োডাটা দেখে বুঝেছিলাম। ইলা আমাকে এ বিষয়ে কিছু বলেনি কিন্তু এর মধ্যে ধর্মীয় বিধি নিষেধের কিছু বিষয় থাকতে পারে ধরে ওর কাছে জানতে চেয়েছিলাম। পরিস্কার বলে দিয়েছে এগুলো ও কোন সমস্যা বলে মনে করে না। ভালো লাগা তো কোন বিধি নিষেধ মেনে চলে না, ওর পরিস্কার কথা।
যৌবনের শুরুতে ভালোলাগাটা অস্বাভাবিক কিছু না, আর তখন সেটা নিয়ে কেউ কোন বিশ্লেষণেও যায় না। তা ছাড়া ঐ ধরনের ভালো লাগার ঘটনা অনেকের জীবনেই থাকে। দিন বদলের সাথে ঐ ধরনের ঘটনাগুলো অনেকের জীবন থেকে হারিয়েও যায়, কিন্তু যারা যক্ষের ধনের মতো সেটাকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকতে চায় তাদের সংখ্যা খুব একটা বেশি না। তবে তারা সত্যিই ভালো মানুষের গোত্রে পড়ে। পারিবারিক সিদ্ধান্তকে ইলা মেনে নিয়েছিলো শুধুমাত্র পিতা মাতার প্রতি শ্রদ্ধাবোধের কারণেই। বাকী সব ঘটনাই তো আপনি জানেন। শাহেদ লক্ষ্য করলো, ইলা আস্তে করে চেয়ার থেকে উঠে রুমের বাইরে চলে গেল হয়তো নিজেকে সম্বরণ করে নেওয়ার জন্যেই। নিজে যে কথাগুলো কোনদিন বলতে পারেনি, উর্মিলা ওর মনের সেই না বলা কথাগুলো শাহেদকে বলে দেওয়াতে নিজেকে আর কোন মতেই ধরে রাখতে পারলো না। ওর উঠে বাইরে যাওয়াটা দু’জনই তাকিয়ে দেখলো কিন্তু বাঁধা দিলো না। এমন একটা সন্ধিক্ষণের মুহূর্তে মানুষকে একা থাকতে দিতে হয় নিজেকে হাল্কা হওয়ার জন্য, নিজের সাথে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার জন্যে সেটা ওরা দু’জনেই বুঝে নিলো। ইলা বাইরে যেয়ে দাঁড়িয়ে আছে গøাসের ভিতর থেকে দেখা যাচ্ছে, নিশ্চুপ পাথরের মতো একাকী। ইলার দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ পর উর্মিলা বল্লো, ও কিন্তু আপনাকে কিছুই বলতে বলেনি আমাকে, আর বলবেও না জানি। যে চাপা স্বভাবের মানুষ, আমি একজন নারী হিসাবে ওর মনের ভাষা বুঝতে পারি আর তাই নিজের থেকেই কথাগুলো বল্লাম। যাক্ আজকে আর কাজ করবো না, বাইরে যেয়ে ইলার কাছে দাঁড়ান আমি বস্ কে ফোনে আজকের বাকী সময়টার জন্য একটা শর্ট লিভ নিয়ে নিই।
শাহেদ বাইরে ইলার পাশে এসে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করলো কিছু নিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন। কেউ যে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে সেটাও টেরই পায়নি। কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে শাহেদ প্রশ্ন করলো, কোথায় হারিয়ে গেছো? শাহেদের প্রশ্নে কিছু না বলে গম্ভীর মুখ ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বল্লো, কোথায় আর যাবো, আছি তো! আমার তো আর যাবার কোন জায়গা নেই। আমি তো সব কিছু ছেড়ে চেলে এসেছি। তুমিও তো আবার চলে যাবে। আমি যেই একা, আবারো সেই একাই হয়ে যাবো আগের মতো। ইলার এই মানসিক অবস্থা দেখে শাহেদের কষ্টই লাগলো বল্লো, কোথায় যাবো তোমাকে ফেলে বলো? তোমাকে ফেলে আমি চলে যাবো তা তুমি ভাবলে কেমন করে? তোমার বিকল্প কাউকে আমি জীবনে চিন্তাই করিনি। শাহেদের কথায় ইলা ওর মুখের দিকে চেয়ে মনের ভাব বুঝতে চেষ্টা করলো। শাহেদ লক্ষ্য করলো ওর কথায় ইলার চোখ মুখে একটা সন্তুষ্টির ভাব ফুটে উঠলো। ঈষৎ হাসি হাসি মুখটা দেখে শাহেদের খুব ভালো লাগলো, ভাবলো সে নিজেও তো ইলার বিকল্প কাউকে ভাবতে পারেনি। এখনো পারে না। কথাটা তো সত্যি।
শাহেদ ভাবলো, সিদ্ধান্তটা ইলাকে পরিস্কার করে জানানো দরকার ছিল। বলে ভালই হোল, এখন তাহলে ওর মনের কষ্টগুলো আর থাকবে না। এই মুহূর্তে ওর একটা মানসিক সাপোর্ট দরকার। বেচারা একদম ভেংগে পড়েছে। শাহেদ বল্লো, উর্মিলা আসছে চলো সবাই মিলে কোথাও যেয়ে আপাততঃ দুপুরের খাবারটা খেয়ে নিই, তারপর না হয় তোমাকে নিয়ে কোথাও হারিয়ে যাবো। রাজী? ইলা বুঝতে পারলো, ওর মনটা হাল্কা করার জন্য শাহেদ কথা এই কথাটা বলল। হেসে বল্লো, সেই বয়স কি এখনো আছে? যখন যাওয়ার বয়স ছিলো তখনই যাওনি আর এখন? তবে এটা সত্যি তখন তুমি যা বলতে আমি হয়তো তাই করে ফেলতাম। তবে আমি তোমাকে তখন অনেক বিশ্বাস করতাম আর সেটা এখনও করি। উর্মিলা রুম থেকে বের হয়ে ইলাকে বল্লো, গত মাসে আমরা যে ‘কিং ব্যাফে’ তে গিয়েছিলাম মনে আছে তো, চলো ওখানে যাই। ইলা হেসে মাথা ঝুকিয়ে সম্মতি জানিয়ে বল্লো, চলো ওখানে ভালোই হবে সেদিন তো আমার বেশ ভালোই লেগেছিলো। ‘সিয়ার্স’ এর মেইন গেট দিয়ে বের হয়ে হাঁটতে হাঁটতে উর্মিলা পার্কিং লট এ ওর গাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো। দরোজা খুলে ড্রাইভিং সীটে বসে ওদেরকে উঠতে বল্লো। ইলা শাহেদেকে সামনের সীটে বসতে বলে নিজে পিছনের সীটে যেয়ে বসলো। উর্মিলা গাড়ি স্টার্ট দিয়ে নিজের সীট বেল্ট বাঁধতে যেয়ে পাশের সীটে শাহেদকে দেখে চোখ ঘুরিয়ে পিছনের সীটের দিকে তাকালো। ওর জিজ্ঞাসু দৃষ্টির উত্তরে ইলা একটা হাসি দিয়ে বল্লো, চলো। (চলবে)
ইউসুফ কামাল : কেটি, টেক্সাস, ইউএসএ