বিদ্যুৎ সরকার : ট্রেন ছাড়তে আর মাত্র পনের মিনিট বাকি। হাতে সময় নিয়েই বাসা থেকে রওনা দিয়েছি। কিন্তু, শেষ মুহূর্তে সাত সকালে যে এমন ট্রাফিক জ্যামে পড়তে হবে কে জানতো? ড্রাইভারকে বললাম বিকল্প পথ দিয়ে চালিয়ে যেতে। সময় মত সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ায় কিছুটা সময় থাকতেই স্টেশনে পৌঁছতে পারলাম বটে কিন্তু অনেকটা দৌড়ে গিয়ে কামড়াতে উঠতে সমর্থ হলাম। স্লাইডিং ডোর টানতেই ভেতরের মেয়েটাকে দেখলাম জানালা দিয়ে বাইরে কি যেন খুজছে? ‘গুড মর্নিং’ বলতেই আমার দিকে মুখ ঘুরিয়ে জবাব দিল ‘গুড মর্নিং’।
– আমার নাম অমিত, তাই বলে ‘শেষের কবিতা’র অমিত রে নয় কিন্তু!
– আমি সুতপা।
– ভালোই হলো অনেকটা পথ আজ কথা না বলে কাটাতে হবে না। প্রায়ই একাকী এ দীর্ঘ সময় যেতে হয় অনেকটা মুখ বুজেই। তখন সেল ফোনই হয়ে উঠে নিঃসঙ্গতার একমাত্র সরব সঙ্গী।

– কেমন করে ভেবে নিলেন সব্বাই আপনার এ নিরবতার সরব সঙ্গী হবে।
– না হলেও আপত্তি নেই তবুও অন্তত ভেবে নেব কামড়ায় আমি ছাড়াও অপর কারোর উপস্থিতি রয়েছে। সেটা সরব কিংবা নিরব যেটাই হোক না কেন।
– প্রায়ই আপনাকে চিটাগাং যেতে হয় বুঝি?
– মোটামুটি, প্রতি মাসে অন্তত দু’তিনবার তো অবশ্যই।
– মাসে একবার মেনে নেয়া যায় তাই বলে দু’তিন বার?
– আমারও যে ভাল লাগে তা কিন্তু নয়। চাকরির খাতিরেই যেতে হচ্ছে। সে জন্য সময় কাটাতে তখন বই-পত্রই হয়ে যায় পরম প্রিয়।
– তাই বলে ‘সানন্দা’?

– সানন্দাকে খাটো করে দেখার কোন অবকাশ নেই, সানন্দায় খুঁজে নেয়া যায় আনন্দ। অনেক অজানা তথ্য-উপাত্ত মিলে যায়। আমার কাছে এটি একটি সুখ পাঠ্য রম্য পত্রিকা। আই এঞ্জয় ইট।
– আমারও খুব প্রিয়।
– এখন কোনটা দেবো, পত্রিকা অর সানন্দা?
– এ মুহূর্তে দুটো’র আবেদনই সমান সমান, কিন্তু আজকের কাগজটা শুধু একটু চোখ বুলাতে চাই। তাড়াহুড়ো করে উঠতে গিয়ে পেপার কিনতে ভুলে গিয়েছিলাম তাই জানালা দিয়ে চোখ রাখছিলাম হকারের খোঁজে।

এরই মধ্যে গাড়ি ছাড়ার হুইসেল বেজে উঠলো। আস্তে আস্তে চলতে শুরু করে দিল গাড়ি। সকালের ব্র্যাকফাস্ট, দুপুরের লাঞ্চ গাড়িতেই সেরে নেয়ার সুবন্দোবস্ত রয়েছে গাড়িটাতে। এদের খাওয়ার মানও ভাল। এরই মধ্যে ডাইনিং কারের এটেন্ডেন্ট এসে ব্র্যাকফাস্ট দিয়ে গেল এবং দুপুরের লাঞ্চের মেনু সম্পর্কে জেনে নিয়ে গেল। দূর পাল্লার ট্রেন জার্নিতে খেতে খেতে জানালা দিয়ে দৃশ্যমান গ্রামীণ সবুজ বনভূমি ঘরদোর দেখতে দেখতে এক অজানা শিহরণ নিয়ে পৌঁছে যাওয়া যায় গন্তব্যে। দৈনিক পত্রিকায় মিনিট কয়েক চোখ বুলিয়ে অর্থাৎ হেডিংগুলো দেখেই ফেরৎ দিয়ে দিল সুতপা।
– পড়া শেষ?
– না, দেখা শেষ। আপনি পড়ুন, আমি না হয় পরে পড়ে নিব।
– এবার তা হলে সানন্দা’য় চোখ বুলান।

– সানন্দা আমি রেগুলার পড়ি, বেশ ভাল লাগে। পাঁচমিশালী অনেক কিছুর সমারোহ, তথ্যবহুল। শুধু যে মেয়েদের জন্য এ পত্রিকা তা ভাবা সঠিক না।
– তা হলে আমার দলেই ভিরে গেলেন দেখছি!
– যা সত্যি তাই বললাম।
– অন্য প্রসঙ্গে যাওয়া যাক? চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে অমিত সুতপার প্রতি প্রশ্ন ছুড়ে দিল।
– কোনটাতেই আমার আপত্তি নেই।
– আপনি কি বাড়িতে ফিরছেন, না কি বাড়ি থেকে জবে?

– আসলে আমার ইন্টার্নশিপ অনেক আগেই শেষ হয়েছে। ঢাকায় একটি ভাল অফার না পাওয়া অব্দি চট্টগ্রামেই থাকতে হচ্ছে আমাকে। আপাতত চট্টগ্রামে একটি ক্লিনিকে কাজ করে যাচ্ছি।
– প্রেজেন্টলি আমাকে মাঝে মাঝে চট্টগ্রাম আসতে হচ্ছে আর আপনাকে চট্টগ্রাম থেকে ছুটি-ছাটায় ঢাকায় যেতে হয় অবকাশ যাপনের উদ্দেশ্যে পার্থক্যটা শুধু এটুকুই।
– বাট আই লাভ চট্টগ্রাম ফর ইট্স ন্যাচারাল বিউটিস।
– মি টু।
– কিন্তু নট ফর এ লং টাইম। মাঝে মাঝে সময় পেলেই ছুটে যাই নৈসর্গিক দৃশ্যের কাছাকাছি।

– গতবার গিয়েছিলাম শিলং, ভালো লেগেছে ভীষণ। পাহাড়ের নিরবতা, সবুজের হাতছানি এবং বিশেষ করে শিলং থেকে গৌহাটি যাবার চড়াই-উতরাই পাহাড়ি রাস্তা মন ভরিয়ে দেবে আপনার।
– এ ধরনের সৌন্দর্য খুঁজে পাবেন আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের সড়ক পথে রাঙ্গামাটি, বান্দরবন, কক্সবাজার ভ্রমণ কালে। আমাদের দেশের আনাচে কানাচে অনেক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে ভালোবেসে খুঁজে পেতে হবে আপনাকে।
– রবির কবিতায় তো বলা আছে -‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া ঘর হতে দুই পা ফেলিয়া একটি ধানের শিষের উপর একটি শিশির বিন্দু…..।’ আমরা এ সত্যটি ভুলে যেতে বসেছি!
– প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দিক দিয়ে বিবেচনা করলে আমাদের এ দেশ ভীষণভাবে রিসোর্সফুল। কিন্তু আমরা তা মনে রাখতে চেষ্টা করি না। অপরের সৌন্দর্যে পুলকিত হই, মোহিত হই।
– অনেক্ষণ হয়ে গেল সেকেন্ড কাপ চা হলে মন্দ হয় না, কি বলেন?

– এজ ইয়্যূ উইশ এই যে ওয়ার্ল্ডকাপ ফুটবল চলছে পৃথিবীর অলমোস্ট ফুটবল প্লেইং সকল কান্ট্রির লোকজন হুমরি খেয়ে টি ভি স্ক্রিনে দৃষ্টি মেলে ধরেছে। আমিও আমার প্রিয় টিমগুলোর খেলা মিস করতে চাই না। কিন্তু আমার খারাপ লাগে তখন যখন দেখি আমার দেশের এক ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী বিভিন্ন টিমের সাপোর্টার হিসেবে সে দেশের পতাকা দিয়ে আকাশ সাজিয়ে তোলে। অথচ আমার দেশের মেয়েরা যে স¤প্রতি সার্ক ফুটবল প্রতিযোগিতায় দেশের জন্য এতো বড় বিজয় ছিনিয়ে আনলো তাতে তাদের কোন ভ্রæক্ষেপ নেই। নেই কোন উল্লাস, উচ্ছ¡াস!
– আপনার ফেভারিট টিম কোনটি?

– আসলে নির্দিষ্ট কোন টিমের প্রতি আমার পক্ষ পাতিত্ব নেই, বেশ কয়েকটি টিমের খেলা আমার ভালো লাগে। তবে এবার ছোট টিমগুলো বেশ ভাল খেলছে। আমি ওদের খেলায় অনেকটাই আশাবাদী। সেটা বিবেচনা করলে আমাদের দেশের পুরুষ টিমগুলোর সার্বিক উন্নয়ন আশাব্যঞ্জক নয়।
– আপনি তো খেলাধুলা সম্পর্কে বেশ জ্ঞান রাখেন।
– অতশত বুঝি না, ফুটবল ও ক্রিকেট আমার ভীষণ ভাল লাগে।
– অবসর সময়গুলো কেমন করে কাটে আপনার?
– আগেতো অবসর সময় বলতে কিছুই ছিল না। আমার প্র্যাক্টিকেল ক্লাস, এসাইনমেন্ট জমা দেয়া এবং এক্সাম এটেন্ড করতে করতে অন্য কিছু করার ফুরসত মিলতো না।

– এখন নিশ্চয় এতোটা ব্যস্ত না?
– তা অবশ্য নয়। সময়গুলো কাজে লাগাতে চেষ্টা করি সে জন্য বই পড়া,মুভি দেখা, গান শোন এবং একটু বেশি সময় পেলে কাছে বা দূরে কোথাও বেড়াতে যাওয়া আমার অবসরের অনুষঙ্গী হয়ে উঠে।আপনার সম্পর্কে কিছুইতো জানা হলো না।
– অনেকটা একই রকম বলা চলে।পার্থক্য শুধু অবসরে আপনি বইও পড়ে থাকেন আমার সেটার ঘাটতি আছে। পড়তে গেলে যে কনসেন্ট্রেশন দিতে হয় আমার সেখানে শূন্যের কোঠায় অবস্থান।তবে বাড়তি যে অপর একটি বিষয়ে আমি অনেকটাই মনযোগী ও উৎসাহী সেটা হলো ‘ফটোগ্রাফি’।
– কামড়ায় প্রবেশের সময়ই লক্ষ্য করেছি আপনার কাঁধেঝুলানো ক্যামেরার ব্যাগটি।
কি ধরনের ফটোগ্রাফিতে আপনার ভাললাগা?

– সাধারণত ল্যান্ডস্কেপ আমার পছন্দের বিষয় আর সেকেন্ড চয়েস হলো স্ট্রিট ফটোগ্রাফি।
– যদিও আমি ফটোগ্রাফি করি না তবুও ফটোগ্রাফি বিষয়টি আমার পছন্দ এবং ফটোগ্রাফারের কেরেক্টার ভীষণ ইন্টারেস্টিং।
– ‘ফটোগ্রাফারের কেরেক্টার’ বলতে কী বোঝাতে চেষ্টা করছেন আপনি?
– আসলে যারা ফটোগ্রাফি করে তাদের দু’ধরণের চোখ, একটি বহিরাঙ্গনের চোখ অপরটি অন্তদৃষ্টি। যে কোন বস্তুকে উনারা দু-ভাবে দেখতে চেষ্টা করে থাকে।
সীতাকুণ্ড থেকেই পাহাড়ের গা ছুঁয়ে ছুঁয়ে ট্রেন এগুতে থাকে গন্তব্যের দোরগড়ায়। সবুজের স্নীগ্ধতা আর ঢেউ খেলানো মনোরম পাহাড়ি উপত্যকা বয়ে আনে এক দৃষ্টিনন্দন পাহারি শোভা। অপর পাশে রয়েছে কল্লোলিত জলরাশির অনন্তের হাতছানি।এরই মধ্যে ট্রেন পাহাড়তলী স্টেশন ক্রস করে এসেছে। কিছুক্ষণ পড়েই সবাইকেই নেমে যেতে হবে যার যার অন্তিম গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। অমিত – সুতপা দু’জন ব্যাগ গোছাতে গোছাতে কথোপকথনে চালিয়ে যাচ্ছিল।সুতপার প্রশ্ন-

– ওপার বাংলার প্রসেনজিৎ-ঋতুপর্ণা অভিনিত ‘প্রাক্তন’ ছবিটি দেখেছেন?
– সরি, দেখিনি।
– সময় করে দেখে নেবেন। আর যদি সম্ভব না হয় অন্তত রবি ঠাকুরের ‘হঠাৎ দেখা’ কবিতাটা পড়ে নেবেন।
কথাগুলো বলে নিমিষেই ভিরের মাঝে সুতপা কোথায় যে হারিয়ে গেল অনেক খুঁজেও পেল না অমিত। হঠাৎই অমিত অনুধাবন করলো সুতপার ফোন নাম্বার বা ঠিকানা কিছুইতো রাখা হলো না তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে! তবে কি কোনদিন আর সুতপার সাথে তার দেখা হবে না বা কথা হবে না কোন কালেও?
বিদ্যুৎ সরকার : লেখক ও আলোকচিত্রী, টরন্টো, কানাডা