নাদিরা তাবাস্সুম : প্রতিদিন বন্ধুদের আড্ডায় আজকাল একটা ‘কমন’ উক্তি প্রায় শোনা যায় ‘না ভাই, ভালো থাকার আর কোন উপায় নেই। চারদিকে যে হারে রোগ শোক মহামারী, বন্যা, জলোচ্ছাস, টর্ণেডো, অগ্ন্যূত্পাত সেই সাথে যুদ্ধের রণহুংকার। সাধারণ মানুষ দুর্ভিক্ষ ও মৃত্যু আশংকায় দিন গুণছে। নিত্য নতুন ভাইরাসের আগমন ও প্রতিরোধ বিষয়ে চিন্তিত চিকিত্সাবিজ্ঞান’।

সাফিদ বলে- এসব থেকে কি মানুষের মুক্তি নেই?
মুকিত – হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোথা? নির্বাক বিস্ময়ে সবার প্রশ্ন কি ঘটে চলেছে একমাত্র বাসযোগ্য এই পৃথিবীর বুকে? মহাবিশ্ব হোক না স¤প্রসারিত, থাকুক না যত মহাবিশ্ব; এলিয়েন থাকুক না কোথাও কোন বিশ্বে – তাতে মানুষের নিত্য আনাগোনা জীবন জীবিকা তো থেমে থাকে না। জীবন খুঁজে ‘বেঁচে থাকা’, যেখানে থাকবে না কোন যুদ্ধ-বিগ্রহ, হানাহানি-মারামারি, দুর্যোগ মহামারী বা দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষের হাহাকার। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সকলেই চলছে ঘুরছে; তারা জীবন্ত ও সচেতন, তবে কি তারা শোনে না বা দেখে না মানুষের কান্না?

সাফিদ – বাহ, চমত্কার বলেছো, এই না হলে তুমি কবি। আমার মনে হয় কি জানো, এমন এক সময়ে পৃথিবী এসে পৌঁছছে যেখান থেকে তার ফিরে যাওয়ার পথ নেই যেমন পরিণত বয়স্ক একজন মানুষের পক্ষে শৈশব কৈশোরে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। যদিও মস্তিষ্ক স্মৃতিতে ধরে রাখে তাদের ফেলে আসা কিছু ঘটনা যেমন পৃথিবীর অতীত ঘটনা ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকে।

মুকিত – বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় তৃপ্ত জীবন, ছুটে চলেছে উত্সের সন্ধানে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। বলে কিনা প্রত্যেক মানুষের আর এক কপি থাকতে পারে অন্য কোন বিশ্বে। বিষয়টা ভাবতে পারো? বিশ্বের সকল বস্তু ক্ষুদ্রতম পর্যায়ে একই উপাদানে গঠিত- যারা কেবলই এনার্জি, আলো ও ভাইব্রেশন; যাদের খালি চোখে দেখা যায় না। – বিজ্ঞান বলে মহাবিশ্বের মাত্র ৫% আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় আর বাকী ৯৫% অদৃশ্য থাকে যা ‘ডার্ক এনার্জী’ ও ‘ডার্ক ম্যাটার’- অত্যন্ত সামান্যতম দৃষ্টিশক্তি নিয়ে আমরা অতি সামান্যই জানতে পারি। তবে তিন পাউন্ড ওজনের নিউরোন সমষ্টি নিয়ে গঠিত এই ছোট্ট মস্তিষ্ক আবেগ, অনুভূতি, দয়ামায়া এবং জ্ঞান বিজ্ঞানের চেতনা সৃষ্টি করে এবং গোটা মহাবিশ্বকে নিয়ে চিন্তা ও গবেষণা করতে পারে।

সাফিদ – মনোজগত রহস্য এবং বহির্জগত বা মহাবিশ্ব গঠন রহস্যের সন্ধানে বিজ্ঞানীদের প্রচেষ্টা আজও অব্যাহত আছে ও থাকবে।

মুকিত- প্রতিমুহূর্তে কোন না কোন চিন্তা মস্তিষ্ককে ব্যস্ত করে রাখে এবং কোন কার্য বহির্জগতে বাস্তবায়িত বা সংঘটিত হওয়ার পূর্বে মনোজগত বা মস্তিষ্কে তার ক্রিয়াকলাপ সংঘটিত হয়। এজন্য সত্চিন্তা বা ইতিবাচক চিন্তার এত গুরুত্ব। দুই ধরনের মানসিকতা তাই লক্ষ্য করা যায় এক- ইতিবাচক বা গঠন মূলক এবং দুই- নেগেটিভ বা ধ্বংসাত্বক।
সাফিদ – পৃথিবীতে যদি নেগেটিভ বা নেতিবাচক চিন্তার অস্তিত্ব না থাকে তাহলে অশান্তি বৈষম্য দ্ব›দ্ব হানাহানি কিছুরই অস্তিত্ব থাকে না। পৃথিবী ছেড়ে অন্য কোথাও যাওয়ারও চিন্তা থাকে না। তবে আমার মনে হয় কি জানো – জীবনের উদ্দেশ্য হলো, জ্ঞানবুদ্ধি দিয়ে ভালোমন্দ বিচার করা এবং মন্দ বেছে নিলে তার জন্যে দুঃখ যন্ত্রণা ভোগ করা- এসবই মানুষের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এসবের মধ্য দিয়ে মানুষ যেন দয়া, মায়া, প্রেম, ক্ষমা, ধৈর্য, সত্যবাদিতা, ন্যায়পরায়ণতা ইত্যাদি গুণাবলীসমূহ অর্জন করে এবং পরিশেষে সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহতায়ালার সামনে উপস্থিত হতে পারে।

মুকিত- আমেরিকান নিউরোসার্জন ইবেন আলাকজান্ডার তার বিখ্যাত বই ‘প্রæফ অফ হেভেন’-এ বর্ননা করেছেন কিভাবে তিনি ‘ব্যাক্ট্রিরিয়াল ব্রেইন ম্যানেঞ্জাইটিস’ রোগে আক্রান্ত হয়ে কোমায় সাতদিন থেকেছেন এবং কোমায় থাকার সময় পরবর্তী জীবনে ভ্রমণ করার অভিজ্ঞতা বর্ননা করেছেন। তিনি জানিয়েছেন যে, সচেতনতা (‘কনশাসনেস’) ব্রেইন এর উপাদান শুধু নয়, তা তাকে পরবর্তী জীবনে ভ্রমণ করিয়েছে যা ছিল স্বর্গীয় ও মনোমুদ্ধকর। আত্মিক স্নিগ্ধতা, দয়া মায়া, প্রেম ভালোবাসাপূর্ণ এক নতুন জীবন। আত্মার জগত প্রেমময়, সুস্পষ্ট ও সত্য। মানুষ শুধু পার্থিব সৃষ্টি নয়, আধ্যাত্মিকও। তিনি একজন বিজ্ঞানী হিসাবে মনে করেন এযেন এক মহান বার্তা তিনি পেয়েছেন যা তিনি বিশ্ব মানবতার জন্য উপস্থাপন করতে চান। অতীত জীবনে তিনি আধ্যাত্মিক বিষয়ে জ্ঞাত না থাকলেও এখন তিনি তা উপলব্ধি করতে পেরেছেন। এভাবে অনেক জড়বাদী বিজ্ঞানীদের আত্মিক জগতের সত্যতা বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে।

সাফিদ – এ জন্য পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহতায়ালা বিভিন্ন বিষয়ে কিভাবে আধ্যাত্মিক পবিত্রতা অর্জন করা যায় তা উল্লেখ করেছন, ‘কালের শপথ, মানুষ অবশ্যই ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত রয়েছে। ঐ সকল লোক ব্যতীত যারা ঈমান এনেছে, নেক কাজ করে এবং একে অন্যকে সত্যের উপদেশ প্রদান করতে থাকে ও একে অন্যকে ধৈর্য্যের উপদেশ প্রদান করে‘ (সূরা আসর; আয়াত ১-৩); ‘আপনি বলুন, হে মানুষ! তোমাদের কাছে এসেছে রবের পক্ষ হতে সত্য; অতএব যে সুপথ পায় সে তো নিজের হিতের জন্যই পায়। আর যে ভ্রষ্ট হয় ভ্রষ্টতা তারই ঘাড়ে। আমি তোমাদের উপর কর্মবিধায়ক নই’ (সূরা ইউনুস; আয়াত ১০৮); ‘নিকট আত্মীয়কে তার হক দাও, মিসকীন ও পথিককেও তার হক দাও। আর তোমরা অপব্যয় থেকে বিরত থাক’ (সূরা বনি ইসরাইল; আয়াত ২৬); ‘আর মন্দের প্রতিফল অনুরূপ মন্দ, আর যে মাফ করে ও সংশোধন করে আল্লাহর কাছে তার পুরস্কার রয়েছে।
নিশ্চয়ই আল্লাহ জালিমদেরকে ভালোবাসেন না (সূরা শূরাঃ আয়াত ৪০); ‘ক্ষমাপরায়ণতা অবলম্বন করুন, সত্কাজের নির্দেশ দিন এবং অজ্ঞদেরকে উপেক্ষা করুন’ (সূরা আরাফঃআয়াত ১৯৯);’ যারা ব্যয় করে সচ্ছল ও অসচ্ছল অবস্থায় আর তারা ক্রোধ দমন করে, আর ক্ষমা করে মানুষকে; আল্লাহ সত্কর্মশীলদের ভালোবাসেন’ (সূরা আল ইমরানঃ আয়াত ১৩৪); ‘তুমি এমন বিষয়ের অনুসরণ করোনা, যে বিষয়ে তোমার জানা নেই, কর্ণ, চক্ষু ও মন সহ প্রত্যেকটির ব্যাপারে তোমাদের জিজ্ঞাসা করা হবে’ (সূরা বনি ইসরাইল; আয়াত ৩৬)

মুকিত – মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে গুরুত্বপূর্ণ আয়াতসমূহ শপথ দিয়ে শুরু করেছেন। তিনি সূরা শামস –এর ১ নং হতে ১০ নং আয়াতে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টি সমূহের শপথ করে বলেছেন ‘শপথ সূর্য ও তার কিরণের, আর সূর্যের পশ্চাতে আসা চন্দ্রেরও শপথ, আর সূর্যকে প্রকাশকারী দিবসেরও, আর সূর্য আচ্ছাদনকারী রাতেরও, আর আকাশ ও তার নির্মাতার, আর পৃথিবীর ও সংস্থাপনকারীর, আর মানবের ও সুবিন্যস্তকারীর, যিনি তাকে পাপ-পূণ্যের জ্ঞান দিলেন, সে সফলকাম যে নিজেকে পরিশুদ্ধ করলো, আর সেই ব্যর্থ, যে পাপাচারে কলুষিত হয়েছে ‘।