অনলাইন ডেস্ক : মাত্র ১২ বছর বয়সে প্রেসিডেন্টের শপথ অনুষ্ঠান প্রত্যক্ষ করেছিলেন। গত মার্চে সেই মেয়েটি ৮২ বছরে পা দেন। আট বছর তিনি কংগ্রেসের স্পিকার পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৮৭ সালে তিনি যখন কংগ্রেসের সদস্য পদের নির্বাচনে প্রার্থী হন তখন ‘অ্যা ভয়েস উইল বি হিয়ার্ড’ শীর্ষক একটি স্লোগান দিয়েছিলেন, যা আজও সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। ৪৬ বছরের রাজনৈতিক জীবনে ৩৫টি বছর তার কংগ্রেসেই কেটেছে। এসব কিছুর মাধ্যমেই গৃহিণী থেকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী নারীতে পরিণত হয়েছেন। সেই তিনি হলেন ন্যান্সি পেলোসি। পুরো নাম ন্যান্সি ডে আলেসান্দ্রো পেলোসি। রাজনৈতিক পরিবারে বেড়ে ওঠা পেলোসির রাজনৈতিক জীবনটাও বর্ণাঢ্য। তিনি উদারপন্থিদের কাছে প্রিয় হলেও অতি ডান এবং অতি বামদের কাছে ঘৃণিত বলেই মনে করা হয়। সম্প্রতি তার স্বামী পল পেলোসির ওপর হামলার ঘটনাও সেটাই প্রমাণ করছে।

পুরুষশাসিত কংগ্রেসে নারীর প্রাধান্য : যুক্তরাষ্ট্রে সংবিধান অনুযায়ী, প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্টের পর তৃতীয় ক্ষমতাধর পদটি হলো কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার। সেই পদে আটটি বছর দায়িত্ব পালন করেছেন ন্যান্সি পেলোসি। তবে ডেমোক্র্যাটদের হয়ে গত ২০ বছর ধরে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। সত্যের সঙ্গে আপস না করা পেলোসি স্পিকারের দায়িত্ব পালনকালে অনেক প্রেসিডেন্টের প্রস্তাব আটকে দিতে যেমন ভয় পাননি, তেমনি দেশের স্বার্থে আসা বিলটি দলের মতের বিরুদ্ধে গেলেও পাশ করার কাজটি এগিয়ে নিতে কার্পণ্য করেননি। তার সততাই তাকে সাহস জুগিয়েছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। আবার ডেমোক্র্যাট পার্টিকে ঐক্যবদ্ধ রাখার ক্ষেত্রেও তার অবদান ছিল অনস্বীকার্য। প্রতিনিধি পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকলেও তিনি দলের পক্ষে বিভিন্ন প্রস্তাব পাশ করায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, তার ম্যানেজ করার দক্ষতটা ছিল সত্যিই বিস্ময়ের। তিনি যে স্লোগান দিয়ে রাজনীতি শুরু করেছিলেন তা রাজনৈতিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই কাজে লাগিয়েছেন। তিনি স্লোগানটিকে বিলবোর্ড আকারে টানিয়ে রাখেন।

১৯৮৭ সালে যখন প্রথম কংগ্রেস সদস্য নির্বাচিত হন পেলোসি তখন ৪৩৫ আসনের প্রতিনিধি পরিষদে নারী ছিলেন মাত্র ২৩ জন। ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে কংগ্রেসের প্রথম নারী স্পিকার নির্বাচিত হন পেলোসি। ৬০তম স্পিকার পেলোসি তার প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, ‘এজন্য আমি ২০০’ বছর ধরে অপেক্ষা করছি।’ শিক্ষাজীবন শেষ করে পেলোসি ঘর সামলানোর দায়িত্ব নেন। পাঁচ সন্তানের (চার মেয়ে ও এক ছেলে) মা হিসেবেই জীবন কাটাতে শুরু করেন। রাজনীতিতে আসার ইচ্ছা না থাকলেও রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান ও ধনী ব্যবসায়ীর স্ত্রী পেলোসিকে রাজনীতিই টানছিল। ১৯৭৬ সালে তিনি রাজনীতিতে যোগ দেন। পরিবারের সুবাদে তিনি ক্যালিফোর্নিয়ার ধনীদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলার সুযোগ পান। তিনি অল্প দিনেই ক্যালিফোর্নিয়ায় ডেমোক্র্যাটিক পার্টির চেয়ারম্যান হন। এরপর ১৯৮৭ সালে কংগ্রেস সদস্য পদে জয়ের পর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ২০০২ সালে প্রতিনিধি পরিষদের সংখ্যালঘিষ্ঠ দলের হুইপ হন। ২০০৩ সালে তিনি প্রতিনিধি পরিষদে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নেতা নির্বাচিত হন। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে পেলোসি রাজনীতির পুরুষশাসিত বিশ্বকে জয় করেছেন বলে মন্তব্য করেছে ওয়াশিংটন পোস্ট। মার্কিন সংবাদপত্রটির এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, পর্দার আড়ালে থেকে সরকারের জন্য কঠোর পরিশ্রম পেলোসিকে প্রতিনিধি পরিষদের প্রথম নারী স্পিকার এবং যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে সফল হাউজ নেতাদের একজনে পরিণত করেছে।

বেড়ে ওঠা রাজনৈতিক পরিবারে : পেলোসি মাঝেমধ্যেই বলে থাকেন যে, রাজনীতিতে আসা বা সরকারি অফিসে দায়িত্ব পালন করার কোনো ইচ্ছা তার ছিল না। অথচ তার জন্মটাই রাজনৈতিক পরিবারে। তার বাবা থমাস ডে আলেসান্দ্রো জুনিয়র মেরিল্যান্ড রাজ্যের বাল্টিমোর শহরের মেয়র ছিলেন। কংগ্রেসেও তিনি পাঁচ বার প্রতিনিধিত্ব করেছেন। ভাই থমাস আলেসান্দ্রোও (তৃতীয়) একই শহরের মেয়র ছিলেন। পেলোসি প্রায়ই তার বাবার প্রচারণায় যোগ দিতেন। সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রচারণা বিভাগের প্রধান কৌঁসুলি ডেভিড অ্যাক্সেলরড এক বার পেলোসিকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, বাবার প্রচারণা থেকে তিনি কী শিখেছেন। জবাবে পেলোসি বলেছিলেন, ভোট গণনা। কীভাবে ভোট গণনা করতে হয় এবং ফলাফল তৈরি করতে হয়—সেই বিষয়ে ছোটবেলাতেই প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন। ১৯৬২ সালে ওয়াশিংটনের ট্রিনিটি কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ব্যাচেলর ডিগ্রি লাভ করেন। একই বছর তিনি পল পেলোসির সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। বিয়ের পর পেলোসি প্রথমে নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটন এবং পরে সানফ্রান্সিসকোতে চলে আসেন।

আপসহীন পেলোসি : লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমসের এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, গৃহিণী থেকে প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার হয়েছেন পেলোসি। রাজনৈতিক জীবনে চলার পথে তিনি কখনো আপস করেননি। তার রাজনৈতিক জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কিছু মুহূর্ত রয়েছে। ২০০৩ সালে তিনি ইরাকে মার্কিন যুদ্ধের অন্যতম প্রধান এবং সোচ্চার বিরোধী ছিলেন। এই বিরোধিতাই ১২ বছর পর ২০০৬ সালে প্রতিনিধি পরিষদে ডেমোক্র্যাটদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা এনে দেয়। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে ২০২০ সালে ট্রাম্পের স্টেট অফ দ্য ইউনিয়ন ভাষণটি তার পেছনে দাঁড়িয়েই ছিঁড়ে ফেলেছিলেন পেলোসি। এজন্য তিনি ট্রাম্পের অনুসারীদের শত্রুতে পরিণত হয়েছিলেন। বরাবরই তিনি গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার স্বোচ্চার কণ্ঠ। তিনি একজন নির্ভীক নেতা, যিনি দলের ভেতরে সমালোচনার মুখেও সাম্প্রতিককালে তাইওয়ান সফর করেছেন। তিনি তার মেয়াদে বেশ কয়েক জন প্রেসিডেন্টের এজেন্ডাকে এগিয়ে নিতে বা আটকে দেওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছেন। তার রাজনৈতিক প্রবৃত্তি এবং বিচক্ষণতা তাকে মার্কিন রাজনীতিতে শক্ত অবস্থান দিয়েছে।

২০১৮ সালে পেলোসির কিছু এজেন্ডা ছিল যা রিপাবলিকানদের ক্ষুব্ধ করেছিল। সেই বিষয়ে মধ্যবর্তী নির্বাচনে তখনকার রিপাবলিকান নেতা ডেভিড ব্রাট বিতর্কে পোলোসির লিবারেল এজেন্ডা এবং পেলোসির নাম ২১ বার উচ্চারণ করেছিলেন। ব্রাটের এই কাজটি রিপাবলিকানদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল এবং ডেমোক্র্যাটরা প্রতিনিধি পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তার স্বাস্থ্য বিল অ্যাফরডেবল কেয়ার অ্যাক্ট বা ওবামা কেয়ার পাশ করাতে সংশয়ে ছিলেন। কারণ ডেমোক্র্যাটদের সামান্য সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল। কিন্তু পেলোসি তার দক্ষতার জেরে সেই বিল পাশ করিয়েছিলেন। তার কাছে সবচেয়ে কষ্টদায়ক শেষ মুহূর্তটি ছিল স্বামী পল পেলোসির ওপর হাতুড়ি দিয়ে হামলার ঘটনা। তিনি বলেছিলেন, এ ঘটনায় তার হূদয় ভেঙে গেছে।

ট্রাম্পকে একহাত নিয়েছিলেন : ২০১৮ সালে প্রতিনিধি পরিষদে জয় পেলেও প্রেসিডেন্ট ছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। সিনেটেও সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা ছিলেন রিপাবলিকান মিচ ম্যাককোনেল। তাই তিনি যে কোনো এজেন্ডা পাশ করলেও সিনেটে তা নাকচ হয়ে যেত। এরপরও পেলোসি দমে যাননি। তিনি তিন বার ট্রাম্পকে অভিশংসনের করার চেষ্টা চালিয়েছিলেন। ২০১৯ সালে ইউক্রেন ইস্যুতে তিনি ট্রাম্পকে আঘাত করেছিলেন। ইউক্রেনকে চাপ দিয়ে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী জো বাইডেনবিরোধী তথ্য আদায়ের অভিযোগও ট্রাম্পের বিরুদ্ধে এনেছিলেন পেলোসি। তিনি এটাকে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার অপব্যবহার বলে উল্লেখ করেছিলেন। ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিশংসন প্রস্তাব পরিষদে পাশ হলেও সিনেটে মুক্তি পেয়ে যান। এরপর বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর ট্রাম্পের বিরুদ্ধে তদন্ত এগিয়ে নিয়ে যাওয়া পেলোসি হার মানেননি। তবে রিপাবলিকানরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পর স্পিকার পদ থেকে গত ১৭ নভেম্বর সরে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। আগামী বছরের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে নতুন নেতা দায়িত্ব নেবেন। কিন্তু পেলোসি কংগ্রেস ছাড়ছেন না, বরং কংগ্রেসে ক্যালিফোর্নিয়ার ১২তম ডিস্ট্রিক্টের প্রতিনিধিত্ব করবেন তিনি। নিজ আসনের জনগণের প্রতি আরো বেশি মনোযোগ দেবেন তিনি। তিনি জানিয়েছেন, স্পিকার পদটি ছেড়ে দিয়েছেন নতুন প্রজন্মের জন্য।