মনিস রফিক : কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো নিজের জন্ম, বেড়ে উঠা আর কানাডার নেতৃত্বে আসার অসাধারণ কিছু ঘটনা উপস্থাপন করেছেন তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এ। জাস্টিন ট্রুডোর সাবলীল আর অসম্ভব সুন্দর বর্ণনা খুব সহজেই পাঠকের সামনে উম্মোচিত করে কানাডার রাজনীতি, সংস্কৃতি আর স্বপ্নকে। ইংরেজি ভাষায় লিখিত গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মনিস রফিক। ‘বাংলা কাগজ’ এ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এর অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে।
একান্ন.
কানাডার ধনী আর দরিদ্র মানুষেরা কদাচিত একে অপরের সাথে মেলামেশা করে। ব্যক্তি পুঁজির উর্ধ্বগতি আর আয়ের ব্যাপক বৈষম্য মানুষের মাঝে এমন এক অদৃশ্য বিভেদ রেখা তৈরী করে দিয়েছে। বেশি না, মাত্র এক প্রজন্ম আগেও একই মহল্লায় ডাক্তার, আইনজীবী, রাজমিস্ত্রী, শিক্ষক, দোকানের মালিক আর দোকানের কর্মচারী একই সাথে বসবাস করতো। তাদের বাড়িঘর আর গাড়ির আকার হয়তো একই হতো না, কিন্তু একই দোকানে তারা বাজার করতো, একই পার্কে তারা হাঁটাহাঁটি করতো আর একই গীর্জায় তারা প্রার্থনার জন্য যেতো। এমন এক পরিবেশ আর সমাজ ব্যবস্থার ফলে নীতি নির্ধারক আর আইন প্রণেতারা খুব সহজেই মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্ত মানুষদের সম্পর্কে ভালোভাবে জানার একটা সুযোগ পেতো, আর এর প্রধান কারণই ছিল সমাজের এই সব মানুষের সাথে তাদের একটা মেলামেশা ছিল এবং খুব কাছ থেকে তারা একে অপরকে দেখতে পেতো। তাছাড়া, বেশির ভাগ সময়ই দেখা যেতো, এই মানুষগুলো হয় তাদের বন্ধু, না হয় তাদের পাড়া প্রতিবেশী। এখন অধিকাংশ কানাডার শহরগুলোতে আর এমনটা নেই। পাপিনিউ’তে তুমি এক বøক হেঁটে গেলেও সাধারণত এমন কারো দেখা পাবে না, যার বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী আছে বা যার উপার্জন ছয় অংকের ঘরে। অন্যদিকে আউটারমন্ট আর ওয়েস্টমাউন্ট এ এমন কোন বাড়ির মালিক পাবে না যার কম করে কলেজের ডিগ্রী নেই।
ঐ যে বলা হয় না, জন্ম একজনের জীবনের গতিপথ তৈরী করে দেয়, আমি অনুভব করেছি, বিষয়টা যত না বেশি রূপক তার চেয়ে বেশি আক্ষরিক। পাপিনিউ’র সেই পশ্চিম দিকের কঠিন জীবন যাপনের মহল্লা পার্ক-এক্সটেনশন এর তিন দিকের একদিকে ছিল হাইওয়ে আর দুই দিক ছিল রেল লাইনের বেস্টনী দিয়ে ঘেরা। আর চতুর্থ দিক অর্থাত পশ্চিম দিকে ছিল এক ধরনের চেইন এর বেড়া। সেই বেড়ার কয়েক ধাপ দূরেই শুরু হয়েছিল গাছপালা আর চকচকে মাউন্ট রয়্যাল শহর। ঐ বেড়াটা রয়্যাল মাউন্ট এর বাসিন্দাদের জন্য খুবই প্রয়োজন ছিল, কারণ এক মাধ্যমে তারা নিজেদেরকে পার্ক-এক্সটেনশন এর বাসিন্দাদের থেকে আলাদা করতে পেরেছে। মূলত সেই চেইন এর বেড়াটা হচ্ছে, আমাদের সমাজের অর্থনৈতিক বৈষম্যের এক জ্বলজ্বলে প্রতীক।
যখন সম্পদ আর উপার্জনের এই বৈষম্য নিয়ে আমার বন্ধুদের সাথে আমার আলাপ হতো, তখন আমার প্রায়ই মনে হতো, আমি তাদের আমার সংসদীয় এলাকায় নিয়ে যাই এবং তাদের দেখাই আমার এলাকার মানুষজন কি ধরনের কঠিন সংগ্রামের সাথে নিজেদের জীবন অতিবাহিত করে। আমার কনজারভেটিভ বন্ধুরা প্রায়ই দাবী করে, এই বৈষম্য এমন কোনো বিষয় নয়, এবং এই বৈষম্যের দিকে শুধু আঙ্গুল তাক করে সমাজের তেমন কোনো মঙ্গল সম্ভব নয়। আসলে বিষয়টা এমন একটা ব্যাপার, কে কোন দৃষ্টিভংগি থেকে সমাজ ও মানুষের অগ্রগতি দেখছে।
তবে এই বৈষম্য সময়ের বিবর্তনে ক্ষয়িষ্ণু হতে পারে। আর এই বৈষম্য দূরীকরণে শত শত অদেখা আর অজানা কিছু পথ কাজ করে। তুমি যদি সেইন্ট-মিশেল বা পার্ক-এক্স এর মত সমাজে এই বৈষম্য ভালোভাবে না দেখো, তা হলে খুব সহজেই বলতে পারো, এই সব সমাজ ব্যবস্থায় বৈষম্য বলে তেমন কিছু নেই। আমরা যেমন বহুসংস্কৃতি বিষয়ে আমাদের চোখ প্রতিনিয়ত খোলা রেখেছি, তেমনি এই বৈষম্য আর সার্বিকভাবে সবার উন্নতি কিভাবে হতে পারে, সে ব্যাপারেও আমাদের চোখ সব সময় খোলা রাখা প্রয়োজন। আমরা যদি এই অসাম্যের দিকে সত্যি সত্যিই ভালোভাবে চোখ দিই তাহলে আমরা সত্যি সত্যিই বুঝতে পারবো, এই বিষয়টাকে জিইয়ে রেখে বা এর অবসান না ঘটিয়ে কখনোই আমরা সমৃদ্ধশালী একটি দেশ গড়তে পারবো না। পাপিনিউ’র রাস্তা থেকে আমি প্রায় প্রতিদিনই যে শিক্ষাটা অর্জন করি, তা হচ্ছে, কানাডার সব মানুষের যদি সত্যি সত্যিই উন্নতি চাই তাহলে আমাদের শুধু ‘অনেক’ নয়, বরং বলা যেতে পারে আমাদের ‘অনেক অনেক অনেক … ’ কাজ করতে হবে।
২০০৭ সালের শেষ থেকে ২০০৮ এর মধ্য পর্যন্ত আমি খুবই পরিশ্রম ও নিবেদিতভাবে পাপিনিউ’তে আমার নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়ে গেছি। আমার এই কাজের সময় আমাকে লিবারেল পার্টি থেকে অনেক মানসিক চাপ সহ্য করতে হয়েছে। আমি স্বীকার করছি, স্টিফেন ডিওন একজন নিবেদিত, বুদ্ধিমান আর গ্রহণযোগ্য নেতা, কিন্তু যখন তিনি নেতৃত্বে আসলেন তখন তিনি এমন সব ব্যক্তিদের দ্বারা আবর্তিত হলেন যারা অন্যান্য নেতাদের প্রতি অনুগত ছিল, এমনকি তারা বিভিন্ন ধরনের প্রছন্ন কোন্দলের সাথে জড়িত ছিল। একজন নির্মম নেতা সাধারণত যেটা করে, সে ক্ষমতায় আসলে প্রথমেই আগের সবাইকে তার অফিস বা কাজকর্মের জায়গা থেকে বিদায় করে দেয় এবং সে সব জায়গায় একেবারে নিজের লোককে এনে বসায়। এই সবকিছুই সে করে নিজের আসন পাকাপোক্ত করার জন্য। কিন্তু ডিওন এমন কিছু করেননি, ডিওন এর কাজের ধরণও এমনটি ছিল না। আমি জানি না, তাঁর এই কাজের ধরণ তাঁকে শেষ পর্যন্ত রক্ষা করেছিল কি না।
২০০০ সালে জ্য ক্রেতিয়েন তাঁর সরকারে সংখ্যাগরিষ্ঠতা যাচাইয়ের তিনটির মধ্য শেষটিতে জয়লাভ করেন। পল মার্টিনের নেতৃত্বে ২০০৪ সালের নির্বাচনে লিবারেল পার্টি সংখ্যালঘু দলে পরিণত হয় এবং ২০০৬ সালে লিবারেল পার্টি ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়ে। ১৯৯৩ সালের কিম ক্যাম্পবেল এর সেই সরকারের পর থেকে ২০০৬ পর্যন্ত লিবারেল পার্টি একটানা ক্ষমতায় ছিল। সেই সময় লিবারেল পার্টির জন্য ছিল চরম দুঃসময়, কঠিন এক সময় পার করতে হচ্ছিল আমাদের, কিন্তু তারপরও লিবারেল পার্টির অনেক নেতায় ২০০৬ এর নির্বাচনে পরাজয়কে কোনো আমলে নিতে চায়নি, বরং তারা বরাবরের মতই মনে করছিল, দেশের মানুষের মধ্যে লিবারেল পার্টির জনপ্রিয়তা একটুও কমেনি, এই পরাজয়টা একটা দূর্ঘটনা মাত্র, আগামীতে লিবারেল পার্টি আবার ক্ষমতায় ফিরে আসবে। তারা কখনোই নিজেদের কাজকর্ম আর পদক্ষেপের কোনো ধরনের আত্মসমালোচনা বা নিরীক্ষা করেনি। রবং তারা বরাবরই এমন সব গালভরা বুলি আওড়িয়ে গেছে। আমার নিজের প্রদেশে আমি লক্ষ্য করেছি, স্পন্সরশীপ বিতর্ক লিবারেল পার্টি থেকে অনেক ভোটারদের দূরে সরিয়ে দিয়েছিল। তাছাড়া জ্য ক্রেতিয়েন ও পল মার্টিনের মধ্যে দীর্ঘদিনের কোন্দল দলের ভিতরের শক্তিকে অনেকটা দূর্বল করে দিয়েছিল, সেই সাথে তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের প্রতি পার্টির উদাসীনতা ও যুবক ও বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ভোটারদের প্রতি এক ধরনের অবজ্ঞা লিবারেল পার্টিকে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে প্রতিনিয়ত দূরে সরিয়ে ফেলছিল। এর সাথে যোগ হতে পারে, লিবারেল পার্টির নেতাদের অহমিকা ও নিজেদেরকে কানাডার রাজনীতিতে এক ধরনের অপরিহার্য হিসেবে মনে করা। তখন শুধু আমার কাছেই নয়, কানাডার অনেকের কাছেই মনে হয়েছিল, লিবারেল পার্টি দীর্ঘদিনের পরিশ্রমে নিরন্তর ইতিবাচক সব কাজ করে যেভাবে মানুষের বিশ্বাস অর্জন করেছিল সেটা তারা ভুলতে বসেছিল।
২০০৮ এর ৭ই সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হার্পার গভর্ণর জেনারেল এর সরকারী বাসভবনে গিয়ে মিশায়েল জিন’কে নতুন সাধারণ নির্বাচন দেওয়ার অনুরোধ করেন। ঐ দিনটির পর আমাকে আমার জীবনের সবচেয়ে ব্যস্ততম সাইত্রিশটি দিন কাটাতে হয়েছে। আমাকে তখন বলা হয়েছিল, ‘তোমার স্ত্রীকে বিদায় চুম্বন দিয়ে তার কাছ থেকে বিদায় নাও, আগামী পাঁচ সপ্তাহে তার সাথে তোমার আর দেখা নাও হতে পারে।’
তখন আমার দিন শুরু হতো সকাল সাতটায়। আমি আমার রাইডিং এর নয়টায় মেট্রো স্টেশনের যে কোনো একটাতে গিয়ে লিফলেট নিয়ে হাজির হতাম। সেই সকালে কিছুটা ঘুম চোখে কাজের দিকে ছুটে চলা সাবওয়ের যাত্রীদের দিকে আমার সেই নির্বাচনী প্রচারণার লিফলেট হাসিমুখে এগিয়ে দিতাম আর আগামী নির্বাচনে আমার বিষয়টা মাথায় রাখার জন্য অনুরোধ করতাম। সেই সকালের ব্যস্ত সময়টা পার হলে আমি রাস্তা ধরে হাঁটা শুরু করতাম এবং যে কোনো দোকান বা রেস্টুরেন্ট এ গিয়ে হাজির হতাম। ওই সকালে গিয়ে দেখতাম অধিকাংশ দোকান কেবল মাত্র খুলেছে এবং মালিক ছাড়া আর অন্য কেউ নেই। কিন্তু সেটা আমার জন্য কোনো ব্যাপার ছিল না। আমি সাধারণ ক্রেতাদের জন্য অপেক্ষা না করে, সেই সব দোকানের মালিক বা ক্যাশিয়ারদের সাথে নির্বাচন নিয়ে আলাপ করতাম, সেই সাথে আমাকে ভোট দেবার জন্য অনুরোধ করতাম। তাদেরকে আমার নির্বাচনী প্রতীক দেবার সময় আমি এটাও অনুরোধ করতাম, তারা যেনো তাদের খরিদ্দারদেরকে আমার ব্যাপারে বলে। তখন আমি এটাও জানতাম, তারা ইচ্ছে করলে খুব সহজেই আমাকে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছিয়ে দিতে পারে। (চলবে)