হাসান জাহিদ : কথাশিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিত্সু ক্যানভাস।

আলি বিষয়ক কথকতা

শৈশব থেকেই মোহাম্মদ আলি আমাকে বিমোহিত করে রাখেন। আমার বাবা সাংবাদিক হবার সুবাদে আমাদের বাসায় অনেক পত্রিকা আসত। তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। আলি ও অন্যান্য বক্সারদের ছবি পত্রিকা থেকে কেটে একটা বাঁধাই খাতায় সেঁটে আলি সম্পর্কে হাতে লিখে বেশ একটা বইয়ের মতো বানিয়ে ফেললাম। সেইসময় একইসঙ্গে আমার মনে দোলা দিয়ে যাচ্ছিল একটি মেয়ে, যার নাম নাদিয়া কোমানেসি। অলিম্পিকে একের পর এক মেডেল পেয়ে রোমানিয়ার এই জিমনাস্ট সারা বিশ^কে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন।

আমার আরও দুজন স্বপ্নের নায়ক ছিলেন। সেইসময়টা পর্যন্ত এই দুজন সম্পর্কে জানার আমার খুব একটা সুযোগ হয়নি। পরে জেনেছিলাম, এবং তাদের ছবি দেখতে হলে ছুটে যেতাম। তাদের একজন ব্রæস লী এবং অন্যজন ক্লিন্ট ইস্টউড। এই দুই মহানায়ক সম্পর্কে আমি ইতোমধ্যেই আমার বালুকা বেলা কলামে লিখেছি।

এই পর্বে আলি আখ্যানভাগে তার সম্পর্কে আমার অনুভূতি, আমার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা সম্পর্কে কিছু কথা বলেছি।

মোহাম্মদ আলির জন্ম (ক্যাসিয়াস মার্সেলাস ক্লে জুনিয়র Cassius Marcellus Clay, Jr.) ১৭ জানুয়ারি ১৯৪২ সালে কেন্টাকির লুইভিলে। ক্রীড়া জীবনের শুরু থেকেই আলি রিংয়ের ভেতরে ও বাইরে একজন অনুপ্রেরণাদায়ক, মানবতাবাদী ও আকর্ষণীয় বাগ্মী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। স্পোর্টস ইলাস্ট্রেটেড শতাব্দীর সেরা ক্রীড়াবিদ ও বিবিসি এই শতকের শ্রেষ্ঠ ক্রীড়াব্যক্তিত্ব হিসেবে সম্মানিত করেছে তাকে।

ক্লে বারো বছর বয়সে বক্সিংয়ে প্রশিক্ষণ শুরু করেন। ১৯৬৪ সালে মাত্র বাইশ বছর বয়সে তিনি সনি লিস্টনকে পরাজিত করে বিশ্ব হেভিওয়েট খেতাব লাভ করেন। ফেব্রæয়ারি ২৫ থেকে সেপ্টেম্বর ১৯ পর্যন্ত তিনি আনডিসপিউটেড হেভিওয়েট বক্সিং চ্যাম্পিয়ন হিসেবে সম্মান পান। এর কয়েকদিন পরে তিনি নেশন অব ইসলামে যোগদান করে নিজের নাম পরিবর্তন করে মোহাম্মদ আলি রাখেন। ১৯৭৫ সালে তিনি সুন্নি ইসলামে ধর্মান্তরিত হন।
১৯৬৭ সালে আলি ভিয়েতনাম যুদ্ধে অ্যামেরিকার অংশগ্রহণের বিরোধিতা করেন এবং নিজে যুদ্ধে যোগদানে অস্বীকৃতি জানান। ফলশ্রুতিতে আলিকে দোষী সাব্যস্ত করে তার বক্সিং খেতাব কেড়ে নেয়া হয়। তিনি তার জীবনের মূল্যবান চারটি বছর হারিয়ে ফেলেন তত্কালিন প্রশাসনের হঠকারিতার ফলে। নিষেধাজ্ঞা আরোপে কারণে চারবছর কোনো ধরনের মুষ্টিযুদ্ধ প্রতিযোগিতায় নামতে পারেননি আিল। ১৯৭১ সালে তার আপিলের প্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্ট আলির বিরুদ্ধে অভিযোগ খারিজ করে দেয়। যুদ্ধ, অন্যায় ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আলির সুদৃঢ় অবস্থান এবং তার অতি মানবীয় গুণাবলি ও বর্ণবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান আলিকে সেই প্রজন্মের কাছে শ্রদ্ধার পাত্র ও বরণীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত করে। বক্সিং জগতে ফিরে এসে আলি ১৯৭৪ সালে জর্জ ফোরম্যানকে ও ১৯৭৮ সালে লিওন স্পিংক্সকে হারিয়ে রেকর্ড তিনবারের চ্যাম্পিয়ন হন।

আলি পেশাদার কুস্তিগীর জর্জ ওয়েগনারের আদর্শে অনুপ্রাণিত হন। তিনি বক্সিংয়ের বাইরে মানবতাবাদীর প্রচারণা চালান ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অবস্থান নিয়ে সাংবাদিক সম্মেলন ও সাক্ষাত্কারে স্পষ্ট মতামত জানাতে দ্বিধা করতেন না। আলি শ্বেতাঙ্গ অ্যামেরিকানদের বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকে আফ্রিকান-অ্যামেরিকান ক্রীড়াজগতের অবস্থান পরিবর্তন করতে সক্ষম হন।

প্রথম জীবন: আলির পিতা ক্লে সিনিয়র সাইনবোর্ড এবং বিলবোর্ড রং করতেন এবং মা ওডিসা গ্র্যাডি ক্লে একজন গৃহিণী ছিলেন। যদিও ক্লে সিনিয়র একজন মেথডিস্ট ছিলেন কিন্তু তার সন্তানদের ব্যাপ্টিস্টে নিতে স্ত্রীকে অনুমতি দিতেন। ক্লে’র নামকরণ পিতা ক্যাসিয়াস মার্সেলাস ক্লে সিনিয়রের নামে করা হয়, যা উনবিংশ শতাব্দীর একজন মার্কিন রাজনীতিবিদের সম্মানে রাখা হয়েছিল। ক্লে’র পিতামহ ও পিতামহীর নাম ছিল জন ক্লে ও সালি অ্যানা ক্লে। ক্লে’র বোন ইভার বক্তব্য অনুযায়ী সালি মাদাগাস্কারের অধিবাসী ছিলেন। সিনিয়র ক্লে প্রাক-গৃহযুদ্ধের দক্ষিণাংশের আফ্রিকান-অ্যামেরিকান ক্রীতদাসের বংশধর ছিলেন।

লুইভিলের পুলিস অফিসার এবং বক্সিং প্রশিক্ষক জো মার্টিন আলিকে প্রথম বক্সিং শিখতে বলেন। পরবর্তী চারবছর বক্সার কাটম্যান চাক বোডাক আলিকে প্রশিক্ষণ দেন।
ক্লে ১৯৫৪ সালে প্রথম অপেশাদার বক্সিং প্রতিযোগিতায় নামেন। তিনি ছয়বার কেন্টাকি গোল্ডেন গ্লাভস উপাধি, দুইবার জাতীয় গোল্ডেন গ্লাভস উপাধি, একবার অ্যামেচার অ্যাথলেটিক ইউনিয়ন জাতীয় উপাধি এবং রোমে অনুষ্ঠিত ১৯৬০ গ্রীষ্মকালিন অলিম্পিক বক্সিং প্রতিযোগিতায় লাইট হেভিওয়েট বিভাগে স্বর্ণপদক লাভ করেন। অপেশাদার বক্সিং প্রতিযোগিতায় তিনি একশ’ বার জয়লাভ করেন ও মাত্র পাঁচবার পরাজিত হন।

পেশাদার বক্সিং, তথা প্রথমদিকের লড়াই: আলি ১৯৬০ সালের ২৯ অক্টোবর পেশাদার বক্সিং প্রতিযোগিতায় প্রথমবারের জন্য অংশ নেন এবং টানি হানসাকারকে ষষ্ঠ রাউন্ডে পরাজিত করেন। বাসন মাজা ও ঝাঁট দেয়ার মতো অবমাননাকর কাজ করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে ১৯৬০ সালে তিনি প্রশিক্ষক আর্চি মুরকে ত্যাগ করেন। এরপর তিনি অ্যাঞ্জেলো ডান্ডিকে প্রশিক্ষক হিসেবে বেছে নেন। এইসময় তিনি সুগার রে রবিনসনকে ম্যানেজার হিসেবে চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হন। এরপর থেকে ১৯৬৩ সালের শেষার্ধ পর্যন্ত আলি ১৯-০ জয়ের রেকর্ড করেন যার মধ্যে ১৫টি জয় নকআউটের মাধ্যমে আসে। এই সময়টায় তিনি টনি এস্পার্তি, জিম রবিনসন, ডনি ফ্লীম্যান, আলোঞ্জো জনসন, জর্জ লোগান, উইলি বেসমানফ, ল্যামার ক্লার্ক, ডাউগ জোন্স, হেনরি কুপার প্রমুখ মুষ্টিযোদ্ধাদের পরাজিত করেন। ১৯৬২ সালে আলি আর্চি মুরকেও পরাজিত করেন। প্রথম দিককার এই লড়াইগুলিতে আলিকে বেশ ক’বার কঠিন পরীক্ষায় সম্মুখীন হতে হয়েছে। হেনরি কুপারের সঙ্গে লড়াইয়ে আলি চতুর্থ রাউন্ডে কুপারের হুকে মাটিতে পড়ে গেলেও ‘Saved by the bell’ এর বদৌলতে রক্ষা পান।

ক্যাসিয়াস ক্লে হলেন মোহাম্মদ আলি: শিরোপা জয় করার পর তিনি খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে যান। এই সময় আলি ঘোষণা দেন তিনি নেশন অব ইসলাম (Nation of Islam) গোত্রের সদস্য। তার নাম রাখা হয় ক্যাসিয়াস এক্স, কারণ তিনি মনে করতেন তাঁর ‘ক্লে’ পদবী দাসত্বের পরিচায়ক। এর কিছুদিন পর গোত্র প্রধান সাংবাদিকদের কাছে তাকে মোহাম্মদ আলি নামে পরিচয় করিয়ে দেন। কথিত আছে, তিনি সুন্নি সুফি শায়খ হিশাম কাব্বানীর মুরিদ হন।

ভিয়েতনাম যুদ্ধে যেতে অস্বীকৃতি: ১৯৬৪ সালে আলি সৈনিক জীবনে প্রবেশ করতে ব্যর্র্থ হন পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হওয়ার কারণে। ১৯৬৬ সালে তিনি উত্তীর্ণ হন তবে তিনি ভিয়েতনাম যুদ্ধে যোগ দেয়ার জন্য কর্তৃপক্ষের আদেশ প্রত্যাখ্যান করেন। আলি জানান, কোনো ভিয়েতকংয়ের সাথে তার বিরোধ নেই, তারা কেউ তাকে কালো বলে অবজ্ঞা করেনি। তিনি ক্যাসিয়াস ক্লে নামে আর পরিচিত হতে চাননি, এ কারণে তিনি ১৯৬৬ সালে অ্যামেরিকায় লড়াইয়ে অংশ নিতে পারেননি।

১৯৬৫ সালে লিস্টন এর সাথে ফিরতি ম্যাচের পর ১৯৬৭ সালে জোরা ফলির সাথে ম্যাচের মধ্যে তিনি নয়বার শিরোপা রক্ষার লড়াইয়ে নামেন। খুব কম বক্সারই এত কম সময়ে এত বেশি বার লড়াই করেন। আলি ১৯৬৬ সালে ক্লিভল্যান্ড উইলিয়ামস-এর সাথে লড়াই করেন, এবং অনেকটা নৃশংসভাবেই ক্লিভল্যান্ডকে তিন রাউন্ডের মাথায় নকআউটে পরাজিত করেন। ১৯৬৭ সালে তিনি হিউস্টনের একটি রিং-এ আর্নি টেরেল-এর বিরুদ্ধে মুষ্টিযুদ্ধে অবতীর্ণ হন। ম্যাচ-এর আগে টেরেল আলিকে ক্লে বলে অপমান করেন। আলি টেরেলকে আঘাত করতে করতে প্রশ্ন করতে থাকেন ‘হোয়াট ইজ মাই নেম?’ ১৫ রাউন্ডের বাউটে তিনি টেরেলকে রক্তাক্ত করেন। অনেকে মনে করেন যে আলি ইচ্ছাকৃতভাবে ১৫ রাউন্ড পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যান টেরেলকে শায়েস্তা করার উদ্দেশ্যে। সেই বছরই তিনি রিং-এ তিনবছরের জন্য নিষিদ্ধ হন ভিয়েতনাম যুদ্ধে না যাওয়ার কারণে। ১৯৭০ সালে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তিনি লড়াইয়ে ফিরে আসেন।

শতাব্দীর সেরা লড়াই: মার্চ ১৯৭১ সালে আলি জো ফ্রেজিয়ারের মুখোমুখি হন যা ‘শতাব্দীর সেরা লড়াই’ হিসেবে পরিচিত। বহুল-আলোচিত এ লড়াইটি ছিল দুই মহাবীরের শিহরন জাগানো লড়াই। এই মহাযুদ্ধে জো ফ্রেজিয়ার জয়লাভ করেন ও আলি প্রথমবারে মতো পরাজিত হন। ১৯৭৪ সালে ফিরতি লড়াইয়ে তিনি আরেক মহাশক্তিশালী যোদ্ধা জর্জ ফোরম্যানকে নকআউট করে শিরোপা পুনরুদ্ধার করেন।

রাম্বল ইন দ্যা জাঙ্গল (Rumble in the Jungle)-জঙ্গলে গর্জন: আলি ১৯৭৪ সালের অক্টোবরে জর্জ ফোরম্যান-এর সাথে লড়াইয়ে নামেন যা ইতিহাসে রাম্বল ইন দ্যা জাঙ্গল নামে পরিচিত। আফ্রিকার একটি দেশ জাইয়ের-এর রাজধানি কিন্সাসায় লড়াইটি অনুষ্ঠিত হয়। দুই পরাক্রমশালী যোদ্ধার হুঙ্কার, তাদের প্রাক-যুদ্ধ প্রস্তুতি ও পরিস্থিতি বুঝাতে এবং বৃহত্তর আফ্রিকা, তথা জাইয়ের-এর জঙ্গুলে আবহের গর্জনকারী জন্তুর আবহের সাথে মিলিয়ে এই গর্জনপূর্ণ যুদ্ধটির এরকম নামকরণ করা হয়। ফোরম্যান দেহে-ওজনে-লম্বায় আলির চাইতে বেশি এবং ওয়ান অব দ্যা হার্ডেস্ট পাঞ্চারস অব দ্যা ওয়ার্ল্ড বলে তার পরিচিত, এবং সর্বোপরি পরিসংখ্যানের দিক দিয়েও আলির চাইতে এগিয়ে ছিলেন ফোরম্যান। ইতোপূর্বে তিনি জো ফ্রেজিয়ার (দ্বিতীয় লড়াই) ও কেন নর্টনকে হারিয়ে দেন। ফোরম্যান ৪০টির মধ্যে ৩৭টি লড়াই নকআউটে জিতেন ৩ রাউন্ডের মধ্যেই। আলির ঘোর সমর্থকরাও ফোরম্যানের সাথে যুদ্ধে আলির জয়ের সম্ভাবনা দেখেননি। তবে আলির ছিল দৃঢ় মনোবল। অন্যদিকে, দানবীয় ফোরম্যানের বিরুদ্ধে আলির ক্ষিপ্রতা, কৌশল ও সুযোগের সদ্ব্যবহার বড় পুঁজি ছিল। সংশ্লিষ্ট সবার এবং বিশ্লেষকদের ধারণা ছিল আলি হয়তো পুরো যুদ্ধে তার ক্ষিপ্রতাকে কাজে লাগাবেন। কিন্তু তিনি দূরে দূরে থাকতে লাগলেন। মজার বিষয়, ঠিক প্রয়োজনের সময়টিতেই তিনি ক্ষিপ্রতা প্রয়োগ করেন। ফোরম্যানকে তিনি আক্রমণ করতে প্রলুদ্ধ করলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল প্রতিপক্ষকে ক্লান্ত করে দেয়া। অষ্টম রাউন্ডে তিনি সুযোগ পেয়ে গেলেন এবং ফোরম্যানকে নকআউট করলেন। এই যুদ্ধে আলি তার অন্যতম প্রিয় কৌশল ‘রৌপ আ ডোউপ’ কাজে লাগান যদিও অ্যাঞ্জেলো ড্যান্ডি ও অন্যান্যরা আলিকে বারবার বলছিলেন, এই কায়দা পরিত্যাগ করতে; কেননা ফোরম্যানের মতো দানবকে কুপোকাত করতে Rope-a-dope উল্টো ফলাফল বয়ে আনার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু আলি এমন এক দার্শনিক যোদ্ধা, যিনি সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্তটি নিতে পারতেন।

আলি তখন শিরোপাবিহীন। শিরোপা বিজয়ের লড়াইয়ে তিনি বিশ^ চ্যাম্পিয়ন জো ফ্রেজিয়ারের সাথে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন ১৯৭১ সালে। তখনও পর্যন্ত ফ্রেজিয়ারের লেফট হুক বিশে^র যে কোনো বক্সারদের কাছে দুঃস্বপ্ন ছিল। আর এই লেফট হুকেই আলি তার চোয়ালে আঘাত পেয়ে ধরাশায়ী হন। যাকে বলা হয় নক ডাউন। অনেকের ধারণা ছিল আলি এক পর্যায়ে নক্ড আউট হয়ে যাবেন কিন্তু আলি উঠে পড়েন এবং পুরো রাউন্ড লড়াই চালিয়ে যান। যদিও তার হার হয় এই লড়াইয়ে।

পরবর্তীতে বিশ^বাসী দেখল অন্য এক চিত্র। ১৯৭৩ সালে পাঁচ ফিট এগারো ইঞ্চি উচ্চতার স্মোকিন’ জো ফ্রেজিয়ার ছয় ফিট চার ইঞ্চি উচ্চতার বিগ জর্জ ফোরম্যানের সাথে লড়াইয়ে নেমে ছয়বার নকডাউন হন। বক্সিংয়ের ভাষায় ফোরম্যান ব্রæটালাইজড করেন স্মোকিন জো ফ্রেজিয়ারকে।
সেই বিগ জর্জ ফোরম্যান ১৯৭৪ সালে আলির কাছে পরাজিত হন অষ্টম রাউন্ডে নক্ড আউট হয়ে।

ইসলামের ছায়াতলে আলি: ১৯৭৫ সালে আলি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তার মতে, এ জন্য ভূমিকা রাখেন নেশন অব ইসলাম এর প্রধান ডবিøউ ডি. মুহাম্মদ।

১৯৭৫ সালে আলি লড়াই করেন জো ফ্রেজিয়ারের সাথে, যা ইতিহাসে ‘থ্রিলা ইন ম্যানিলা’ নামে খ্যাত। এই লড়াইয়ের আগে অনেকবারই আলি-ফ্রেজিয়ার বাকযুদ্ধে লিপ্ত হন, এমনকি প্রাকযুদ্ধ সংবাদ সম্মেলন বা বিভিন্ন উপলক্ষে পরস্পর মুখোমুখি হয়ে দুই যোদ্ধা হাতাহাতিতেও লিপ্ত হয়েছিলেন। বাকযুদ্ধে ফ্রেজিয়ারকে মানসিকভাবে দুর্বল করতে আলিই বেশি আক্রমণাত্মক ছিলেন। কেননা ১৯৭১এর লড়াইয়ে এক পর্যায়ে ফ্রেজিয়ারের লেফট হুকে চোয়ালে আঘাত পেয়ে তিনি পড়ে গিয়েছিলেন। সেই স্মৃতি এবং জর্জ ফোরম্যানের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক জয়লাভে আলি ছিলেন তুঙ্গে। ফ্রেজিয়ারের লেফট হুক যেকোনো বক্সারের জন্য দুঃস্বপ্নের মতো। বাম হাতে তিনি দানবীয় শক্তি ধরতেন।

সেই সময়ের স্মৃতি ইতোমধ্যেই বিবৃত করেছি। তখন তালিবাবাদ ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্রের মাধ্যমে আলি-ফ্রেজিয়ার লড়াইটি প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারিত হয়েছিল। তখন আমরা থাকতাম মগবাজার নয়াটোলায়, আর লড়াইটা দেখেছিলাম এক প্রতিবেশীর বাসায়। পরদিন একটা পত্রিকার (সম্ভবত দৈনিক বাংলা) শিরোনাম এখনও মনে আছে আমার- ‘ত্রয়োদশ রাউন্ডেই ফ্রেজিয়ার কুপোকাত।’ এই ফাইট এবং ফাইট-পরবর্তী কয়েকটি দিন আমি মেতে ছিলাম আলির জয়গানে। চতুর্দশ রাউন্ডের শেষে ফ্রেজিয়ারের কর্নার থেকে লড়াই বন্ধের ইঙ্গিত এলে রেফারি কার্লোস প্যাডিল্লা লড়াই বন্ধ করলে আলি টেকনিক্যাল নকআউটে জয়লাভ করেন। ফ্রেজিয়ারের ডান চোখ তখন সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়, আর তার মুখ দিয়ে রক্ত ঝরছিল।

ফ্রেজিয়ারের সঙ্গে লড়াই পরবর্তী সময়টা অনেকটা দুঃসময় ছিল আলির জন্য। ১৯৭৮ সালের এক লড়াইয়ে তিনি ১৯৭৬’র অলিম্পিক মেডালিস্ট লিয়ন স্পিংক্স-এর কাছে খেতাব হারান। তিনিই প্রথম যিনি একজন অপেশাদারের কাছে হেরেছিলেন। তবে লিয়ন স্পিংক্সকে আবারও হারিয়ে তিনি রেকর্ড তিনবারের চ্যাম্পিয়ন হন।

অবসর গ্রহণ: ১৯৭৯ সালে আলি অবসর গ্রহণ করলেও ১৯৮০ সালে ফিরে আসেন ল্যারি হোমস-এর কাছ থেকে শিরোপা ছিনিয়ে নিতে। ল্যারি ছিলেন তার শিষ্য, তাই এই লড়াই নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলে এবং বিশ্বজুড়ে কৌতুহলের সীমা ছিল না। এগারো রাউন্ডের পর আলি পরাজিত হন। পরে জানা যায় আলির মস্তিষ্কে মারাত্মক ত্রুটি ধরা পড়ে। এরপর থেকেই তিনি পারকিনসন্স রোগে ভুগতে থাকেন।

যেভাবে বক্সার হলেন আলি: মোহাম্মদ আলির বক্সার হয়ে ওঠার শুরুটা নাটকীয় ছিল। ১৯৫৪ সালে তার বয়স বারোবছর। লাল রঙের একটি সাইকেল ছিল তার। প্রিয় সাইকেলটি একদিন চুরি হয়ে যায়। স্থানীয় পুলিস অফিসার মার্টিনের কাছে গিয়ে অভিযোগ করেন তিনি। আলি সাইকেলটি উদ্ধার করে দেয়ার জন্য বললেন মার্টিনকে। চোরকে পেলে তিনি ঘুষি মারবেন বলে পুলিস অফিসারকে জানিয়ে রাখেন। পুলিস অফিসার বললেন, চোর মারার আগে কীভাবে ঘুষি মারতে হয় সেটা তোমাকে শিখতে হবে। বারোবছর বয়সী জেদী এই বালককে দেখে দারুন পছন্দ হয় পুলিস অফিসার মার্টিনের। তিনি স্থানীয় একজন বক্সিং কোচ ছিলেন। আলিকে স্থানীয় জিমে যাওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। সেখানে গিয়ে মার্টিনের কাছে ঘুষি মারা শিখতে থাকেন আলি। কিশোর ছেলেটির জেদ ও ঘুষির স্টাইল খুবই পছন্দ হয় মার্টিনের। সেখান থেকেই মোহাম্মদ আলি শেখেন কীভাবে ‘প্রজাপতির মতো নেচে নেচে, মৌমাছির মতো হুল ফুটাতে’ হয়। এখানে চারবছর বক্সিং শেখেন আলি।

১৯৮১ সালে বক্সিং থেকে অবসর নেন মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলি। এর কয়েক বছর পর থেকেই তার শারীরিক সমস্যা শুরু হয়। বহু বছর ধরে পারকিনসন্স রোগে ভুগছিলেন।
পেশাদার হেভিওয়েট বক্সিংয়ে তার কীর্তি তাকে পরিণত করেছিল সর্বকালের সেরা বক্সিং তারকায়। নিজের ৬১টি পেশাদার লড়াইয়ের ৫৬টিতেই জিতেছিলেন আলি। ৩৭টি লড়াইয়ে প্রতিপক্ষকে নকআউট করেছিলেন সরাসরি। তার নিজের অবশ্য একবারও নকআউটে পরাজিত হওয়ার রেকর্ড নেই। ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন। তাকে সেই সময় বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দিয়ে সম্মানিত করা হয়েছিল।
আমি তখন দশম শ্রেণিতে পড়ি। থাকি নয়াপল্টনে। চারিদিকে দেখছিলাম পোস্টার টানানো। লেখা ছিল: Muhammad Ali will be available at the Dhaka Stadium. মাথায় তখন একটাই চিন্তা- দেখতে হবে দি গ্রেটেস্টকে। অবশেষে একটা টিকেট ম্যানেজ করতে পেরেছিলাম। বর্তমান বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে গ্যালারিতে স্থান হলো আমার। আমার জীবনের একটা ল্যান্ডমার্ক ছিল সেটা। আলি সুসজ্জিত রিংয়ে লড়েছিলেন বাংলাদেশের কিশোর বক্সার গিয়াসউদ্দিনের বিরুদ্ধে। দর্শকদের মজা দিতে আলি ইচ্ছে করেই গিয়াসের ঘুষি খাচ্ছিলেন। মাঝেমধ্যে পড়ে যাচ্ছিলেন। আবার ‘কষ্টেসৃষ্টে’ উঠছিলেন। একবার তিনি পড়ে গেলেন। রেফারি কাউন্ট করছিলেন। দশ গোনার আগেই আলি কয়েকবার উঠেছিলেন। এবার আর উঠলেন না। রেফারি আলিকে নক আউটে পরাজিত ঘোষণা করল। ছেলেটাকে উত্সাহ দিতে, দর্শকদের আনন্দ দিতে আর মানুষের ভালোবাসা জয় করতে আলির জুড়ি ছিল না।

বক্সিংয়ের রিংয়ে তার মতো কেউ আজও আসেননি। কোনোদিন আসবেনও না। গত শতাব্দীর সেরা ক্রীড়াবিদ ছিলেন তিনি। বেশিরভাগ ভক্ত ও বোদ্ধাদের কাছে তিনিই সর্বকালের সেরা। শুধু ক্রীড়াবিদ কেন? মানুষ মোহাম্মদ আলি কি তার চেয়েও বড় ছিলেন না? কালো মানুষদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে তিনি নিরন্তর সংগ্রাম করেছেন।

বক্সিং রিংয়ে অপরাজিত মোহাম্মদ আলি হেরে গেলেন জীবনযুদ্ধে। বিংশ শতাব্দীর সেরা ক্রীড়াবিদ আলি শুধু রিংয়ের শ্রেষ্ঠত্বের জন্য নয়, তিনি চিরস্মরণীয় ও সম্মানীয় তার চারিত্রিক দৃঢ়তা আর মানবতাবাদী মনোভাবের জন্য। মেধা, শৈলী, চাতুর্য, সাহস, দুরন্ত গতি তাকে প্রতিষ্ঠিত করে অনন্য এক ক্রীড়াবিদ হিসেবে। মার্টিন লুথার কিং কৃষ্ণাঙ্গদের নেতা হিসেবে নোবেল পুরস্কার পেলেও তার বেশ আগে থেকেই বিশ্বের সব কালো যুবকদের আদর্শ পুরুষে পরিণত হন মোহাম্মদ আলি। কালোদের প্রতি মার্কিন শ্বেতাঙ্গদের অবহেলাই আলিকে আরও দৃঢ়চেতা করে তোলে। ছন্দে আর নৃত্যে তিনি প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে তিনি মুষ্টিযুদ্ধকে বিশেষ শিল্পে পরিণত করেছিলেন। আলি যখন দুলেদুলে প্রতিপক্ষকে আঘাত করতেন তখন তিনি প্রজাপতির মতো উড়তেন বলে মনে হতো। বক্সিংয়ে আলি ছিলেন অতুলনীয়। শরীরে কোনো বাড়তি মেদ ছিল না। হালকা-পাতলা গড়ন ছিল। কিন্তু মুষ্টিতে ছিল অসীম শক্তি। আর মনের জোরটা ছিল তার আরও অনেকগুণ বেশি। তিনি যেমন ছিলেন বিদ্রোহী, তেমন ছিলেন জনদরদী, মানবহিতৈষী। আলির মধ্যে দার্শনিক মনোভাব যেমন ছিল তেমন রসবোধও ছিল প্রবল।

যেমন সনি লিস্টন তার কাছে ছিল স্ক্যারিয়েস্ট, জো ফ্রেজিয়ার ছিল তার কাছে টাফেস্ট ফাইটার। আর এসব নিয়ে আলি মজা করতে ছাড়তেন না।
ইতিহাসখ্যাত থ্রিলা ইন ম্যানিলা যুদ্ধে আলি-ফ্রেজিয়ার লড়াইয়ে মোহাম্মদ আলী কবিতা লিখেছিলেন:
It will be a killa
And a chilla
And a thrilla
When I get the gorilla
In Manila!
—Muhammad Ali
জো ফ্রেজিয়ারকে নিয়ে তিনি সবসময় মজা করতেন। কবিতা লিখতেন। দেখা গেছে যে, যেসব বক্সারদের কাছে তিনি প্রবল প্রতিকূলতার সম্মুখিন হয়েছিলেন, তাদেরকে নিয়ে তার রসে ভরপুর কবিতাগুলো তিনি লিখতেন বেশি।
Smokin’ Joe
Joe’s gonna come out smokin’,
But I ain’t gonna be jokin’.
I’ll be peckin’ and a-pokin’,
Pourin’ water on his smokin’.
Now, this may shock and amaze ya,
But I will destroy Joe Frazier!
Some people say he’s awful strong.
Tell him to try Ban Roll-On.
—Muhammad Ali
৩ জুন ২০১৬ চিরবিদায় নিলেন আলি। ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম এভাবে:
He won’t sting any more like a bee and float like a butterfly. Adieu, the World’s Champion, and the ambassador of humanity. Salam, Muhammad Ali, rest in peace.

কোটি কোটি ভক্তকে কাঁদিয়ে চলে গেলেন তিনি পরপারে। যুক্তরাষ্ট্রের আরিজোনা অঙ্গরাজ্যের ফিনিক্স এলাকার হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই কিংবদন্তি। বেশ কিছুদিন ধরে এখানেই তার শেষ চিকিত্সা চলছিল। সর্বশেষ তার শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। মৃত্যুর সময় তার স্ত্রী লোনি ও মেয়েরা আলির পাশে ছিলেন। মৃত্যুকালে আলির বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর। বিশ্বের অনেক শক্তিশালী বক্সারকে কাবু করা মোহাম্মদ আলি ১৯৮৪ সাল থেকে লড়ছিলেন দুরারোগ্য ব্যাধি পারকিনসন্স-এর বিরুদ্ধে।
সেপটিক শকে মারা গেছেন আলি: ৫ জুন ২০১৬, বিবিসি বাংলা অনলাইনে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, সেপটিক শকজনিত কারণে আলি মারা গেছেন।

কিংবদন্তি মুষ্টিযোদ্ধা আলির পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, তার মৃত্যু সেপটিক শক বা এমন একটি কারণে হয়েছে যার ফলে শরীরের রক্তের চাপ বিপজ্জনক মাত্রায় নেমে আসে।
১৯৭৮ সালে বাংলাদেশে আলির সংক্ষিপ্ত সফরে তার প্রতি বাংলাদেশের মানুষের আতিথেয়তা দেখে তিনি মুগ্ধ হয়ে বলেছিলেন:
“If you want to go to heaven, come to Bangladesh.”
তার সফরের সময় তাকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেয়া হলে তিনি একথাও বলেছিলেন অবলীলাক্রমে “If I get kicked out of America, I have another home.”
পরপারে প্রিয় আলি ভালো থাকুন- এই প্রার্থনা করি।