জনি হক : কোভিড-১৯ মহামারির কারণে বিশ্বের বহু বাণিজ্যিক বিমান সংস্থার কার্যক্রম থেমে গেছে। এ কারণে এভিয়েশন শিল্পের সঙ্গে যুক্ত অনেকেই বিকল্প আয়ের পথ খুঁজে নিচ্ছেন। পাইলটরাও এর ব্যতিক্রম নন।
থাইল্যান্ডে লকডাউন শিথিলের পর এ মাসে অভ্যন্তরীণ পর্যটন শুরু হয়েছে সবে। এর মধ্যে দেশটির কয়েকজন বিমানচালক আকাশ থেকে নেমে গেছেন রাস্তায়! মোটরসাইকেল চালিয়ে খাবার ডেলিভারি দেওয়া কিংবা রাইড শেয়ারিং অ্যাপের মাধ্যমে গাড়িচালক হিসেবে কাজ করছেন তারা।
ফার্স্ট অফিসার (সহ-পাইলট) নাকারিন ইন্তা তাদেরই একজন। চার বছর ধরে বাণিজ্যিক বিমানে কাজ করেছেন তিনি। এখন থাইল্যান্ডের মেসেঞ্জার অ্যাপ ‘লাইন ম্যান’-এর হয়ে খাবার ডেলিভারি দিচ্ছেন। তার কথায়, ‘কিছু এয়ারলাইনের কর্মীকে বিনা বেতনে ছুটিতে যেতে হয়েছে। আমাদের বেশিরভাগের উপার্জন ৭০ ভাগ কাটা গেছে। কিন্তু আমার প্রতি মাসে নির্ধারিত ব্যয় আছে, তাই আমাকে নিজে থেকে একটা কাজ খুঁজে নিতে হয়েছে।’
গত মার্চে থাই সরকার অবরুদ্ধ অবস্থা (লকডাউন) ঘোষণার পর রাজধানী ব্যাংককে খাবার ডেলিভারি সেবার অ্যাপগুলোর জনপ্রিয়তা বেড়েছে। বিশ্বব্যাপী অন্যান্য অনেক শহরে একই চিত্র।
এমন পরিস্থিতিতে ইন্তা উপলব্ধি করেন, নিজের মোটরসাইকেলে খাবার ডেলিভারি দিয়ে যে রোজগার হবে তা কিছুটা হলেও স্ত্রী ও চার বছরের কন্যার কাজে আসবে। তিনি বলেন, ‘মনে হলো, সাহায্যের জন্য অপেক্ষা করে হাত-পা গুঁটিয়ে বসে থাকলে চলবে না। পরিবারের জন্য আমাকে চেষ্টা চালিয়ে কিছু একটা করতে হবে। আমার দুটি হাত আছে, মোটরসাইকেলও আছে। তাই পার্ট-টাইম কাজ খুঁজে নিয়েছি। এখন আমি ফুড ডেলিভারি ম্যান।’
৪২ বছর বয়সী এই মানুষটি সবসময় ককপিটে জীবন কাটানোর স্বপ্ন দেখেছেন। কিন্তু এভিয়েশনে অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার আশঙ্কা থেকে বছরের পর বছর ধরে দেখা সেই স্বপ্ন থেকে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছেন তিনি। প্রায় পাঁচ বছর আগে অবশ্য এই খাতে যোগ দেওয়ার সময় ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি ভবিষ্যৎ এমন হবে।
পাইলট হিসেবে মাসে ৬ হাজার থেকে ৮ হাজার ডলার আয় করতেন নাকারিন ইন্তাথাইল্যান্ডে বাজেট এয়ারলাইনসের সংখ্যা বাড়তে দেখায় বাণিজ্যিক বিমান চালনার ডিগ্রির জন্য পড়াশোনা করেন নাকারিন ইন্তা। এরপর থাই লায়ন এয়ারে চাকরি জুটে যায়। তার কথায়, ‘ছোটবেলা থেকে সবসময় পাইলট হওয়ার স্বপ্ন দেখেছি। এই পেশার সবচেয়ে ভালো দিক হলো, বিশ্বজুড়ে ভ্রমণ ও বিভিন্ন দেশের মানুষ দেখা যায়। পাইলটের ইউনিফর্ম পরে বিমানবন্দরে গেলে যাত্রীদের হাসিমুখ দেখি। একে অপরের সঙ্গে দেখা হলে কিংবা সৈকত বা পাহাড়ে বেড়াতে যাওয়ার সময় তাদের মুখে হাসি থাকে। সর্বোপরি, পরিবারের জন্য কিছু অর্থ উপার্জন করতে পারি।’
পাইলট হিসেবে প্রতি মাসে সাধারণত ৬ হাজার থেকে ৮ হাজার ডলার (৫ লাখ ১০ হাজার থেকে ৬ লাখ ৮০ হাজার টাকা) উপার্জন করতে পারেন নাকারিন ইন্তা। অথচ গত মার্চের মাঝামাঝি থেকে করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কারণে দিনে ৩০ ডলার (২ হাজার ৬০০ টাকা) পেলেও তিনি খুশি। বিজয়ীর হাসি নিয়ে ঘরে ফেরেন।
থাইল্যান্ডের একাধিক এয়ারলাইনস ব্যয় কমাতে ফ্লাইটের সংখ্যা কমিয়েছে। এ কারণে ইন্তা শুধু একা নন, তার জানাশোনা দেশটির অর্ধশতাধিক পাইলট এখন খাবার ডেলিভারি দেওয়া, রাইড শেয়ারিং অ্যাপে গাড়ি চালানো কিংবা খাবার বিক্রেতা হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করেন। তাদের মধ্যে তার কয়েকজন বন্ধু আছে। কেউ কেউ নিজেদের দামি বাহন পার্ট-টাইম চাকরিতে কাজে লাগাচ্ছেন। যেমন, বিএমডব্লিউ মোটরসাইকেল ও সেডান ব্র্যান্ডের গাড়ি।
পাইলটের আসনে ফেরার আগে খাবার ডেলিভারির কাজ করছেন পাইলট নাকারিন ইন্তাইন্তা জানান, তাকে কিংবা তার বন্ধুদের চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়নি। কিন্তু ফ্লাইট সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে তারা বেতন পান। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, বিশ্বে প্রত্যেকের ওপর কোভিড-১৯ রোগের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তবে প্রিয়জনের দিকে তাকিয়ে তাদের ও নিজের জন্য সংগ্রাম করতে হবে। প্রথমবার খাবারের অর্ডার পেয়ে গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দিয়ে দারুণ লেগেছে আমার। আমি গর্বিত, কাজটা করতে পারছি।’
আবারও নিয়মিত কাজ অর্থাৎ পাইলট হিসেবে দায়িত্ব পালনের অপেক্ষায় এভাবেই দিন কাটছে থাই পাইলটদের। শিগগিরই আবারও নিজের অফিসে (ককপিট) ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী ইন্তা। তার দেশে অভ্যন্তরীণ পর্যটন পুনরায় চালু হতে যাচ্ছে। তখন ফ্লাইটের সংখ্যাও ধীরে ধীরে বাড়বে।
নাকারিন ইন্তার সিদ্ধান্ত, আগামী আগস্টে চার দিনের পাইলট রিফ্রেশার প্রোগ্রামে অংশ নেবেন। এরপর তিনি আবারও কাজে যোগদান করতে চান। তিনি বলেন, ‘ক্যারিয়ারের প্রতিটি মুহূর্ত মিস করছি। আমার সহকর্মী, ক্যাপ্টেন, কেবিন ক্রু, ডেস্প্যাচারসহ সব কর্মীকে মিস করি। আমরা অনেক বছর একসঙ্গে কাজ করেছি। সবচেয়ে বেশি মিস করি আকাশে আমার অফিস!’
তথ্যসূত্র: সিএনএন