স্পোর্টস ডেস্ক : ইতিহাস তার চেনা পথ ধরে হাঁটল না। টাইম মেশিনে যেমন ৩০ বছর আগে যাওয়া যায় না, তেমনি ফিরল না সেই ১৯৯২। অথচ গত কয়েকদিন ধরেই এই সমীকরণই মেলাচ্ছিলেন পাকিস্তানের ক্রিকেটপ্রেমীরা। বাবর আজমে তারা দেখছিলেন ইমরান খানের ছায়া। সেই একই ভেন্যু, একই প্রতিপক্ষ। ম্যাচটাও ফাইনাল। স্বপ্ন দেখতে বাধা ছিল না। কিন্তু সেই আকাশ ছোঁয়া স্বপ্ন আর আত্মবিশ্বাস নিয়ে ফাইনাল শুরু করা দলটা কোথায়? বিশ্বকাপ ফাইনালের মতো বড় মঞ্চে বরং হলো তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়া। ৯২-এর প্রতিশোধ নিল ইংল্যান্ড। পাকিস্তানকে উড়িয়ে সেই মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডেই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ট্রফি বুঝে নিল ইংলিশরা।

রোববার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালটা এমন একপেশে হবে কে জানত? প্রতিশোধটা ইংলিশরা এমন করেই নিয়েছে যে, ম্যাচে পাত্তাই পায়নি পাকিস্তান। মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডের গ্যালারির ৮০ হাজার ৪৬২ জন দর্শককে সাক্ষী রেখে দ্বিতীয়বারের মতো টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতে নিল ইংল্যান্ড।

দিন-রাতের ম্যাচে বৃষ্টির শঙ্কা উড়িয়ে টস ভাগ্যটা জস বাটলারের পক্ষে গেল। ইংল্যান্ড অধিনায়ক আবহাওয়া আর এমসিজির উইকেটের কথা ভেবে শুরুতে বল তুলে দেন নিজের বোলারদের হাতে। তার সিদ্ধান্তটা যৌক্তিক হতে সময় লাগেনি। ২০ ওভারে পাকিস্তান ৮ উইকেট হারিয়ে তুলতে পারে মাত্র ১৩৭ রান। মারকাটারি ব্যাটিংয়ের এই যুগে ২০ ওভারে এই রান একেবারেই মামুলি।

জবাবে ব্যাটিংয়ে নেমে পুরো টুর্নামেন্টে ফ্লপ থাকা বেন স্টোকস দেখান তার যোগ্যতার পরিধিটা। তার ব্যাটেই ইংল্যান্ড ফাইনালটা নিজেদের করে নেয়। ১ ওভার হাতে রেখেই ইংল্যান্ড বনে যায় বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন!

পাকিস্তানের পেস আক্রমণকে ভয় করছিল ইংল্যান্ড। সেই জুজুতে শুরুতে চাপেও পড়েছিল তারা। এমনিতে লো স্কোরিং ম্যাচ অনেক সময়ই উপভোগ্য হয়। তেমন কিছুরই ইঙ্গিত ছিল শুরুতে।

প্রথম ওভারেই ভাঙে সেমিফাইনালে ভারতকে উড়িয়ে দেওয়া ইংল্যান্ডের উদ্বোধনী জুটি। অ্যালেক্স হেলসকে বোল্ড করেন শাহিন শাহ আফ্রিদি। তার লেগ স্টাম্পে পড়ে সোজা আসা বলে হেলস ব্যাট চালিয়ে খেলতে পারেননি। প্যাডে লেগে বল আঘাত হানে স্টাম্পে। ২ বলে ১ রানে আউট হেলস।

তারপর হারিস রউফ ম্যাচ জমিয়ে তোলার ইঙ্গিত দেন ফিল সল্টকে ফিরিয়ে। পুল করতে গিয়ে মিস টাইমিং। সল্ট অনায়াস ক্যাচ তুলে দেন ইফতিখার আহমেদের হাতে। তিনি ফেরেন ৯ বলে ১০ রানে।

এরপর অধিনায়ক জস বাটলারকেও ফেরান হারিস রউফ। তার লাফিয়ে বলে ডিফেন্স করতে গিয়ে লাইন মিস করেন বাটলার। বলে সুইং থাকায় ব্যাটের বাইরের কানা স্পর্শ করে চলে যায় মোহাম্মদ রিজওয়ানের গ্লাভসে। ফেরার আগে ১৭ বলে ২৬ রান করেন বাটলার। পাওয়ার প্লের প্রথম ৬ ওভারে ইংল্যান্ড তোলে ৩ উইকেট হারিয়ে ৪৯!

তারপর বেন স্টোকস আর মঈন আলির ব্যাটে হাসিমুখ ইংল্যান্ডের। পরিস্থিতি বুঝে লড়ে গেছেন দুজন। জানা ছিল আস্কিং রানরেট বেশি নয়, টিকে থাকলেই চলবে। পাওয়ার প্লে থেকেও ভাল রান পেয়েছিল দল। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে স্টোকস খেলেন ঠান্ডা মাথায়। তার ব্যাট থেকে আসে ম্যাচ জেতানো ৪৯ বলে ৫৫ রানের অপরাজেয় ইনিংস। মঈন আলী করেন ১৩ বলে ১৯ রান!

এর আগে টস হেরে ব্যাট করতে নেমে শুরুটা ভালো হয়নি পাকিস্তানের। শুরুতেই রানআউটে ফিরতে যাচ্ছিলেন মোহাম্মদ রিজওয়ান। ক্রিস জর্ডান মিস করায় প্রাণ পেলেও সেটি কাজে লাগাতে পারেননি পাকিস্তানের এই ওপেনার। রিজওয়ানের উইকেট নিয়ে ইংল্যান্ডকে প্রথম সাফল্য এনে দেন স্যাম কারান।

এই পেসারের অফ স্টাম্পের অনেক বাইরে পিচ করা বলে ব্যাট চালিয়ে ভুল করেন রিজওয়ান। ব্যস, ব্যাটের ভেতরের কানায় লেগে আঘাত হানে লেগ স্টাম্পে। ফেরার আগে ১৪ বলে ১৫ রান করেন রিজওয়ান। তার বিদায়ের সময় দল মহা বিপাকে। ৫ ওভার শেষে পাকিস্তানের রান তখন ১ উইকেটে ২৯।

তারপর মোহাম্মদ হারিসও যেতে পারেননি বেশিদূর। আক্রমণে এসেই তাকে ফেরান আদিল রশিদ। তখন খেলা চলছিল অষ্টম ওভারের। বল হাতে নিয়েই বোকা বানান হারিসকে। তার প্রলুব্ধ করা বলে উইকেট ছেড়ে মারতে গিয়ে সর্বনাশ হয় হারিসের। টাইমিং ভুলে লং-অনে বেন স্টোকসের হাতে বল দিয়ে সাজঘরের পথ ধরেন তিনি। তার আগে করেন ১২ বলে ৮ রান।

তারপর অবশ্য অধিনায়ক বাবর আজমের সঙ্গে শান মাসুদের জুটিটা জমেই যাচ্ছিল। তবে রান তোলার গতিটা কখনোই সন্তুষ্ট হওয়ার মতো ছিল না। মেলবোর্নের উইকেটে প্রথম ১০ ওভার শেষে পাকিস্তান তোলে ২ উইকেটে ৬৮ রান।

তারপর ফের পথ হারায় ২০০৯ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়নরা। সেই আদিল রশিদেই সর্বনাশ তাদের। আদিলের গুগলিতে বোকা বনে ক্যাচ তুলে দেন বাবর। ১২তম ওভারের প্রথম বলেই গুগলি করেন আদিল। তার ডেলিভারি এতটাই বাঁক নিচ্ছিল যে ব্যাটে ঠিকঠাক খেলতে পারেননি বাবর। ক্যাচ উঠে যায় বোলার আদিলের হাতেই। দলকে চাপে ফেলে পাকিস্তান অধিনায়ক ফেরেন ২৮ বলে ৩২ রান করে।

টানা দুই ওভারে উইকেট হারিয়ে পথটাও হারিয়ে ফেলে পাকিস্তান। আদিলের পর বল হাতে ম্যাজিক দেখান বেন স্টোকস। তিনি তুলে নেন ইফতিখার আহমেদের উইকেট। স্টোকসের দ্রুতগতির লাফিয়ে ওঠা বল খেলতে পারেননি ইফতিখার। বল তার গ্লাভস ছুঁয়ে চলে যায় অধিনায়ক জস বাটলারের গ্লাভসে। ৬ বল খেলে কোনো রান না করেই ফেরেন তিনি!

এরপর শাদাব খান-শান মাসুদ জুটি গড়ে বড় স্কোরের স্বপ্ন দেখাচ্ছিলেন পাকিস্তানকে। গ্যালারিতে রাজত্ব করা পাকিস্তানি দর্শকদের কিছুটা সময়ের জন্য হলেও স্বস্তি দেন এ দু’জন। কিন্তু বড় জুটি গড়া হয়নি। দ্বিতীয় স্পেলে এসে স্যাম কারান ভাঙেন এই জুটি। তার বলে ছয় মারতে গিয়ে মিড উইকেটে লিভিংস্টোনের হাতে ক্যাচ তুলে দেন মাসুদ। তার আগে করেন ২ চার ও ১ ছক্কায় ২৮ বলে ৩৮ রান। ভাঙে ৩৬ রানের জুটি।

শাদাবও দ্রুত মাসুদের সঙ্গী হয়ে হতাশায় ভাসান মেলবোর্নের গ্যালারিতে হাজির পাকিস্তানি দর্শকদের। ক্রিস জর্ডানের বলে পুল করতে গিয়েছিলেন। টাইমিংয়ে গড়বড়, ক্যাচ উঠল মিড অফে। ক্রিস ওকস সেটি লুফে নিলেন সহজেই। ১৪ বলে ২০ রান করে ফেরেন শাদাব। তারপর কারান তুলে নেন মোহাম্মদ নাওয়াজের উইকেটও। ৭ বলে ৫ রান করেন তিনি!

শেষদিকে কারানের বোলিংয়েই পথ হারায় পাকিস্তান। তারপর আর ফেরা হয়নি। শেষ পর্যন্ত টেনেটুনে ১৩৭ রান তুলতে পারে পাকিস্তান।

কারান ৪ ওভারে মাত্র ১২ রান দিয়ে নেন ৩ উইকেট। রশিদ দুই উইকেট নিয়েছেন ২২ রানে। ২৭ রানে সমান উইকেট ক্রিস জর্ডানের।

একদিন আগে চলে গেছেন ইংল্যান্ড ক্রিকেটের গডফাদার খ্যাত ডেভিড ইংলিশ। তার প্রয়াণে শোকার্ত ইংলিশ ক্রিকেটাররা বাহুতে কালো ব্যান্ড নিয়ে আজ মাঠে নামেন। এমন শোকের দিনটাকে অনন্য এক অর্জনের ক্ষণ বানিয়ে ফেলল জস বাটলারের দল। কী আশ্চর্য, গত কয়েক দিন ধরে মেঘ-বৃষ্টির-রোদ্দুরের যে গল্প চলছিল, তা ম্যাজিকের মতো উধাও হয়ে গেল!

নির্বিঘ্নে খেলা হলো আর সেই খেলায় পাকিস্তানকে নিয়ে খেলল ইংল্যান্ড। প্রতিশোধ হয়তো এভাবেই নিতে হয়। ৯২ আর ফিরে আসল না, বাবর আজমও হতে পারলেন না ইমরান খান! সেই মেলবোর্নেই ১৯৯২-এর ‘প্রতিশোধ’ নিল ইংল্যান্ড।