ইউসুফ কামাল : আট.
ইলা ধীরে ধীরে বদলাতে শুরু করে দিলো, প্রথম দিকে নিজের আত্মীয়স্বজনদের সাথে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেলো, কারো টেলিফোন রিসিভ করতো না। নিজের থেকে কাউকে ফোন, চিঠি বা কোনো মাধ্যমেই আর খোঁজখবর রাখতো না। আর সবশেষে নিজের বাবা মা’র সাথেও দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে গেলো, যাও একটু কথাবার্তা হতো তাও শুধুমাত্র মা’র সাথে। ওর এই পরিবর্তনের কারণ সবার সামনে ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয়ে গেলো, কারো আর কিছু জানতে বাকী থাকলো না। আপনজনদের সাথে অভিমানের পাল্লাও ভারী হতে লাগলো ইলার, নিজের কাজের মধ্যে এমনভাবে ডুবে থাকতে শুরু করলো যেন পুরনো কিছুই আর মনে না আসে। মাঝে মাঝে সময় কাটানোর জন্যই ডাবল শিফট্ কাজ শুরু করে দিলো। মাঝে মাঝে উর্মিলা আশ্চর্য হয়ে যায় ইলার কাজে, কয়েকদিন নিষেধও করেছিলো ও শোনেনি। বুঝেছে একা হলেই দুশ্চিন্তা বাড়বে তাই কাজের মধ্যেই থাকতে চায়। মাস ছয়েক কাজের পরে ইলাকে পার্মানেন্ট করে নিল ম্যানেজমেন্ট ওর কাজ দেখে, সেখানেও উর্মিলার সহযোগীতার হাত ছিলো। পার্মানেন্ট হওয়ায় বেতন বেড়ে ডাবল হয়ে গেল সাথে অন্যান্য সুযোগ সুবিধা। ইলার ব্যাবহারে কাজের সবাই সহযোগীতার হাতও বাড়িয়ে দেওয়া শুরু করলো। তাতে কি, কিন্তু দিন শেষে সেই একাকিত্ব ওকে যেন জড়িয়ে ফেলতে চাইতো। আর বাস্তবে হলোও তাই, পরিশেষে ইলা এখন পরিপূর্ণ একা একজন মানুষ। যার সামনে পিছনে কারো জন্যেই আর ভাবতে হয় না, যেন দূর সমুদ্রে পাশে নিঃসঙ্গ একাকী দাঁড়িয়ে থাকা এক ‘বাতিঘর’ যার দায়িত্ব শুধু নিঃশব্দে নিজের উপস্থিতিটুকুই জানান দেওয়া। বিষয়টাতে সবাই বিস্মিত হয়ে পরলো, ঘটনা জানতে ইলা’র বাবা-মা অবিনাশের সাথে যোগাযোগ করেও কোন সদুত্তর পেলো না। শুধু জানালো ভালো আছে, ভালো একটা চাকরী করে অন্য কোন সমস্যা নেই। তাছাড়া অবস্থার নিয়ন্ত্রণও বাস্তবিক পক্ষে অবিনাশের হাতে নেই তাই নতুন করে ওর বলারও কিছু নাই। ইলাকে সর্বশেষেও বুঝিয়ে সুঝিয়ে শান্ত করতে না পারার কারণে সবাই অবিনাশের উপরই সব দোষ বর্তালো, খুব সহজ একটা সমীকরণ। বিদেশের জীবনটা সত্যিই অন্যরকম। সবাই তো আর সম্ভাবনার টিকিট হাতে নিয়ে আসে তা নয় বরং সামাজিকও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠা পেতে অনেককে নিম্ন শ্রেণীর কাজও করতে হয় যা তারা জীবনে কখনো চিন্তাও করে নাই। তখন তাদের সবার সামনে চিন্তা একটাই, যেভাবেই হোক এখানে প্রতিষ্ঠা পেতেই হবে। ঐ একই চিন্তায় ডুবে গেল ইলা, সরাসরি উর্মিলার কথা মতো এগিয়ে চল্লো সব কিছু বাদ দিয়ে। বন্ধু, হিতাকাংখী বলতে উর্মিলাই এখন ওর সব কিছু। মাঝে মাঝে অবসরের যে সময়টুকু পায় তা রাতের ঘুমের সময়টুকুই। বিছানায় শুয়ে পুরনো স্মৃতি ভাবতে ভাবতে ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ে।
প্রথম প্রথম কয়েকদিন ইলার দু’চোখ ছাপিয়ে কান্না আসতো, কিছুতেই থামতে চাইতো না। অনেক রাত কাঁদতে কাঁদতেই ঘুমিয়ে পরেছে এমনও হয়েছে। ভাবতো এ কেমন জীবন ঈশ্বর তাকে দিয়েছেন, আর কেনই বা সেটা তাকেই দিলেন? ঘুমে দুচোখ বন্ধ হওয়ার আগে টুকরো স্মৃতির মধ্যে বেশির ভাগ জায়গা জুড়ে থাকতো ওর ‘মা’ আর বাকী অংশের বেশি অংশ ফেলে আসা জীবনের স্মৃতি, কলেজ জীবন আর শাহেদ। কেন জানি ‘মা’কে ওর একটা দুঃখী মানুষ বলে মনে হয়। বাবার কথার উপরে মা’কে কোন দিন কোন কথা বলতে দেখেনি, সব কিছুই নিরবে মেনে নিয়ে সংসার করে যেতে দেখেছে। কথা বলার মধ্যে ইলার সাথেই, আর বাকী সময়টা ঘর গেরস্থালী নিয়ে ব্যাস্ত থাকতো। ইলা আমেরিকায় পৌঁছানোর দিন পনেরোর মাথায় সোশাল সিকিউরিটি নাম্বার আর গ্রীণ কার্ড হাতে পেয়ে গেলো। অবিনাশের স্পাউস হিসাবে তার ঠিকানায় আসায় অবিনাশই ওগুলো উর্মিলার কাছে পৌঁছে দিয়েছে। এই মুহূর্তে এগুলোই ইলার আমেরিকায় বৈধভাবে থাকা ও কাজ করার জন্য অসম্ভব জরুরি ছিলো, আর সেটা পেয়ে যাওয়ায় ইলা এখন পুরোপুরি নিশ্চিন্ত। এ সব বিষয়ে অবিনাশ ও আর কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে যায়নি। সে বুঝে গেছে ঐ ধরনের কিছু করতে গেলে বরং সে নিজেই আরো ফেসে যাবে। এমনিতে সে এখন প্রচন্ড অনুতপ্ত, ভূলটা যে তার সেটা হারে হারে টের পাচ্ছে।
আর সেই সাথে উর্মিলা যে ইলার সব কিছু দেখভাল করছে ভেবে সে বরং অনেকখানি নিশ্চিন্ত। শাহেদের সাথে যোগাযোগটা ইলা ঠিকই চালু রেখেছে, দিন পনেরো পর পর ছুটির দিনে বসে সারা দু, সপ্তাহের খবরাখবর শাহেদকে জানিয়ে যেন একটা শান্তি অনুভব করে। পক্ষান্তরে এটার জন্য শাহেদও যেন উন্মুখ হয়ে বসে থাকে। এটা একটা অলিখিত রুটিনের মতোই হয়ে গিয়েছে দু’জনের। পত্র পাওয়ার ফিরতি ডাকেই শাহেদও জানিয়ে দেয় তার মনের যত কথা। বলা চলে দ্বৈত সম্পর্কটা ঠিক আগের মতোই আছে, ইলা সমস্ত প্রতিকুল অবস্থার মধ্যেও সেটাকে ভেংগে যেতে দেয়নি। বলা চলে একমাত্র শাহেদের সাথেই তার যোগাযোগটা ঠিক আছে, এটার মধ্যে কোন চিড় ধরেনি। হয়তো এটাই ওঁকে সম্পূর্ণ ভেংগে পড়া থেকে বাঁচিয়ে রেখেছে আর এটাই ওর বর্তমানের একমাত্র অবলম্বন।
হঠাৎ করেই একদিন নোমান এসে হাজির শাহেদের সেগুন বাগিচার অফিস রুমে। চাকুরী হওয়ার পর এই প্রথম নোমান ওর অফিসে, অসম্ভব একটা ভালোলাগা বোধ কাজ করলো ওর মধ্যে। বন্ধু হিসেবে নোমান অনেকটা ঘনিষ্ট হয়ে গেছে এর মধ্যে ও নিজের থেকেই বল্লো, মতিঝিলে একটু কাজ ছিল ব্যাংকের হেড অফিসে। ভাবলাম অনেকদিন দেখা হয় না তোমার সাথে এদিকে এলামই যখন দেখা করেই যাই। শাহেদ জানে ও গাজীপুরেই থাকে, ওখানেই পৈতৃক ব্যবসাকে আরো বড় করে ঐ নিয়েই ব্যাস্ত থাকে সারাক্ষণ। টেলিফোনে কথা বলার ফুরসৎটুকুও ঠিক মতো পায় না।
নোমান কথাবার্তা শেষে ব্রীফকেস খুলে একটা বিয়ের কার্ড বের করে দিয়ে বল্লো, এসো কিন্তু। শাহেদ বুঝলো নোমানের বিয়ে । পরিবারের সম্মতিতেই বিয়ে হচ্ছে বাবার বন্ধুর মেয়ের সাথে। শাহেদের কাছে নোমানকে এ বিয়েতে খুশিই মনে হলো। শাহেদ চিন্তা করলো তার মানে সবারই মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয়ে গেছে। ইলার ঠিকানা তো আমার কাছে নেই, থাকলে ওঁকে একটা কার্ড পাঠিয়ে দিতাম। নোমানের কথায় শাহেদ বুঝে ফেল্লো ইলা সত্যিই তাহলে একা হয়ে গিয়েছে। চিন্তা করলো তার মানে নোমানও জানে না ইলার সাথে ওর যোগাযোগ আছে? ইলার তাহলে কারো সাথেই যোগাযোগ নাই শাহেদ ছাড়া? বুকের মধ্যে কেমন যেন একটা শূন্যতা বোধ নতুন করে জেগে উঠলো শাহেদের এই মুহূর্তে ইলার জন্য। কারো সাথেই তো ওর আর যোগাযোগ নেই তাহলে ইলা একা আছে কেমন করে? ওর কষ্টে ভরা মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো। এখন কি করা উচিত ওর? কি করবে শাহেদ? বিদেশী ডেলিগেটদের নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত আন্তঃএশীয় দেশসমুহের একটা সন্মেলনের কাজে ব্যাস্ত থাকায় শাহেদ শেষ পর্যন্ত নোমানের বিয়ের অনুষ্ঠানে থাকতে পারেনি, ফোনে সব খুলে বলে দুঃখ প্রকাশ করেছে উপস্থিত হতে না পারার জন্য। ইলা চলে গেছে কতদিন নতুন করে হিসেব করতে বসলো শাহেদ।
সময় কত হলো, কোথা দিয়ে দিন মাস বছর চলে যাচ্ছে …
শাহেদ মাঝে মাঝে ভাবে ইলা কি তবে তার ভালোবাসার কারণেই শাহেদ ছাড়া আর সবার কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে চাইছে? কাউকেই ঐ জায়গায় মেনে নিতে পারছে না এমনকি অবিনাশকে তো নয়ই। তাহলে কি করবে এখন, একটা বিরাট প্রশ্ন শাহেদের নিজের কাছে ….. (চলবে)
ইউসুফ কামাল : লেখক, হিউস্টন, টেক্সাস, ইউএসএ