হাসান গোর্কি : ষষ্ট ইন্দ্রিয় বলে কি কিছু আছে? মানুষের কি অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা থাকতে পারে? দু’টি প্রশ্নের উত্তরে বলা উচিত থেকে থাকলে আমাদের কাছে তার প্রমাণ নেই। তবে অদ্ভুত শোনালেও বৈশিষ্ট্যের বিপরীতে বিজ্ঞানে অব্যাখ্যাত এমন কিছু বিষয় পাওয়া যায় যা অতীন্দ্রিয়তার কাছাকাছি। চিরায়ত পদার্থবিদ্যায় যে স্বতঃসিদ্ধগুলো ছিল কোয়ান্টাম ফিজিক্স তার বেশিরভাগ-ই বাতিল করে দিয়েছে। কোয়ান্টাম এন্ট্যাঙ্গেলমেন্ট সেরকম-ই একটা তত্ত¡ যা পদার্থ সম্পর্কে দীর্ঘদিনে গড়ে ওঠা ধারণাকে ভুল প্রমাণ করেছে। ছয়শ’ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ভারতীয় দার্শনিক কণাদ প্রথম পরমাণুর ধারণা প্রকাশ করেন। এর দুইশ’ বছর পর ডেমোক্রিটাস এই অতিক্ষুদ্র অবিভাজ্য কণার নাম দেন এটম। তিনি মনে করতেন পরমাণুগুলি সুষম ও শক্ত (Solid)। একে সংকুচিত বা ধ্বংস করা যায় না। ডেমোক্রিটাস বিশ্বাস করতেন, মানুষের আত্মা ও ইন্দ্রিয়ের নিয়ন্ত্রকও পরমাণু। তবে প্লেটো পরমাণুকে মানসিক গুণের নিয়ন্তা হিসেবে মানতে রাজি ছিলেন না। স্নেহ, ক্ষোভ, সৌন্দর্য, মহত্ব পরমাণুর যান্ত্রিক ও ভৌত প্রকাশ — তিনি এই ধারণার বিরোধিতা করেন। রোমান ক্যাথোলিক পুরোহিতেরাও প্লেটোর ধারণার সাথে একমত হন। ডাল্টনের পরমাণুবাদে পরমাণুকে অবিভাজ্য মনে করা হয়েছিল। কিন্তু পরে জানা গেলো তিনটি অতি সূ² কণিকা দিয়ে পরমাণু গঠিত। প্রোটন ও নিউট্রন একত্রিত হয়ে নিউক্লিয়াস গঠন করে। এরা যথাক্রমে ধনাত্মক আধানযুক্ত এবং আধানহীন। নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে ঘুরছে ঋণাত্মক আধানযুক্ত ইলেকট্রন। আধুনিক পদার্থ ও রসায়ন বিজ্ঞান এই ব্যাখ্যায় দীর্ঘদিন সন্তুষ্ট ছিলো। কিন্তু এই ধারণা প্রায় ভেঙে পড়লো যখন কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যা পুরনো ধারণার সাথে কিছু নতুন পর্যবেক্ষণ যোগ করলো।
কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞান বলছে শূন্যস্থান বলে কিছু নেই। এই তত্ত¡কে বলা হয় ভার্চুয়াল পার্টিকেল থিওরি। এতে বলা হচ্ছে পদার্থ ও প্রতি পদার্থের তরঙ্গায়িত মিথস্ক্রিয়ায় উৎপন্ন শক্তিতে শূন্যস্থান পূর্ণ। সেখানে প্রতিনিয়ত কিছু কণার উৎপত্তি ঘটছে এবং সেকেন্ডের বিলিয়ন ট্রিলিয়ন ভাগের এক ভাগ সময়ে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এই ঘটনাকে বিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন, যা থেকে সিঙ্গুলারিটি ও বিগ ব্যাং এর ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। ক্ল্যাসিক্যাল পদার্থবিদ্যায় মনে করা হতো সূর্যের নিউক্লিয়ার ফিউশন আকস্মিকভাবে তৈরি হওয়া একটা চেইন রিএকশন। কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞান এই ঘটনার শুরুর কারণ ব্যাখ্যা করেছে এভাবেÑ সূর্যের ভর এতো বেশি যে তা তার মৌলগুলোর ওপর মাত্রাতিরিক্ত চাপ তৈরি করে। ফলে সেগুলো ভেঙে গিয়ে নিউক্লিয়ায় ফিউশন ঘটায়। সূর্য যদি কলা দিয়ে তৈরি হতো তাহলেও সেখানে নিয়ক্লিয়ার ফিউশন ঘটতো এবং এখনকার মতোই আলো ও তাপ বিকিরণ করতো। রেললাইনের ওপর পয়সা দিয়ে রাখলে ট্রেন চলে যাবার পর হাতে নিলে দেখা যায় পয়সাটা চ্যাপ্টা ও গরম হয়ে গেছে। তার অর্থ উত্তাপ তৈরিতে সবসময় আগুণের দরকার হয় না। চাপও উত্তাপ তৈরি করতে পারে। পৃথিবী ও বৃহস্পতি গ্রহকে যদি যথাক্রমে ১৩ লক্ষ ও এক হাজার গুণ বড় করা হয় তাহলে তারাও সূর্যের মতো নক্ষত্রে পরিণত হবে।
ফোটন একই সাথে তরঙ্গ ও কণা। কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানের মতে ইলেকট্রনও তা-ই। কোনকিছু একই সাথে তরঙ্গ ও কণা হয় কীভাবে! দ্বিতীয় সমস্যা হলো, আমরা এতদিন জানতাম ইলেকট্রন কণা নিউক্লিয়াসের চারিদিকে একটা নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘুরতে থাকে। এখন জানা যাচ্ছে, এটি আসলে নিউক্লিয়াসের আশপাশে অনেকগুলো বা যে কোনো বিন্দুতে একই সাথে অবস্থান করে অর্থাৎ সে তখন তরঙ্গের আকারে থাকে। কিন্তু যখন আমরা তাকে দেখতে চেষ্টা করি তখন সে কণার রূপ নেয় এবং তাকে আমরা একটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে দেখতে পাই। ছোটবেলায় আমরা কারো সামনে তর্জনী নাড়াতে থাকতাম এবং ধরতে বলতাম। ধরতে গেলে বৃদ্ধাঙ্গুলি এগিয়ে দিতাম। সে ধরে দেখতো তর্জনীর নাগাল সে পায়নি। এই ব্যাপারটা কিছুটা সে’রকম। আপনি যখন কোনো বস্তুকে দেখবেন না তখন সেটা একই সাথে সম্ভাব্য সকল স্থানে উপস্থিত থাকবে। কিন্তু আপনি দেখতে চেষ্টা করলেই সেটা একটা স্থানে আসবে। বিষয়টা ভূতুরে। এবার সম্ভবত বিষয়টা বোধগম্যতার বাইরে চলে গেলো! ধরুন, আপনি মাঠে বসে ফুটবল খেলা দেখছেন। আপনি যদি বলটিকে দেখতে চেষ্টা না করেন তাহলে সে মাঠের বা মাঠের বাইরের সব বিন্দুতে একই সাথে অবস্থান করবে। আরও জটিল হয়ে গেলো?
এবার ধরুন, আপনি একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। সেখানে আপনার নিয়মিত যাতায়াত আছে। ছুটির দিনে আপনি বাড়িতে আছেন। তখন কি বিশ্ববিদ্যালয়টা তার জায়গায় আছে? কোয়ান্টাম ফিজিক্স বলছে ‘নাই’। সেখানে যা আছে তা একটা তরঙ্গ। আপনি যখন সেখানে যাবেন তখন সেটা কণা হয়ে পদার্থের রূপ নেবে, একটা ভৌত কাঠামো পাবে এবং আপনি সেটাকে দেখতে ও ছুঁতে পারবেন। এবার নিশ্চয়ই আপনি বিরক্ত হয়ে ভাবছেন আমার দেওয়া তথ্যটি ভুল এবং আপনি দেখুন বা না দেখুন আপনার বিশ্ববিদ্যালয় সব সময় সেখানে আছে। এ ভাবনায় আপনার দোষ নেই। আইনস্টাইনও হাইজেনবার্গ এবং নিলস বোরের কোপেনহেগেন ইন্টারপ্রিটেশনের সাথে একমত হয়েও বলেছিলেন, “চাঁদকে আমি দেখি বা না দেখি, সে আকাশে আছে- সে’রকম ভাবতেই আমি বেশি পছন্দ করবো।” আচ্ছা, এমন যদি হয় আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্য অনেকে উপস্থিত আছে এবং তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরো কাঠামো দেখছে তাহলে তো সেটা আছে এবং আপনার জন্যও পদার্থের আকারে আছে। না। আপনার সাপেক্ষে সেটা তখনও তরঙ্গ, তার কোনো কাঠামোগত অস্তিত্ত¡ নেই। ভাববাদী দার্শনিকেরা বলছেন, পদার্থ বলে কিছু নেই। পদার্থ হলো কারণের ভ্রমাত্মক অবভাস। কোয়ান্টাম ফিজিক্সও কি তাহলে একই কথা বলছে?
কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সবচেয়ে ভূতুরে তত্ত¡ হলো ‘কোয়ান্টাম এন্টেঙ্গেলমেন্ট’। এটা একটা তত্ত¡গত ভাবীকথন। এতে বলা হচ্ছে, দুটি অতি পারমাণবিক কণা যখন কাছাকাছি আসে তখন তাদের মধ্যে একটা বিজোড়ন অবস্থা বা এন্টেঙ্গেলমেন্ট তৈরি হয়। এরপর যদি কণা দু’টিকে আলাদা অবস্থানে নিয়ে যাওয়া হয় তাহলে তাদের মধ্যে তৈরি হওয়া সম্পর্ক ভেঙে যায় না। বরং তারা পরস্পরকে অব্যর্থভাবে প্রভাবিত করতে থাকে। কণা দু’টিকে যতো বেশি দুরত্বেই নিয়ে যাওয়া হোক, তারা পরস্পরকে প্রভাবিত করা ছেড়ে দেবে না। সবচেয়ে ভূতুরে বিষয় হলো, এই কাজে তারা কোন সময় ব্যয় করবে না। কণা দু’টিকে যদি মহাবিশ্বের দুই প্রান্তে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দিয়ে আসা হয় তাহলেও তারা কোনো সময় ব্যয় না করেই পরস্পরকে প্রভাবিত করবে। আমরা জানি আলোর গতির চেয়ে বেশি গতিতে বার্তা প্রেরণ সম্ভব নয়। মহাবিশ্বের দৃশ্যমান অংশের এই মুহূর্তের ব্যাস প্রায় ৯৩ বিলিয়ন আলোকবর্ষ। কণা দু’টি পরস্পরের সাথে যোগাযোগ করতে চাইলে ক্ল্যাসিক্যাল ফিজিক্সের তত্ত¡ অনুযায়ী একমুখী বার্তা প্রেরণেই তারা ব্যয় করবে ৯৩ বিলিয়ন বছর। কিন্তু সেটা ঘটবে সেকেন্ডের ভগ্নাংশে বা কোনো সময় ব্যয় না করেই। আইনস্টাইন এটার নাম দিয়েছিলেন, “Spooky action at a distance” বা দূরত্বের ক্ষেত্রে ভূতুরে ঘটনা।/আচরণ। ধরা যাক, বিজোড়ন অবস্থা থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দু’টি ইলেকট্রনকে মহাবিশ্বের দুই প্রান্তে নিয়ে যাওয়া হলো। বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী এদের একটিতে যদি আপ স্পিন পাওয়া যায় তাহলে অন্যটিতে ডাউন স্পিন পাওয়া যাবে। ধরা যাক, আমরা ডাউন স্পিনে থাকা ইলেকট্রনের স্পিন পরিবর্তন করে আপ করে দিলাম। তাহলে সাথে সাথে অন্য ইলেকট্রন নিজে থেকে তার স্পিন পরিবর্তন করে ডাউন করে নেবে। ইলেকট্রনের জায়গায় দু’টি জল ভরা কলসির কথা ভাবুন। প্রথম কলসিটির মাথা উঁচু করে দিলে ৯৩ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে থাকা দ্বিতীয় কলসিটি মাথা নিচের দিকে দিয়ে সব পানি ফেলে দেবে।
hassangorkii@yahoo.com
অক্টোবর ৩১, ২০২২, রয়্যাল রোডস ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া, ব্রিটিশ কলম্বিয়া।