ইউসুফ কামাল : সাত.
তখন সিয়ার্সের ব্যবসায়িক অবস্থান আমেরিকার উল্লেখযোগ্য কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অন্যতম। আমেরিকার নামকরা বড় বড় শহরগুলোতেই তাদের বিশাল বিশাল আউটলেট। বনেদী ধরনের একটা প্রতিষ্ঠান। কি পাওয়া যায় না এখানে, ঘর গেরস্থালী থেকে শুরু করে মোটামুটি নিত্য প্রয়োজনীয় সব। আর এখানে যারা চাকরি করে তারাও তখন এই প্রতিষ্ঠানের নাম বলতেই এক ধরনের স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতো। বিষয়টা ইলা প্রথম দিকে অন্যান্যদের ভিতরে খেয়াল করতো পরে তার নিজের মধ্যেও যেন এটা সংক্রামিত হয়ে গিয়েছিলো। ইলার আমেরিকার জীবন শুরুর দ্বিতীয় দিনের মাথাতেই যে দুর্বিপাকের মধ্যে পরতে হয়েছিলো সেটা যে কারো জন্যেই বিভীষিকাময় অবস্থা বলা চলে। আর ঠিক তখনই দেবীর মতো এসে হাজির হয়েছিলো উর্মিলা, অবিনাশের ফ্লাটের সোজাসুজি দোতলার বাসিন্দা। ভারতের কেরালার মানুষ, পরে ইলা বুঝেছিলো মনে প্রাণে সত্যিকারের একজন ভালো মানুষ উর্মিলা। স্বামী স্ত্রী দুজনেই সিয়ার্স এর একাউন্টস বিভাগে চাকুরী করে। কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ, বয়স হয়তো বা ইলার সমসাময়িকই হবে কিম্বা একটু বড়।
ঘটনার আকস্মিকতায় ইলার মানসিক অবস্থা তখন হিতাহিত জ্ঞানশূন্য, কি করবে ভেবে উঠতে পারছিলো না। আর ঐ মুহূর্তে অবিনাশের দিকে তাকাতেও যেন এক ধরনের ঘৃণা বোধ করছিলো ইলা। এই মানুষটার সাথে এক ছাদের নীচে বাস করতে হবে, এটা কোনভাবেই সে মেনে নিতে পারছিলো না। শুধু একটাই চিন্তা মানুষ কেমন করে এ ধরনের প্রতারণা করতে পারে? অথচ এই মানুষটার উপর ভরসা করেই সে সুন্দর একটা জীবনের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলো। কেমন যেন ওর দম বন্ধ হয়ে আসছিলো, নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য দরজা খুলে বাইরে খোলা বাতাসে এসে দাঁড়িয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। কি করবে ভেবে উঠতে পারছিলো না, মনে হলো ওর মাথাও ঠিক মতো কাজ করছে না। নিজের আপনজন বলতেও কেউ নেই এ শহরে, কার কাছে যাবে অজানা এ বিশাল শহরে কাউকেই তো সে চিনেও না। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে একসময় ক্লান্ত হয়ে দোতলায় উঠার সিঁড়িতেই বসে পরলো, অবিনাশের সামনেও যেতে মন চাইছিলো না। অনাকাংখিত ঘটনায় প্রায় বাকরুদ্ধ অবস্থা অবিনাশেরও। ইলা যেভাবে আচরণ শুরু করেছে তাতে এ্যাপার্টমেন্টের কোন বাসিন্দা যদি পুলিশকে জানায়, নির্ঘাত ‘ডোমেষ্টিক ভায়োলেন্সের’ কারণে ওকে জেলে যেতে হবে উপরন্তু সেই সাথে চাকুরীসহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও সমস্যার সৃষ্টি হবে। চিন্তা করে ভিতরে ভিতরে ভয়ে প্রায় নির্বাক হয়ে গেছে, নিজেকে সম্পূর্ণ অসহায় মনে হলো অবিনাশের।
বাইরে ইলা’কে সিঁড়িতে বসে থাকা দেখে উর্মিলা অবাকই হলো, এই ঠান্ডা আবহাওয়ায় অপরিচিত এক মহিলাকে এভাবে সিঁড়িতে বসে থাকতে দেখে থমকে দাঁড়ালো। কে হতে পারে চিনে উঠতেও পারলো না, প্রথমে নিজের কেউ হতে পারে ভেবেছিলো কিন্তু তা তো না। ইলার কাছে অবিনাশের নাম জানার পর খানিকটা চিন্তা করলো আর যখন শুনলো ঢাকা থেকে এসেছে কিছু একটা সন্দেহ করলো। ইলার ক্লান্ত উদ্ভ্রান্ত চেহারা দেখে বোধ হয় মায়াই হলো, ভদ্রতার খাতিরে বিষয়টা খতিয়ে দেখতে অবিনাশের ঘরে ঢুকলো। ভাবলো বিষয়টায় পরিষ্কার হওয়া দরকার। ভয় হলো এধরনের ঘটনা পুলিশের কানে পৌঁছালে সবাইকে নিয়েই টানাটানি শুরু হয়ে যেতে পারে, সেটা উর্মিলা এ দেশে দীর্ঘদিন বাস করে ভালো করেই জানে। মোটামুটি অবিনাশের বৈবাহিক জীবনের ঘটনা এই বিল্ডিং এর কয়েকটা পরিবার আগে থেকেই জানতো। তাছাড়া ওর সাবেক স্ত্রী ও সন্তানকে সবাই আগে এই বাসাতেই দেখেছে। এ ধরনের ঘটনা এ দেশে বলা চলে যেন অনেকটাই নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। এখানে ব্যাক্তি স্বাধীনতার উপরে কেউ কারো উপর জোর খাটাত পারে না আর সেটা এ দেশের সমাজ ব্যাবস্থাও অনুমোদন দেয় না। আঠারো বছর হয়ে গেলে সন্তান সন্ততিরাও ইচ্ছা করলে আলাদা থাকতে পারে।
অবিনাশের অনুরোধ ছাড়াও উর্মিলা নিজে থেকেও ইলার অসহায়ত্ব দেখে ওকে তার নিজের বাসায় নিয়ে গেল। পরিস্থিতি সামলে নিতে যে কিছুটা সময় দরকার সেটা ইলাসহ সবাই বুঝেছে, আর যেটা ঘটে গেছে সেটার জন্যও তো একটা সমাধানে আসা দরকার। কয়েকটা দিনের জন্যে হলেও আপাততঃ মাথা গোঁজার একটা ব্যাবস্থা হলো ইলার, ভেবে কিছুটা হলেও চিন্তা মুক্ত হলো অবিনাশ। ভাবলো দেশের সবাই তো এখনো জানে ওরা দুজন এক সাথেই আছে। অবিনাশের স্ত্রী হিসেবে ইলা এ দেশে ঢুকেছে এবং বাস্তবতা হলো কাগজে কলমেও সে অবিনাশের বৈধ স্ত্রী তাই আইনগত ভাবেই ভালো মন্দ দেখ ভালের সম্পূর্ণ বিষয়টা এখন তো ও তার উপরেই। বিয়ের সমস্ত কাগজপত্র অনুসারেই ইলা আমেরিকায় আসার ভিসা পেয়েছে এবং খুব তাড়াতাড়িই গ্রীন কার্ড ও সোশাল সিকিউরিটি কার্ড পেয়ে যাবে আর তখন তো সে বৈধভাবে চাকুরীও করতে পারবে। তাছাড়া সময়মতো নাগরিকত্বও পেয়ে যাবে আর সেটা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। সভ্য দেশের আইন কানুন খুবই মারাত্মক সেটা অবিনাশ খুব ভালো করেই জেনে গেছে ক’বছর বিদেশে থেকে।
কয়েকবার ইলাকে বোঝাতে এসে ওর মুখের চেহারা দেখে আর সামনেই দাঁড়াতে সাহস করে নাই। বোঝানো দূরে থাক কয়েকবার শুধুমাত্র সরিটুকুই বলতে পেরেছিলো এর বেশি দ্বিতীয় শব্দটিও সে উচ্চারণ করতে পারে নাই। বড় বিষয়টা হলো ওরা দুজন পারিবারিক দিক দিয়ে ঘনিষ্ট, একই পরিবারের মতোই বলা চলে। কিন্তু একটা ঘটনা কত দূরে সরিয়ে দিলো দুজনকে! উর্মিলা যথেষ্ট বুদ্ধিমতী পরিস্থিতি বুঝে ফেলেছে, ইলার জন্য যেমন অবিনাশের প্রয়োজন ঠিক তেমনি অবিনাশের বেলাতেও তাই। সামগ্রিকভাবে ঊর্মিলাই যে এই মুহূর্তে বিরাট একটা ভূমিকা নিতে পারে সেটা বুঝতে অবিনাশের বেশি দেরী হলো না। তাই সহজভাবে সব ঘটনা বুঝিয়ে বলাতে উর্মিলার কাছে সব কিছু পরিস্কার হয়ে গেলো। নিতান্তই রক্ষনশীল পরিবারের মানুষ বলেই ইলা এটা মেনে নিতে পারছে না – সেটাও উর্মিলার কাছে পরিস্কার হলো।
দুই দিনের মাথায় একমাত্র উর্মিলার জন্যেই সিয়ার্সের সেলস্ এ চাকুরী হয়ে গেল ইলার আর চাকরির সাতদিনের মাথায় অফিসের কাছাকাছি থাকার জন্য একটা ডরমেটরীর ব্যাবস্থাও উর্মিলাই করে দিল। এ সমস্ত বিষয়ে ভাগ্য মনে হয় কিছুটা সুপ্রসন্নই হয়েছে ইলার এই বিপর্যস্ত মুহূর্তে। কেন যেন উর্মিলাকে এই সময়ের সবচেয়ে আপন মনে হলো, অথচ দুদিন আগেও ও কেউ কাউকেই চিনতো না। এক ছুটির দিনে ইলা পুরো ঘটনাটা লিখে জানালো শাহেদকে। পুরো চিঠিটা বলা যায় এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেল্লো শাহেদ, কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকলো। বিশাল একটা চিন্তা যেন মাথা থেকে নেমে গেলো। শাহেদ চোখ বন্ধ করে ইলার মুখটা দেখতে চেষ্টা করলো, দেখলো লাল ইট সুরকি বিছানো কলেজ যাওয়ার পথের সেই ঘন ঝাউ গাছটার নীচে দাঁড়িয়ে আছে, পিছনে তাকিয়ে কাকে যেন খুঁজছে!
মনে হলো বিশাল এই পৃথিবীতে কেউ-ই একা না, পথে নামলে পথই তো নতুন পথের সন্ধান এনে দেয়। পথের বন্ধুই তো সত্যিকারের বন্ধু, পরীক্ষিত আপনজন। (চলবে)
ইউসুফ কামাল : লেখক, হিউস্টন, টেক্সাস, ইউএসএ