ইউসুফ কামাল : ছয়.
ইলার প্রচন্ড মানসিক জোরের কাছে পরাজিত হয়ে সরে গেছে অবনিশ, আত্মীয়স্বজন কেউই তার পক্ষে দাঁড়ায়নি। বিষয়টার একটা মনস্তাত্তিক ব্যাপার আছে যা সবার কাছে গ্রহণীয় হবে না এটাই স্বাভাবিক। অবনিশ যা করেছে তা তার অস্তিত্বের রক্ষার কারণে করেছে যেটা বহু মানুষ করে এটাও ঠিক কিন্তু বড় ভুল সে করেছে ইলাকে বিষয়টা জানতে না দিয়ে, ভেবেছে সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। ইলা সরে গেছে তার একান্ত আপন ভূবনে নিজস্ব ধ্যান ধারণার আলোকে, অবিনাশের উপর অবিশ্বাসের কালিমা লেপন করে। আর ঘটে যাওয়া ঘটনা যা ঘটে গেছে তা থেকে বের হয়ে আসা অবিনাশের পক্ষে আর সম্ভব না বুঝেই চুপ করে থাকা ছাড়া অবিনাশের পক্ষে আর কিছুই করার ছিলো না। ছোট পরিবার শাহেদদের, সংসারে মা ছাড়া আর আপন কেউ নেই। এক মামা সব বিষয়ে অভিভাবক এর মত সব বিষয়ে সাহায্য করে যাচ্ছে। বাবার সম্পত্তি থেকে যা আসে তা দিয়ে খুব ভালো মতো সংসার চলে যায়। পরিবারে কোন অভাববোধ বা অন্য কোন পারিবারিক চাপ বা সমস্যা না থাকায় শাহেদ খুব ধীর স্থিরভাবে চিন্তা ভাবনা করেই পা ফেলে। সুপিরিয়র সার্ভিস পরীক্ষায় বেশ ভালো রেজাল্ট করে নিজের দেওয়া পছন্দ মতো পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেয়। সাভারের প্রশিক্ষণ একাডেমীর কোর্স শেষ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জুনিয়র কর্মকর্তা হিসাবে চাকুরী জীবন শুরু করে। জীবনের সর্ব ক্ষেত্রে যে প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে হয় তা বোধ করি ও জীবনের প্রথম ভাগেই বুঝে ফেলছিলো আর তাইতো আর থমকে দাঁড়াতে হয়নি কখনোই। আর শূন্যতার অভিজ্ঞতাটা বোধকরি ইলার প্রথম চলে যাওয়া দিয়েই শুরু হয়েছিলো। কারো চলে যাওয়ায় চারিদিক যে শূন্যতায় ছেয়ে যায় সেই উপলব্ধিটা ছিলো তার জীবনের প্রথম ধাক্কা।
চাকুরী জীবনের শুরুতেই সাত দিনের ছুটি নিয়ে শাহেদ মা’র সাথে দেখা করতে গেল জন্মস্থান আর শৈশব থেকে বেড়ে ওঠা আপন এলাকায়। মহকুমা শহরের ছোট্ট শান্ত শহরটা ওর এত প্রিয় যে মনে হয় প্রতিটি মানুষ ওর আপনজন। ছুটি শেষের দিকে এক বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে ভাবলো ইলা’দের সেই বাসাটা কেমন আছে একটু দেখে আসি। ঐ বাসার পাশ দিয়েই তো রোজ কলেজে যেতাম, কতো স্মৃতি জড়িয়ে আছে এলাকা আর পথটায়। হাঁটতে শুরু করলো একাই, খেয়াল করলো শহরে এখন প্রচুর রিক্সা চলাচল করে আগের মতো না। কয়েকটা রিক্সাকে সে ফিরিয়েও দিলো, হেঁটে হেঁটে ধীরে সুস্থে সব কিছু দেখার জন্যে। পুরনো আমলের সরকারি একতলা লাল রংয়ের বিল্ডিং, সেই রকমই তো আছে। বিল্ডিংটার সামনের বাগানের এক পাশে সেই বাদামী গাছটা তেমনি ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। মনে আছে মওসুমে প্রচুর বাদামী হতো গাছটায়, গাছটা ভরে বাদামী ঝুলে থাকতো। কতগুলো দিন পার হয়ে গেছে তবু ওর মনে হলো এই তো সেদিনের কথা। বাড়ির দক্ষিণের সেই জানালাটা ভালো করে তাকিয়ে দেখলো, ভাবলো ঘরের ভেতর থেকে এই জানালা দিয়েই তো ইলা রাস্তার দিয়ে মানুষের যাওয়া আসা দেখতো। সামনের রাস্তাটা জানালার ঠিক বিপরীত দিকে, রাস্তাটা সোজা হওয়ায় বেশ অনেকটা দুর থেকে আসা যাওয়ারত মানুষ দেখা যেত। আর তাই কখন নিজে বেরোবে সেটা ঠিক করতো জানালা দিয়ে দূর থেকে শাহেদকে দেখার পরেই।
অপেক্ষার প্রহর পার হলেই তবে রওয়ানা হতো একটু আগে আগে। শাহেদের ভাবনায় এই সময়ের হিসেবটা মিলে যাওয়ার রহস্যটা পরে ইলাই একদিন খুলে বলেছিলো হাসতে হাসতে। বড় আপন মনে হলো জানালাটা শাহেদের কাছে, ভাবলো সবই ঠিক আছে এতগুলো বছর পার হয়ে যাওয়ার পরও শুধু জানালার ভিতরের মানুষটা ছাড়া। সাত সমদ্দুর পাড়ি দেওয়া তেপান্তরের এক দেশে পড়ে আছে নিঃসঙ্গ বড় একাকী, ভাবতেই ওর মনটা কষ্টে ভরে গেলো। খুব দেখতে করলো ইলা’কে শাহেদের সেই মুহূর্তে। সেই চেনা পথের দুপাশের ঘরবাড়ির শেষে বড় একটা খেলার মাঠ আর সেটার ডান দিকের ইটের খোয়া বিছানো পথ দিয়ে যেতে হতো কলেজে। তাকিয়ে দেখলো লম্বা বড় ঝাউ গাছটা এখনো দাঁড়িয়ে আছে মাথা উঁচু করে। ঝাউ গাছের নীচে দাঁড়ালে একটা শো শো শব্দ শোনা যেতো, মনে হতো যেন ঝড় উঠে আসছে।
যেদিন প্রথম শব্দটা শুনেছিলো অবাক বিস্ময়ে গাছের সরু ঝাকড়া চুলের মতোন লম্বা ধরনের পাতাগুলোর দিকে তাকিয়ে ভেবেছিলো কেন এমন হয়? শাহেদের মনে পড়লো ঝাউ গাছটার নীচে এলেই কেন যেন ওদের সময়ের প্রচন্ড সাড়া তোলা পিন্টু’র গানটা মনে পড়ে যেতো –
চলো না দীঘার সৈকত ছেড়ে
ঝাউবনের ছায়ায় ছায়ায়
শুরু হোক পথ চলা শুরু হোক কথা হলা \
ঠিক এই ঝাউ গাছটার নীচ দিয়ে পার হবার সময়টায় ইলা ঘাড় ঘুড়িয়ে একবার পিছনে তাকাতো। এটা কেন যেন একটা রুটিনের মতো হয়ে গিয়েছিলো, আর এর সাথে উপরি হিসেবে যোগ হয়েছিল একটা হাসি। বিষয়টা একদিন কলেজ থেকে ফেরার পথে ওকে জিজ্ঞেস এ করেছিলো কেন এটা করো? হেসে উত্তর দিয়েছিলো তাতো জানি না, তবে হয়তো অভ্যাসই হয়ে গেছে বলতে পারো। অনিচ্ছা সত্বেও শুধুমাত্র পরিবারের চাপেই ও এই বিয়েতে রাজী হয়েছিলো। এত কিছুর পর অবিনাশের ঘটনাটা শোনার পর নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে নি সংবেদনশীল ঐ মানুষটা। যে কিনা একসময় পরিবারের কথার অবাধ্য হয়নি, এমনকি নিজের পছন্দ আপনজনকেও এক পাশে সরিয়ে দিতে কুন্ঠা বোধ করেনি। আর তাই তো খুব স্বাভাবিক কারণেই অবিনাশের প্রতি ঘৃণাটাও বেশি হয়েছে ওর। মানুষটার এসব বিষয়গুলো এত বেশি গোপন করার কি খুব বেশি দরকার ছিলো? নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য অনেকেই এটা করে বলে ও আগেও শুনেছিলো, তাই বলে পরিবারের মধ্যে গোপন করতে হবে কেন? ওর নিজের অভিভাবকরা অর্থাৎ বাবা মা’ই বা কেন ওর কাছে এত সব গোপন করলো, ভাবতেই ওনাদের প্রতিও ওর মনটা বিষিয়ে উঠলো।
অবিনাশ হয়তো ভেবেছিলো মফস্বল শহরে থাকা দেশের একটা মেয়ে কি এগুলো বিষয় বুঝবে? আর অবিনাশের ভুলটাও এখানেই হয়েছে মানুষ চিনতে সে ভুল করেছে। স্বাধীনচেতা ঐ মানুষটার সম্মন্ধে তার কোন ধারণাই ছিলো না। নিজের পছন্দ অপছন্দের বিষয়ে আপোষহীনভাবে অত্যন্ত শক্ত অবস্থান বেছে নেওয়ার অপরিসীম ক্ষমতা ছিলো ইলার। নিজের ভালো মন্দের হিসেবটা সব সময় নিজেকেই বুঝে নিতে হয়, আর এতে তার নিজের যুক্তি হলো- সবশেষে সিকুয়েন্সটা তো আমাকেই নিতে হবে! পক্ষে হোক বা বিপক্ষে যাক্।
হাঁটতে হাঁটতে কলেজের মাঠের এক কোণায় এসে দাঁড়ালো শাহেদ, সামনেই তিন তলা দুইটা বড় বড় বিল্ডিং সম্ভবতঃ নতুন হয়েছে আগে তো ছিলো না। এক পাশে ছেলেদের কমনরুম, বাইরে থেকেই দেখা যাচ্ছে ভিতরে টেবিল টেনিসের টেবিল। প্রশস্ত বারান্দা ওয়ালা লম্বা একটা হল রুম। এগিয়ে গেলো আরো একটু সামনে, হাত দিয়ে স্পর্শ করলো বারান্দার গ্রীল যা আগে ছিলো না। গ্রীলের ভিতরে দেখা যাচ্ছে একটা স্বরস্বতী দেবীর মূর্তি। ভাবলো তাহলে এখন স্বরস্বতীর পূজোর সময়, পুজো হয়ে গেছে হয়তো তাড়াতাড়ি মূর্তিটা এখান থেকে সরিয়ে ফেলা হবে। আশে পাশে তাকালো চারিদিকে শুনশান নিরবতা, একাকী। পড়ন্ত বিকেল, নিজের থেকেই যেন ফিরে যাওয়ার একটা তাড়া অনুভব করলো। ঘুরে দাঁড়াতেই নজরে পড়লো ‘গরদ’এর লালপেড়ে শাড়ী পড়া ফর্সা একজন অল্প বয়েসী নারী এগিয়ে আসছে ওর দিকে। থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো শাহেদ, নিজেকে ওর কেন যেন ফেলে আসা শাহেদ বলেই মনে হলো। এগিয়ে এসে ডান হাতে ধরা কাগজে মোড়ানো কিছু একটা ওর দিকে এগিয়ে দিলো, হতভম্বের মতন শাহেদ হাত বাড়িয়ে নিলো। কিছু না বুঝতেই যেন ঘটনাটা ঘটে গেল, আশেপাশে তখন যেন ছেলেমেয়েরা ঘুরে বেড়াচ্ছে।
কেউ এক ক্লাস থেকে অন্য ক্লাসে যাচ্ছে, সবাই যার যার কাজে ব্যাস্ত। দল বেঁধে ছাত্রীরা কমনরুম থেকে স্যারের পিছন পিছন ক্লাসে যাচ্ছে। গরদের শাড়ী পরিহিতা ইলাও যেন ছাত্রীদের সাথে মিশে স্যারের পিছন পিছন ক্লাসে চলে গেলো। আস্তে আস্তে কয়েক পা সড়ে এলো শাহেদ, সযত্নে কাগজে মোড়ানো জিনিষটা খুলে ধরলো চোখের সামনে, একটা লাড্ডু। শাহেদ বুঝলো স্বরস্বতী পুজার শেষে মিষ্টি বিতরণ করা হয়, ইলা তার অংশেরটা শাহেদের জন্য রেখে দিয়েছিলো। ঘটনাটা মনে করে শাহেদ কিছুক্ষণ পাথরের মত দাঁড়িয়ে রইল নির্জন মাঠের মাঝখানে। স্মৃতি কি কখনো কাউকে একা হতে দেয়? হয়তো দেয় অথবা দেয় না তবে এটা ঠিক এর সব ুকুই দুখের নয় কিছুটা আবার আনন্দেরও। (চলবে)
ইউসুফ কামাল : লেখক, হিউস্টন, টেক্সাস, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র