হাসান জাহিদ : কথাশিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিৎসু ক্যানভাস।
পুরো নাম গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ। তিনি ‘গাবো’ নামেও পরিচিত। ১৭ এপ্রিল, ২০১৪ বিংশ শতকের শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক বিশ্বসেরা গল্পকথক নোবেল বিজয়ী গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ চিরবিদায় নিলেন। ১৯৮২ সালে তাঁর ‘ওয়ান হানড্রেড ইয়ার্স অব সলিচ্যুড’ বা ‘শত বছরের নিঃসঙ্গতা’ উপন্যাসের জন্য তিনি নোবেল পুরস্কার পান। এ উপন্যাসটির আড়াই কোটি কপি বিক্রি হয় এবং বাংলা, ইংরেজিসহ ২৫টি ভাষায় অনূদিত হয়। উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ১৯৬৭ সালে। একটি পরিবারের ঐতিহ্য ও রোজনামচাকে ঘিরে উপন্যাসের বিভিন্ন চরিত্র গড়ে ওঠে জাদুবাস্তবীয় আদলে।
মার্কেজ একাধারে সাহিত্যিক, সাংবাদিক, প্রকাশক ও রাজনীতিবিদ ছিলেন। তিনি ছিলেন দক্ষিণ আমেরিকার সবচাইতে বেশি আলোচিত ও পঠিত কথাসাহিত্যিক, নিজস্ব ঘরানার জাদুবাস্তবতা ছিল যার লেখার অন্যতম হাতিয়ার। তিনি হোর্হে লুইস বোর্হেস (আর্জেন্টিনীয় সাহিত্যিক, বিংশ শতাব্দীর প্রভাবশালী লেখকদের মাঝে একজন) এবং হুলিও কোর্তাজারের (লাতিন সাহিত্যের একজন অন্যতম জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক, ছোটো গল্পকার ও প্রাবন্ধিক) সাথে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ দক্ষিণ আমেরিকান কথাসাহিত্যিক।
ঔপনিবেশিক এবং নব্য ঔপনিবেশিক সামাজিক বাস্তবতা, শোষণ-নির্যাতন, বৈষম্য এবং লাতিন আমেরিকার বিপর্যস্ত অর্থনৈতিক চিত্র মানবিক দলিল হিসেবে উঠে এসেছে তার গল্প-উপন্যাসে। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক বৈরী স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে লাতিন আমেরিকার যে কয়েকজন সাহিত্যিক বিশ্বখ্যাতি অর্জন করেছেন মার্কেজ তাদের অন্যতম। তার গল্প বলার ভঙ্গি প্রায় ঐশ্বরিক পর্যায়ের। বাস্তবতা আর কল্পনার মিশেল করে তিনি তার লেখার মধ্যে এমন এক মায়াবী স্বপ্নজাল বিস্তার করেছেন, যা পাঠককে একদিকে যেমন এক জাতীয় দ্যোতনার মধ্য দিয়ে টেনে নেয় বিস্ময়ের রাজ্যে, অন্যদিকে তারা অনায়াসে স্বাদ লাভ করেন এক অভূতপূর্ব নির্মাণশৈলীর। স্বপ্ন, বাস্তব আর নিঃসঙ্গতার জাদুবাস্তবময় ছায়াতপের গল্পে তিনি পাঠককে আবিষ্ট করে রাখতে পারেন।
তার অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হচ্ছে ‘লাভ ইন দ্যা টাইম অব কলেরা,’ ‘নো ওয়ান রাইটস টু কর্নেল,’ ‘ইনোসেন্ট এরেন্দিরা অ্যান্ড আদার স্টোরিজ,’ প্রভৃতি।
তার জন্ম ১৯২৮ সালের ৬ মার্চ কলম্বিয়ার কলা-উৎপাদক শহর আরাকাতাকায়। তবে তিনি জীবনের বেশিরভাগ সময় বসবাস করেছেন মেক্সিকো এবং ইয়োরোপের বিভিন্ন শহরে।
যদিও তিনি সর্বাধিক পরিচিত ‘শত বছরের নিঃসঙ্গতা’ বইটির জন্য, প্রকৃতপক্ষে তার সবক’টি বই-ই সুখপাঠ্য, পাঠক আদৃত ও সাড়াজাগানো। বস্তুত, গার্সিয়া মার্কেজের মতো লেখক যে ধারায় উপন্যাস লিখেছেন আর জাদুবাস্তবতার যে মোহময় জগত সৃষ্টি করেছেন, সেটা বিগত সব সময়কালকে যেন অতিক্রম করে গেছে।
আমার সৌভাগ্য হয়েছে ‘ওয়ান হানড্রেড ইয়ার্স অব সলিচ্যুড,’ ‘নো ওয়ান রাইটস টু কর্নেল’ ‘ইনোসেন্ট এরেন্দিরা অ্যান্ড আদার স্টোরিজ’ বইগুলো পড়ার। এগুলো আমি পড়েছিলাম আশির দশকের শেষার্ধে। সেই দশকের গোড়া থেকেই জাদুবাস্তবতার ওপর আলোচনা, জাদুবাস্তবতা পাঠ, গবেষণা, এমনকি লেখালেখি বিস্তার লাভ করে। এইসব কর্মকাণ্ডের অংশীদার আমিও ছিলাম। তখন লিটল ম্যাগাজিনে ও পত্রিকার সাহিত্য পাতায় দুয়েকটি গল্প প্রকাশ করেছিলাম জাদুবাস্তবতার অবয়বে। গল্পগুলো হয়তো জাদুবাস্তবীয় পরিপক্কতা পায়নি; কিন্তু সেসব ছিল যুগমানসের প্রতিফলন। পরবর্তীতে জাদুবাস্তবের ওপর কিছু পড়াশোনা ও লেখালেখি করেছিলাম। ফলশ্রুতিতে ২০১৪ সালের একুশে বইমেলায় ‘জাদুবাস্তবের পদাবলি’ নামে গল্পগ্রন্থ প্রকাশ করেছিলাম।
মার্কেজ শুধু নোবেল প্রাপ্তিতেই যে বিশ্বজুড়ে আলোচিত একজন, তা কিন্তু নয়। তার কৃতিত্ব, বিগত চার দশকেরও অধিক সময় তিনি পৃথিবীর মানুষকে মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছিলেন তার জাদুকরি লেখনির মাধ্যমে। নোবেলজয়ী পেরুর মারিও ভার্গাস য়োসা ছাড়া এত দাপট সম্ভবত আর কোনো লাতিন আমেরিকান কথাসাহিত্যিকের নেই।
এই জাদুকর তার নোবেল ভাষণে বলেছিলেন- ‘বাস্তব আর অবাস্তবের মধ্যে কোনো সীমারেখা নেই। সমগ্র লাতিন আমেরিকার বাস্তবতা থেকেই জন্ম নিয়েছে জাদুবাস্তবতা। ইয়োরোপীয়রা আমার বই পছন্দ করেন আমার রচনায় ম্যাজিক ও ফ্যান্টাসি দেখতে পান বলেই। কিন্তু আমার রচনা আসলে নিত্যদিনের বাস্তবতা। সরল আর নিষ্পাপ চোখে বাস্তবতার দিকে সোজাসুজি দেখা। ম্যাজিক রিয়েলিজম মানে আমাদের বাস্তবতার ভেতরকার অলৌকিকতা। ইয়োরোপীয়রা যতটা যুক্তিবাদী সে অর্থে আমাদের মন-মানসিকতা ঠিক ততটা যুক্তিবাদী নয়, হওয়া সম্ভবও নয়। আমরা যেভাবে আমাদের বাস্তবতাকে প্রকাশ করি, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করি, যুক্তিবাদীদের পক্ষে সেটাকে ঠিক সেভাবে বোঝা বা উপলব্ধি করা কঠিন। লাতিন আমেরিকানদের দেখলে মনে হবে, তারা অর্ধেক স্বপ্ন আর অর্ধেক দুর্নীতির ভেতর জীবন কাটায়।’
গার্সিয়া মার্কেজের তিরোধানের সংবাদ শুুনে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছিলেন, ‘বিশ্ব এক মহান স্বপ্নদর্শীকে হারাল আর আমি হারালাম তারুণ্য থেকেই প্রিয় হয়ে ওঠা লেখককে।’
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন বলেছিলেন, ‘আমি সবসময়ই তার কল্পনা শক্তি, স্পষ্টতা, চিন্তাভাবনা এবং আবেগী সততায় মুগ্ধ হতাম। তার বন্ধু হতে পেরে আমি অত্যন্ত সম্মানিত বোধ করছিলাম এবং বিশ বছরের বেশি সময় তার বিশাল হৃদয় আর মেধাবী মনের পরিচয় পেয়ে আসছিলাম।’
মার্কেজের অন্তর্ধানে গোটা বিশ্ব হারাল এক শ্রেষ্ঠ সন্তানকে। তিনি চলে গেলেও তার ছায়া থেকে যাবে আমাদের অন্তরে।