বিদ্যুৎ সরকার : আকাশ মেঘলা হলে ওর ভীষণ ভাল লাগে। জানালার শিক ধরে তাকিয়ে থাকে আকাশ পানে কখন বৃষ্টি আসবে? একটু ঠান্ডা বাতাস বইতে শুরু করে দিলে মন-প্রাণ জুড়িয়ে যায়। তখন ভাবতে ভাল লাগে এই বুঝি বৃষ্টি এসে গেল। টিপ টিপ বৃষ্টি, এর পরই রিম ঝিম বৃষ্টি। গাছের ডালে টিনের চালে কি দারুন মন উদাস করা বৃষ্টি আর ঘুম পারানিয়া মধুর শব্দ। এইতো এমাত্র এক পশলা বৃষ্টি টিপ টিপের চিবুক ছুঁয়ে গেল, আলতো করে ভিজিয়ে দিল। বড় আবেশে চোখ বুজে আসে তার। মাঝে মাঝে ওর ইচ্ছে জাগে সারাদিন কেন এমন করে অঝোরে বৃষ্টি ঝরে না! মেঘেরা কেন একটু সদয় হয় না, ওর মন বুঝতে চায় না একটি বারও? বর্ষারওতো বৃষ্টি অনেক প্রিয়। বৃষ্টিতে ভিজতে ওর ভীষণ ভাল লাগে। বর্ষা যে আজ কোথায় হারিয়ে গেল কিছু না বলে! মাঝে মাঝেই সে অমন করে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। বৃষ্টির দিনের অলস দুপুরগুলো কেন যে আরো অলস হয়ে আসে না বার বার, স্থির হয়ে থাকে না বৃষ্টি গায়ে মেখে দিন ভর। অনেক সময় ধরে তার সাথে খুনসুটি চলতো বর্ষার আর টিপ টিপের। বৃষ্টির কীসের এত তারা এসেই বলে যাই? এলেই যখন, একটু না হয় দেরি করলে, তাতে কী এমন ক্ষতি হবে শুনি!
টিপ টিপ এখনও উদাস হয়ে তাকিয়ে আছে মস্ত আকাশটার গভীরে। মাঝে মাঝে ওর ইচ্ছে জাগে এমন বৃষ্টির দিনগুলোতে পাখি হয়ে উড়তে। কখনো একটি শালিক অথবা একটি দার কাক কিংবা অন্তত একটি হুতুম পেচা। এমন বাদল দিনে বৃষ্টির জলে পাখা ঝাপটিয়ে কী দারুন সুখে স্নান করে শালিকেরা। আর, দার কাকেরা বৃষ্টি ভেজা হয়ে গাছের ডালে বা সান শেডে বসে থাকে রোদ উঠার প্রত্যাশায়। হুতুম পেচারা বসে বসে ঝিমুয় কখন রাত হবে, একটা – দুটো ইঁদুর আসবে ভাল লাগার বর্তা বয়ে নিয়ে।
পাখিরা সবসময়ই সুখী। ইচ্ছে হলেই উড়ে বেড়ায় এক আকাশ থেকে অন্য এক আকাশে, এক সবুজ বনভূমি ছেড়ে দূর কোন বনভূমিতে। পাখার পালকে যেমন বৃষ্টি ঝরে সেঁত সেঁতে হয় তেমনি, সোনালী রোদের আভায় কেমন জ্বল জ্বলে উজ্জ্বল হোয়ে উঠে দিনের আলোয়। পাখিদের কোন সীমারেখা নেই, নেই কোন নির্দিষ্ট নো-ম্যান্স ল্যান্ড। আস্ত আকাশটাই যেন তার এক বিশাল বাড়ি। কোথাও উড়ে যেতে নেই মানা। শুধু ঝড়ের দিনগুলো ওদের জন্য কখনো কখনো বিপদ সংকেত বয়ে নিয়ে আসে। তবুও আমি পাখি হতে চাই সবুজ বনের পাখি, নীল আকাশের পাখি, বৃষ্টি ভেজা পাখি।
বর্ষাদের ঘরের চাল ঘেষে একটি রয়েল গাছের ডাল। রয়েল পাকার সময় হলে দুনিয়ার যতশত পাখি এসে ভিড় করে এ গাছের শাখা-প্রশাখায়। থোকায় থোকায় ঝুলে থাকা পাকা রয়েল ঠুকরে ঠুকরে মুখে পুড়ে নেয়। ঠোঁটের আঘাতে বাকি পাকা রয়েলগুলো নিচে ঝরে পড়ে তখন টিপ টিপ ও ওর বন্ধুরা দৌড়ে গিয়ে কুড়িয়ে নেয়। ঝরের সময়ও বাতাসে কাচা-পাকা অনেক রয়েল ঝরে পড়ে। বর্ষা ও টিপ টিপের প্রিয় ঝর বাদলের দিনগুলো। আম, রয়েল, জাম কুড়ানোর অনাবিল সুখ। বৃষ্টির দিনগুলোতে গুরু গুরু মেঘর ডাক, কালো মেঘের আড়ালে বিদ্যুত চমক আর টিনের চালে রিম ঝিম বৃষ্টির শব্দ – এসব কিছু বাদল দিনের চরম ভাল লাগার বিষয় – আসয়। আর বর্ষার দিনের বিশেষ আকর্ষণ হলো মিতুদি’র গল্প বলার আসর। সে এক অনাবিল সুখের মুহূর্তরা শুধুই দোলা দিয়ে যায় প্রাণ থেকে প্রাণে, মন থেকে অন্তরে। টিপ টিপ, বর্ষা ও ও’দের বন্ধুরা মিতুদি’র এ গল্পের আসরের প্রথম সারির ক্ষুদে শ্রোতা। তাই বাদল দিনের সময়গুলো ছোটদের জন্য প্রিয় ও মধুময় হয়ে উঠে আপন বৈভবে। মিতুদি তাদের কাছে এক সুখের নাম, আনন্দের ফল্গুধারা। এ সব গল্প বলার আসরগুলো আরও সুখময় হয়ে উঠতো মুড়িমাখা, চিড়ে ভাজাসহ নানান আচারের সুনিপুণ আয়োজনে। সেই গল্প বলার মিতুদি একদিন চিরতরে হারিয়ে গেল টিপে টিপ, বর্ষা ও তাদের বন্ধুদের কাছ থেকে। গল্প বলার মিতুদি আর এখনকার মিতুদি আসমান-জমিন ফারাক। কথা বলার শক্তিটুকু হারিয়ে ফেলেছে সে। কত ডাক্তার-কবিরাজ দেখানো হলো কোন কিছুতেই কিছু হলো না তার। ডাক্তার স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন কোন দিনই মিতুদি কথা বলার ন্যুনতম ক্ষমতাটুকু আর ফিরে পাবে না। সামান্য জ্বরের পরিণাম যে এতো ভয়ংকর হতে পারে তা ছিল ধারণার বাইরে। মিতুদি এখন শুধু ফেল ফেল করে তাকিয়ে থাকে চোখে হাজারো জিজ্ঞাসা নিয়ে। সে দুটি চোখ কথা বলে সংগোপনে অথচ, শুধু গল্প বলতেই মানা যেন! এখন বৃষ্টি আসলে মনে হয় এ বুঝি মিতুদির চোখের অশ্রু! আগের মতো মনে আনন্দ বয়ে আনে না।সুখ শোক হয়ে কেবলই ঝরে পড়ে অশ্রুর বাদল ধারায়।
বিদ্যুৎ সরকার : লেখক ও আলোকচিত্রী, টরন্টো, কানাডা