সোনা কান্তি বড়ুয়া : শুক্লা দশমীর আলোর ঝর্ণাধারায় আনন্দবাজার পত্রিকার সংবাদ, “৫ অক্টোবর, বুধবার দিল্লির অম্বেডকর ভবনে গণ ধর্মান্তরণ ছিল। বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণের সেই অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন প্রায় ১০ হাজার মানুষ। সেখানকার একটি ভিডিয়ো ভাইরাল হয়েছে। ধর্মান্তরণে উপস্থিত আপের মন্ত্রী। ধর্মান্তরণের একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে হিন্দুত্ব-বিরোধী শপথ নিয়েছেন আম আদমি পার্টির এক মন্ত্রী! অভিযোগ, রাজেন্দ্র পাল গৌতম প্রকাশ্যে বলেছেন, ‘‘আমি হিন্দু দেব-দেবীর পুজো করব না।’’ বিষয়টি নিয়ে আপের দিকে আঙুল তুলেছে বিজেপি। অভিযোগ করেছে, ‘হিন্দুত্ব-বিরোধী’ প্রচার চালাচ্ছেন কেজরীওয়াল। রাজেন্দ্র সব অভিযোগ উড়িয়ে দাবি করেছেন, বিজেপি আসলে ‘দেশ-বিরোধী, (৫ অক্টোবর, ২০২২ )!”

বুদ্ধের উপদেশ ছিল, সকল পাপকাজ থেকে বিরতি, কুশল কর্মের অনুষ্ঠান এবং আপন চিত্তশুদ্ধি- এই হল বুদ্ধদের অনুশাসন। বুদ্ধগণ বলেন- ক্ষমা ও সহিষ্ণুতা পরম তপস্যা আর নির্বাণ সর্বশ্রেষ্ঠ। পরকে আঘাত দিয়ে কেউ ভিক্ষু হতে পারে না আর পরকে কষ্ট দিয়ে কেউ শ্রমণও হতে পারে না। কারো নিন্দা করবে না, কাউকে প্রহার করবে না, প্রাতিমোক্ষ শীলসমূহে চিত্তকে সুদৃঢ় রাখবে। মিতাহারী হবে, নির্জন স্থানে বাস করবে আর সর্বদা মনকে যোগযুক্ত রাখবে- এই ছিল বুদ্ধের উপদেশ।”

কলিঙ্গ যুদ্ধে শোকাতুর সম্রাট অশোক (3RD CENTURY B.C.) বিজয়া দশমীর দিন বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করে ঘোষণা করলেন, “অসুপুত্ত পপৌত্ত মে নবম্ বিজয়ম বিজিতব্যম”। আমার পুত্র এবং প্রপৌত্ররাও কোন নতুন রাজ্য যুদ্ধবিজয় করবেনা । যদি বিজয় করতে হয় তা হবে ধম্মবিজয় (১৩ নং রক এডিক্ট)। কলিঙ্গ অনুশাসনে তিনি লিখেছিলেন, “সকল মানুষই আমার পুত্রতুল্য। আমার পুত্রেরা সকল মঙ্গল ও সুখের অধিকারী হোক। মানুষ ও পশুর জন্য দাতব্য চিকিৎসালয়, বিশ্রাম গৃহ, ঔষধি ফলমূল, লতাগুল্ম রোপণ, পানীয় জল ও কৃষিকার্যের জন্য সরোবর খনন শিক্ষার জন্য বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণ এবং এগুলিকে সুচারু রূপে পরিচালনার জন্য তৈরি করলেন বুদ্ধবিহার। তিনি ৮৪ হাজার জনকল্যাণকারী প্রতিষ্ঠান তৈরি করে সমস্ত জীব জগতের জন্য উৎসর্গ করলেন। কালজয়ী ধম্ম প্রচারকদের প্রেরিত করলেন সমগ্র বিশ্বে। মানব মনে প্রেম, ভক্তি, দয়া, করুণা স্থাপন করে সিঞ্চিত করলেন ভগবান বুদ্ধের চিরন্তন বাণী বসুধৈবকুটুম্বকম। দ্বিতীয় গিরিলিপিতে সমস্ত সত্তার সার্বিক কল্যাণের জন্য উৎকীর্ণ করলেন তার ধম্মানুভূতি।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৯৫ সালের ৫ অক্টোবর একটি চিঠিতে (ছিন্নপত্র, ১৪৭) লিখছেন, “আমরা বাইরের শাস্ত্র থেকে যে ধর্ম্ম পাই সে কখনোই আমার ধর্ম্ম হয়ে ওঠে না। তার সঙ্গে কেবলমাত্র একটা অভ্যাসের যোগ জন্মে। ধর্ম্মকে নিজের মধ্যে উদ্ভূত করে তোলাই মানুষের চিরজীবনের সাধনা। চরম বেদনায় তাকে জন্মদান করতে হয়, নাড়ির শোণিত দিয়ে তাকে প্রাণদান করতে হয়…।” আনন্দবাজার পত্রিকার (সম্পাদকীয়, ২২ আগষ্ট, ১৯৯৩) মতে, “সেই উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা কেমন করিয়া ভুলিয়া গেলেন যে, একদা রাশি রাশি বৌদ্ধ ধর্মস্থান ধ্বংস করিয়া একদিন গড়িয়া উঠিয়াছিল রাশি রাশি হিন্দু মন্দির।” ভারতে “ধর্মহীন বিজ্ঞান খোঁড়া, বিজ্ঞানহীন ধর্ম অন্ধ।”

দিল্লির অম্বেডকর ভবনে বৌদ্ধধর্ম ত্রিসরণ এবং পঞ্চশীলের আশ্রয় নিলেন দশ হাজারের বেশি মানুষ। ভারতে শুক্লা দশমীর আলোর ঝর্ণাধারায় এক ভাব গম্ভীর পরিবেশে “৫ অক্টোবর, হিন্দু ধর্ম পরিত্যাগ করে বৌদ্ধ ধর্মে ফিরে আসলেন। এই কর্মসূচীর আয়োজন করেন আম আদমি পার্টি! ত্রিসরণ এবং পঞ্চশীলের আশ্রয় নিলেন তারা। শারদ শুক্লা দশমীর পূজায় শরতের আকাশে রোদের ঝিলিক। বুদ্ধ পূজো উপলক্ষে ভিন্ন সাজে সাজতে চিন্তার অন্ত নেই। সেই উৎসব যেন শুধু রঙিন হয়েই থাকে সেজন্য শুকসারী’র রঙিন আয়োজনে “তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল। কে যাস রে ভাটি গাঙ বাইয়া!” পথে শিউলি ফুলের ঘ্রাণই বলে দিচ্ছে, সম্রাট অশোকের শারদ শুক্লা দশমীর বুদ্ধপূজা, ও বজ্রযান (চর্যাপদ) বৌদ্ধধর্মে বোধিসত্ব তারা দেবীর পূজার সময় এসেছে।

ভারতের রাজধানী – দিল্লীতে গত ০৫. ১০. ২০২২ ইং দশ হাজারের বেশি মানুষ হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ। এক ভাব গম্ভীর পরিবেশে এই কর্মসূচীর আয়োজন করেন ব ভারতের বৌদ্ধ সমাজ – জাতীয় সভাপতি রাজরত্ন আম্বেদকর; এবং ধম্ম দিশা দান করেন জয় ভীম মিশন বৌদ্ধ ভিক্ষু। জাতীয় রক্ষক রাজেন্দ্র পাল গৌতম জীর যৌথ উদ্যোগে দশ হাজারের বেশি মানুষ হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছে। বিশেষ ধন্যবাদ: দিল্লি রাজ্য সভাপতি: সি. এস.এস. ভান্ডারী এবং রাজ্য নির্বাহী। জয়তু বুদ্ধ ,জগতের সকল প্রাণী সুখী! জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সবাইকে জানাই শুভ প্রবারণা পূর্ণিমা ও কঠিন চীবর দানোৎসবের আন্তরিক মৈত্রীময় প্রীতি, শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের মতে “ধর্মহীন বিজ্ঞান খোঁড়া, বিজ্ঞানহীন ধর্ম অন্ধ।”

বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণের অনুষ্ঠানে হাজার হাজার মানুষ প্রার্থনা ছিল, “বুদ্ধং সরণং গচ্ছামি! ভারতের জাতীয় পতাকা ও এমবেøমে বৌদ্ধধর্মের ধর্মচক্র প্রচারে বিশ্বজয়! ব্রাহ্মন ও উচ্চবর্ণের হিন্দু যেই মানব, বৌদ্ধ দলিত, মুসলমান ও সেই মানব! ব্রাহ্মণ্য ধর্মের এবং সন্ত্রাসী তুর্কি ইসলাম (বখতিয়ার খিলজি) ধর্মের সঙ্গে প্রতিদ্ব›িদ্বতায় বৌদ্ধ মুক্তিযুদ্ধে বৌদ্ধ রামাই পন্ডিতের রচিত “শূন্য পুরান” শীর্ষক বইয়ের উৎপত্তি (16th century)।

বিজয়া দশমীর দিন ১৯৫৬ সালে ১৪ অক্টোবর জাতিভেদ প্রথার ট্রাজেডি সহ্য করতে না পেরে ভারতীয় সাবেক আইন মন্ত্রী ডঃ বি. আর আম্বেদকর নিপীড়িত, নিষ্পেষিত লক্ষ লক্ষ জনতার উপস্থিতিতে বৌদ্ধধর্ম গ্রহন করেছিলেন। দলিত, নিপিড়িত, লাঞ্ছিত, শোষিত বহুজন মানুষকে সাংবিধানিক রক্ষা কবচের মাধ্যমে সুরক্ষিত করে ন্যায়, সাম্য, স্বাধীনতা ও ভ্রাতৃত্ব প্রেমের উচ্চ মার্গে উন্নীত করলেন। গ্রহণ করলেন বুদ্ধের ধর্ম, পঞ্চশীল এবং অষ্টাঙ্গিক মার্গ। এই দিনে তার প্রতি রইল আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা। ভারতের প্রাচীন ধম্ম দেশনার এই মঙ্গলময় ও কল্যাণকারী শারদ উৎসবের শেষ দিনে আপানদের সকলকে বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করছি।

ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করার উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে ভারতে ১১৯২ সালে রাজা লক্ষন সেনের মহামন্ত্রী বিশ্বাসঘাতক হলায়ুধ মিশ্র হিন্দু রাষ্ট্রধর্মের নেতা হয়ে বৌদ্ধ হত্যাযজ্ঞ করতে ‘শেখ শুভোদয়া’ শীর্ষক বই লিখেছিলেন। তিনি তাঁর রচিত দিনলিপির (ডায়েরী) উক্ত বইতে মুসলিম তুর্কী মিশনের যোদ্ধাদের সাথে মহামন্ত্রীর গোপন ষড়যন্ত্রে রাজা লক্ষণ সেনকে সরিয়ে বখতিয়ার খি লজিকে বাংলার সিংহাসন আরোহনের নীলনক্সার পুঞ্জীভূত লোমহর্ষকর বাস্তব ঘটনাবলী অকপটে রচনা করে স্বীকার করলেন। ১২০২ সালে রাজা লক্ষন সেনের মহামন্ত্রী হলায়ুধ মিশ্র বিশ্বাসঘাতকতায় বখতিয়ার খিলজির বাংলা জয়! এবং বখতিয়ার খিলজির বৌদ্ধ হত্যাযজ্ঞের জন্যে বৌদ্ধগণ মুসলমান হয়েছিলেন!

সম্রাট অশোকের বুদ্ধ বন্দনার অমর এ্যালবাম গৌতম বুদ্ধের প্রথম ধর্মচক্র উপদেশ আজ ভারতের জাতীয় পতাকার কেন্দ্রস্থলে বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারায় ২৪টি দণ্ডযুক্ত (প্রতীত্যসমূৎপাদ বা সমগ্র কার্যকারণ প্রবাহ) ঘন নীল রঙের অশোকচক্র সংবলিত ভারতীয় গেরুয়া, সাদা ও ভারতীয় সবুজ এই তিন রঙের একটি আনুভূমিক আয়তাকার পতাকা। ১৯৪৭ সালের ২২ জুলাই আয়োজিত গণপরিষদের একটি অধিবেশনে পতাকার বর্তমান নকশাটি গৃহীত হয় এবং সেই বছর ১৫ অগস্ট এটি ভারত অধিরাজ্যের সরকারি পতাকার স্বীকৃতি লাভ করে। এরপরে এটি ভারতীয় প্রজাতন্ত্রেও জাতীয় পতাকার স্বীকৃতি বজায় রাখে। ভারতে এটিকে “তেরঙা” নামে অভিহিত করা হয়। পতাকাটির নকশা প্রস্তুত করা হয়ে ছিল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের পিঙ্গালি ভেঙ্কাইয়া কৃত “স্বরাজ” পতাকার আদলে। বর্তমানে নয়া দিল্লিস্থ ভারতের রাষ্ঠ্রপতি ভবনে দরবার প্রাঙ্গনে এখন সুদীর্ঘ ধ্যানমগ্ন পূজনীয় গৌতমবুদ্ধ দিল্লির সিংহাসনে বিরাজমান, যিনি ভারতের জনগন ও শাসকবৃন্দকে আশির্বাদ করছেন। এর পাশে আছে সম্রাট অশোক হল, এখানে ভারতীয মন্ত্রীরা শপথ নেন এবং বিদেশী রাষ্ট্রদূতগণ মাননীয় রাষ্ট্রপতির নিকট তাঁদের পরিচয় পত্র পেশ করেন। সাধু সাধু সাধু।

বৌদ্ধরা কিভাবে নমঃশূদ্র হলো? ব্রাহ্মণ্যধর্মী বল্লাল সেন (In 1235 A. D.) যখন বাংলার রাজা হলো, তখন সে বৌদ্ধধর্মীদের হিন্দুধর্ম গ্রহণ করতে হুলিয়া জারি করলো। বৌদ্ধরা তা মানলো না। শুরু হলো রাষ্ট্রশক্তির বলপ্রয়োগ ও অত্যাচার। অকথিত অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে, বৌদ্ধরা জলে জঙ্গলে (পূর্ববঙ্গে) পালালো। ওদের পিছনে ধাওয়া করে হত্যা করো। (গুরুচাঁদ চরিত ষষ্ঠ সংস্করণের ২৩৮ ও ২৩৯ পৃষ্ঠা দেখুন)। ব্রাহ্মন ও উচ্চবর্ণের ভারতে রক্তাক্ত দলিত বিদ্বেষ কেন? ব্রাহ্মন ও উচ্চবর্ণের হিন্দু যেই মানব, বৌদ্ধ দলিত, রোহিঙ্গা মুসলমান ও সেই মানব (দেশ, ৪ মে ২০০১ কলিকাতা পৃষ্ঠা ১২)! ইতিহাসের আলোকে ধর্মীয় নিপীড়ন প্রতিরোধ প্রসঙ্গ প্রার্থনা ছিল, “বুদ্ধং সরণং গচ্ছামি!

ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স এন্ড ওয়ার্কশপ অন ‘চর্যাপদ! গৌহাটিতে চর্যাপদ সম্মেলনে প্রফেসর ড. সুকোমল বডুয়া’র যোগদান! বাংলাদেশ বুদ্ধিস্ট ফেডারেশনের ভারপ্রাপ্ত উপদেষ্টা চেয়ারম্যান, পালি এন্ড বুদ্ধিস্ট স্ট্যাডিজ বিভাগের সুপারনিউম্যারারি প্রফেসর, বৌদ্ধতত্ত¡বিদ ড. সুকোমল বড়ুয়া গত ৫ ও ৬ আগস্ট ২০২২ খ্রি. আসামের গৌহাটিতে অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স এন্ড ওয়ার্কশপ অন ‘চর্যাপদঃ লেংগুয়েজ, লিটারেচর এন্ড কালচার’ শীর্ষক দু’দিন ব্যাপী আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে গেস্ট অব অনার হিসেবে অংশগ্রহণ করে বিভাগে গৌরব বৃদ্ধি করেছেন। তিনি উক্ত কনফারেন্সে প্রবন্ধ পাঠ করেন এবং একটি সেশনে চেয়ার হিসেবে পদ অলংকৃত করেন। উক্ত কনফারেন্সে আসামের মুখ্যমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, পর্যটন মন্ত্রী এবং ভিসি, প্রো-ভিসিসহ দেশ-বিদেশের দু’শত শিক্ষক, শিক্ষার্থী গবেষক অংশ গ্রহণ করেন।

চর্যাপদ ছিল শাসকদের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে! হিন্দুগণ বুদ্ধপূজা না করে ও গৌতমবুদ্ধকে হিন্দুমার্কা বিষ্ণুর নবম অবতার বানিয়ে মিথ্যা ইতিহাস রচনা করেছে। কিন্ত দুঃখের বিষয়, আজ দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় হিন্দুরাজনীতির ভারত ও বাংলাদেশে বৌদ্ধ ইতিহাস, মুমূর্ষু বৌদ্ধ নর-নারীর আর্তনাদের ইতিহাস। হিন্দুরাজনীতি নিজ বাসভূমেই মুসলমান ও বৌদ্ধদেরকে পরবাসী করে দিয়েছে। চর্যাপদে (POETRY No. 33) “টালত মোর ঘর নাঁহি পড়বেসী। হাড়ীতে ভাত নাঁহি নিতি আবেশী।” এর মানে, নিজ টিলার উপর আমার ঘর। প্রতিবেশী নেই। হাঁড়িতে ভাত নাই, অথচ নিত্য ক্ষুধিত।” উচ্চবর্ণের হিন্দু সমাজ বৌদ্ধধর্মকে কবজা করে রেখে সম্রাট অশোকের বৌদ্ধ ভারতকে হিন্দু ভারত করেছেন।

ভারতে ২৬১ খ্রিষ্টপূর্বে কলিঙ্গ যুদ্ধের পরে সম্রাট অশোকের বিজয়া দশমীতেবৌদ্ধধর্মগ্রহণ করেছিলেন। বৌদ্ধধর্ম বিজয়! বেদাতীত কাল থেকেই চলে আসছে এই শুক্লা দশমীর শারদ উৎসব। সম্রাট অশোক এই ধারাকে বজায় রেখেই আশ্বিন মাসের শুক্লা দশমীর দিনে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। ঘোষিত করেছিলেন জীবপ্রেমের অমর বাণী। শারদ শুক্লা দশমীর দিনকে জীব কল্যাণের এক মহান দিন হিসবে প্রতিষ্ঠিত করেন সম্রাট অশোক। ২৬১ খ্রিষ্টপূর্বে কলিঙ্গ যুদ্ধের পরে সম্রাট অশোকের জীবনে এক আমূল পরিবর্তন সূচীত হয়। সম্রাট অশোকের নেতৃত্বে এবং তার গুরু ভন্তে মোগলীপুত্ত তিসস’র সভাপতিত্বে এই প্রচলিত শারদ উৎসবের সময় পাটলিপুত্রে সংঘটিত হয় তৃতীয় বুদ্ধধম্ম সম্মেলন “ধম্মবিজয়”। অহিংসা মানুষের ধর্ম! হিংসা এবং নরহত্যার উল্লাস মানবথসংস্কৃতির ধর্ম হতে পারেনা ! সময় এসেছে সা¤প্রদায়িক ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতির “জাতিভেদ প্রথার” বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার হিন্দুরাজনীতি ও উচ্চবর্ণের হিন্দু সমাজ বৌদ্ধধর্মকে কবজা করে রেখে সম্রাট অশোকের বৌদ্ধ ভারতকে হিন্দু ভারত করেছেন।

এই ভারতের পাঁচ হাত মাটি খনন করলেই উঠে আসে গৌতম বুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত স্মারক। বাংলা ছিল বৌদ্ধময়। শশাঙ্কের সময় থেকে সেন আমল পর্যন্ত ব্রাহ্মন্যবাদীরা বুদ্ধের সমস্ত স্মৃতি চিহ্নগুলি ধ্বংস করে দেয়। বঙ্গবাসীর উপর চাপিয়ে দেওয়া হয় ব্রাহ্মন্য ধর্ম। পরবর্তীকালে যার নাম দেওয়া হয় হিন্দু ধর্ম। ভারত মাতার দেশে শূদ্রের কোন অধিকার নেই। ব্রাহ্মন ও উচ্চবর্ণের হিন্দু যেই মানব, বৌদ্ধ দলিত, রোহিঙ্গা মুসলমান ও সেই মানব (দেশ, ৪ মে ২০০১ কলিকাতা পৃষ্ঠা ১২)! দেশে রক্তাক্ত দলিত বিদ্বেষ কেন? ইতিহাসের আলোকে ধর্মীয় নিপীড়ন প্রতিরোধ প্রসঙ্গ প্রার্থনা ছিল, “বুদ্ধং সরণং গচ্ছামি!”

প্রবাদ আছে, ‘বনের বাঘে না খেলেও কখনো-সখনো মনের বাঘে খায়।’ কারণ, বারবার খারাপ কিছু ভাবলে, ভাবনার চিন্তা, কথা ও শব্দতরঙ্গ আমাদের দেহের নিজস্ব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে গুঁড়িয়ে দিতে পারে। ধ্বংস হয়ে যেতে পারে আমাদের সহজাত আত্মবিশ্বাস। এতে বেঁচে থাকার স্বপ্নও হারিয়ে যেতে পারে। এমনকি বয়সের অভিজ্ঞতাও যেন লোপ পেয়ে যায় তথাকথিত অলীক ভয়ের আক্রমণে। অথচ আমরা ভেবে দেখি না অসুস্থ হলেই মানুষ মরে যায় না।

সম্রাট গোপালদেব (৭৫০ – ৭৭০)! পালরাজ গোপালদেবের উত্থানের ইতিহাস যেমন কুয়াশা আবৃত রহস্যময়, পালবংশের ইতিহাসের পাতায়ও তেমনি তাঁর উল্লেখ মায়াবৃত। আমার এ কথাটির ভিত্তি হলো প্রাচীন গ্রন্থাবলী ও পালরাজগণের শিলালেখগুলো। প্রাচীন গ্রন্থাবলী ও ইতিহাসবিদগণ রাজা গোপালদেবের ক্ষমতায় আরোহণের মাধ্যম হিসেবে “প্রকৃতিপুঞ্জ” কে কৃতিত্ব দিয়েছেন। কল্পমঞ্জুশ্রী থেকে প্রায় সবগুলো নির্ভরযোগ্য প্রাচীন গ্রন্থাবলী পর্যন্ত সবাই একই কথা বলে গেছে – “প্রকৃতিপুঞ্জ” মাৎসন্যায় থেকে উদ্ধার পেতে সিংহাসনে বসায় গোপালদেবকে। আর ইতিহাস লেখক লামা তারনাথ তো আরেকধাপ এগিয়ে মোটামুটি একটি কল্পগাথা বলে গেছেন গোপালদেবের সিংহাসনে আসীন হওয়ার বিষয়ে। বেশিরভাগ ঐতিহাসিকগণ “প্রকৃতিপুঞ্জ” বলতে সম্ভাব্য দুটি বিষয়কে ইঙ্গিত করেছেন- সাধারণ জনগন এবং মন্ত্রীবর্গ বা অমাত্য, মানে যারা সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ। প্রাচীন গ্রন্থাবলীর পাশাপাশি এই মহান সম্রাটের বংশাবলী এবং সিংহাসনে আরোহণের কথা আমরা পালরাজগণের তাম্রশাসনগুলো থেকে জানতে পারি। (ছবির ইতিহাস, ইতিহাসের ছবি ৩৯ তম পর্ব, পালসম্রাট গোপালদেবের সমাধি)!

সম্রাট ধরম পাল (৭৭০ -৮১০) সম্রাট দেবপাল (৮১০ – ৮৫০) সম্রাট শূর পাল মহেন্দ্রপাল (৮৫০ – ৮৫৪) , সম্রাট ভায়াগ্রা পাল (৮৫৪ – ৮৫৫) সম্রাট নারায়ণ পাল (৮৫৫ – ৯০৮) , সম্রাট রাষ্ট্রীয় পাল (৯০৮ – ৯৪০) সম্রাট গোপাল ২ (৯৪০- ৯৬০ ) ভায়াগ্রাপাল ২ (৯৬০ – ৯৮৮) সম্রাট ,মহিপাল (৯৮৮ – ১০৩৮). সম্রাট নতুন পাল (১০৩৮ – ১০৫৫) সম্রাট ভায়াগ্রাপাল ৩ (১০৫৫ – ১০৭০), সম্রাট মহিপাল ২ (১০৭০ – ১০৭৫). সম্রাট শূর পাল ২ (১০৭৫ – ১০৭৭) সম্রাট রামপাল (১০৭৭ – ১১৩০) সম্রাট কুমারপাল (১১৩০ – ১১৪০) সম্রাট গোপাল ৩ (১১৪০ – ১১৪৪) সম্রাট মদন পাল (১১৪৪ – ১১৬২) সম্রাট গোবিন্দ পাল (১১৬২ – ১১৭৪) সম্রাট পাল রাজবংশের পর সেন রাজবংশ ১৬০ বছর বাংলা শাসন করে। রাজা বল্লাল সেন বৌদ্ধধর্মীদের নমঃশূদ্র করতে হুলিয়া জারি করলো!

তিব্বতী বজ্রযান বৌদ্ধধর্ম এবং বৌদ্ধ চর্যাপদের বোধিসত্ব তারা দেবীকে (চর্যাপদের POETRY N0 28 & 50) হিন্দুরাজনীতি ও হিন্দুধর্ম কাল্পনিক কাহিনী যুক্ত করে কোলকাতা যাদুঘরে দেবী দুর্গায় রূপান্তরিত করেছে! বৌদ্ধদের বৌদ্ধধর্মকে হিন্দু রাজনীতি হিন্দুধর্ম দিয়ে গ্রাস করে ফেলেছে। হিন্দু রাজা বল্লাল সেন বৌদ্ধধর্মীদের নমঃশূদ্র করতে হুলিয়া জারি করলো (গুরুচাঁদ চরিত ষষ্ঠ সংস্করণের ২৩৮ ও ২৩৯ পৃষ্ঠা দেখুন)।
হিন্দুরাজনীতির সেন বংশ (১১শ-১২শ শতাব্দী) এবং উচ্চবর্ণের হিন্দু শাসকগণ ভারত ও বাংলাদেশে বৌদ্ধপাল রাজষর বংশকে বিলুপ্ত করে বৌদ্ধগণকে দলিত বানিয়েছিলেন (দেশ, ৪ মে ২০০১ কলিকাতা পৃষ্ঠা ১২)! ত্রয়োদশ শতাব্দীতে হিন্দুরাজনীতির খাঁচা ভাঙতে অবশেষে নিরুপায় হয়ে বাংলার বৌদ্ধগণ নু ভড়ৎপব ইসলাম ধর্ম কবুল করেছিলেন।
বাংলাদেশের সেন বংশ রাজনীতি বৌদ্ধ দেবী তারা এবং মঞ্জুশ্রীকে নানা কাল্পনিক কাহিনী যুক্ত করে দুর্গা দেবীতে রূপান্তরিত করেছে! আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো চর্যাপদে আমরা দেখতে পাই সেন আমলে সর্বগ্রাসী হিন্দু রাজনীতি গায়ের জোরে উচ্চবর্ণের হিন্দু শাসকগণ বৌদ্ধগণকে দলিত বানিয়েছিলেন (দেশ, ৪ মে ২০০১ কলিকাতা পৃষ্ঠা ১২)! বাংলাভাষার আদিমতম নিদর্শন বৌদ্ধ চর্যাপদ। বজ্রযান বৌদ্ধধর্ম এবং বৌদ্ধ চর্যাপদ বইয়ের অনুবাদ তিব্বতী ভাষায় বিরাজমান। বিশ্বশান্তি ও বৌদ্ধধর্ম প্রচারে একাদশ শতাব্দীতে অতীশ দীপংকর তিব্বত গমন করেন। হিন্দুরাজনীতি বৌদ্ধ দেবী তারা এবং মঞ্জুশ্রীকে নানা কাল্পনিক কাহিনী যুক্ত করে দুর্গা দেবীতে রূপান্তরিত হয়। হিন্দুগণ বুদ্ধপূজা না করে ও গৌতমবুদ্ধের পূত পবিত্র ধ্যানভূমি বুদ্ধগয়ার মহাবোধি মন্দির দখল করেছে ! বৌদ্ধ বিহার ভেঙ্গে গড়ে তোলা হয়েছে পুরীর জগন্নাথ মন্দির”! হিন্দুরাজনীতি বুদ্ধের দেহকে দেখে কিন্তু বুদ্ধের উপদেশ মেনে চলে না এবং বুদ্ধের উপদেশ ছিল, “যে আমার দেহকে দেখে সে আমাকে দেখে না, যে আমার উপদেশ মেনে চলে সে আমাকে দেখে ও মেনে চলে।”

“হিন্দু পুরোহিত প্রধান শঙ্করাচার্যের নির্দেশে বৌদ্ধহত্যা যজ্ঞ যেই শুরু হয়েছিল আজ ও তা শেষ হয়নি। সম্রাট অশোকের বৌদ্ধ ভারত গোলেমালে হিন্দু ইন্ডিয়া হল কেন? ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুরাজা শশাংক (৬৫০ সালে) বুদ্ধগয়ায় বোধিবৃক্ষ ধ্বংস করে এবং মহাবোধি মন্দিরে পূজনীয় বুদ্ধমূর্তিকে সরিয়ে হিন্দু দেব দেবীর মূর্তি সমূহ প্রতিষ্ঠিত করলেন। তখন থেকে হিন্দু শাসকদের ষড়যন্ত্র এবং বৌদ্ধগণ হিন্দুরাজনীতিকে কাঠগোড়ায় দাঁড় করিয়েছেন!
পলিটিক্যাল হিন্দুধর্ম ভারতীয় বৌদ্ধগণের মানবাধিকার হরণ করেছে। জাতিভেদ প্রথা ভিত্তিক হিন্দুধর্মে বৌদ্ধদের বিন্দুমাত্র ও অস্তিত্ব নেই। গৌতমবুদ্ধকে হিন্দুরাজনীতি হিন্দুদের অবতার বানিয়ে বুদ্ধগয়া দখল করে নয়জনের বুদ্ধগয়া ম্যানেজম্যান্ট কমিটিতে জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট সহ আর ও চারজন হিন্দু সদস্য কেন? ভারতে জৈন, মুসলমান, শিখ এবং খৃষ্ঠান ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে কোন হিন্দু সদস্য নে ই। কোলকাতার দেশ পত্রিকার মতে, “মহাভারতের যুগে শ্রীকৃষ্ণ তাঁহার সুদর্শন চক্র অরিকুলের দিকে নিক্ষপ করিলে আর রক্ষা ছিল না। সাঁ করিয়া ঘূর্ণায়মান চক্র প্রতিপক্ষের মুন্ডপাত করিত। মুখের কথা মুখেই রহিত স্কন্ধ হইতে মস্তকচ্যুত হইত। (পৃষ্ঠা নং ২৮, দেশ, ২ মে, ২০০৫)।”

বিশ্ববৌদ্ধ পুরস্কার প্রাপ্ত প্রখ্যাত মানবতাবাদী লেখক সোনা কান্তি বড়ুয়া (Bachelor of Arts, University of Toronto), The AuthorÕs World famous and glorious New Book entitled ÒPRE – VEDIC MOHENJODARO BUDDHISM & MEDITATION IN THE NUCLEAR AGE , (516 Pages) “ সাবেক সভাপতি, বাংলা সাহিত্য পরিষদ, টরন্টো, খ্যাতিমান ঐতিহাসিক, কথাশিল্পী, বিবিধগ্রন্থ প্রনেতা প্রবাসী কলামিষ্ঠ, লাইব্রেরীয়ান, বিশ্ববৌদ্ধ সৌভ্রতৃত্ব পত্রিকার সহ সম্পাদক এবং জাতিসংঘে বিশ্ববৌদ্ধ প্রতিনিধি