ফরিদ আহমেদ : মেয়েটার নাম মাসা আমিনি। মাত্র বাইশ বছর বয়স তার। তেহরান থেকে বহু দূরে পশ্চিম ইরানে বসবাস করতো। তেহরানের আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলো সে। সেটাই কাল হয়েছিলো তার। তার পোশাক ঠিক নেই, হিজাবের ফাঁক দিয়ে চুল দেখা গেছে, এই ‘গুরুতর’ অজুহাতে তেহরানের রাস্তা থেকে মোরালিটি পুলিশ ধরে নিয়ে যায় তাকে। মাসার সাথে থাকা তার ছোট ভাই অনুনয় বিনয় করেছিলো এই বলে যে আমরা তেহরানে থাকি না, এখানকার নিয়ম কানুন জানি না, কাউকে চিনিও না, আমার বোনকে ছেড়ে দেন আপনারা। মোরালিটি পুলিশ বাচ্চা ছেলেটার কথায় কর্ণপাত করেনি। তাকে মারধোর করে, ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে মাসাকে নিয়ে ভ্যানে তোলে তারা। সেখান থেকে মারধোর করা শুরু হয় তাকে। নিয়ে যাওয়া হয় ‘এডুকেশন এন্ড এডভাইস’ সেন্টারে। এই শিক্ষা এবং পরামর্শ কেন্দ্রে নিয়ে শিক্ষা দেওয়া হয় মেয়েদের। সেই শিক্ষা দেওয়া পাঠ্য বইয়ের মাধ্যমে না, পিটানোর মাধ্যমে দেওয়া হয়।

এখানে নিয়ে গিয়ে মাসাকেও নির্মমভাবে পিটিয়েছে ধর্ম পুলিশেরা। ধরে নিয়ে যাবার মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তার পরিবার জানতে পারে যে মাসা কোমাতে চলে গিয়েছে। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। সেখানেই মারা যায় ফুটফুটে এই মেয়েটা। জীবন যার মাত্র শুরু হতে যাচ্ছিলো, বসন্তের বাতাস বইছিলো জীবনে, ঠিক সেই সময়ে হিংস্র একদল মূর্খ ধর্মরক্ষকদের পাল্লায় পড়ে জীবন হারায় সে। পুলিশের অত্যাচারে মাসা মারা গিয়েছে এটা তারা স্বীকার করে না। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, মাসা হার্ট এটাকে মারা গিয়েছে, তাদের কোনো দোষ নেই। অন্যদিকে তার পরিবারের দাবি হচ্ছে মাসার কোনো শারীরিক সমস্যা ছিলো না।

হিজাব নিয়ে এই কড়াকড়ি এবং নির্মমতা ইরানে নতুন কিছু নয়। ১৯৭৯ সালে ইরানে যে বিপ্লব ঘটেছিলো, সেই বিপ্লবের পর থেকেই মেয়েদের পোশাকের উপর কঠোর বিধি নিষেধ আরোপিত হয়।
ইরানের পাহলভি রাজবংশের প্রতিষ্ঠা হয় ১৯২৫ সালে। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রেজা শাহ পাহলভি। তিনি পারসিয়ান কসাক ব্রিগেডের বিগ্রেডিয়ার জেনারেল ছিলে। রেজা শাহ ১৯৪১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে মিত্রবাহিনী তাঁকে গদিচ্যুত করে। রাজসিংহাসনে বসেন তাঁর ছেলে মোহাম্মদ রেজা শাহ।
ইরানের এই রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে তীব্র গণ আন্দোলন গড়ে উঠে সত্তর দশকের শেষের দিকে। এতে বামপন্থীরা যেমন ছিলো, ছিলো মধ্যপন্থীরা, একই সাথে ছিলো চরম দক্ষিণপন্থী ইসলামি মোল্লারাও। গণআন্দোলনকে সামাল দিতে আমেরিকান মদদপুষ্ট শাহ একের পর এক প্রধানমন্ত্রী বদলাতে থাকেন। এর মাধ্যমে গণ আন্দোলনের ফলে তাঁর শাসন যেখানে যেখানে আলগা হয়ে গিয়েছে, সে জায়গাগুলো পুনরুদ্ধারের আপ্রাণ চেষ্টা চালান তিনি। কিন্তু, তাঁর সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

অলিতে-গলিতে শাহের বিরুদ্ধে মিছিল হতে থাকে। ‘শাহ নিপাত যাক’ শ্লোগান দিয়ে তরুণদের দল মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে গলার রগ ফুলিয়ে শ্লোগান দিতে থাকে। সরকারের এবং আর্মির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে থাকে ভয়ে। অবশেষে, ১৯৭৯ সালের জানুয়ারি মাসের ১৬ তারিখে তিনি বাধ্য হন ইরান থেকে নির্বাসিত হতে।
শাহ ইরান থেকে নির্বাসিত হন, আর অন্যদিকে ফ্রান্সের নির্বাসিত জীবন শেষ করে বীরের বেশে দেশে ফিরে আসেন আয়াতুল্লাহ খোমেনী। আর্মি তখন পর্যন্ত শাহের অনুগত। বিপ্লবীদের হাতে ইরানের পুরো নিয়ন্ত্রণ যায়নি। ট্যাংক, মিলিটারি ট্রাক তখনও টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে রাস্তায় রাস্তায়। চারিদিকে অনিশ্চিত এক থমথমে অবস্থা। সামরিক বাহিনী বেশিরভাগ শহরের দখল নিয়েছে, কার্ফু জারি করে রেখেছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে। গণ আন্দোলন তখনও চলছে। খোমেনি এই কার্ফুকে উপেক্ষা করার নির্দেশ দেন জনগণকে। প্রতিদিন রাত নয়টায় ছাদে গিয়ে সবাইকে আধা ঘণ্টা ধরে আল্লাহ আকবর শ্লোগান দিয়ে আকাশ-বাতাস মুখরিত করার নির্দেশ দেন তিনি। বিপ্লবের প্রতি তারা যে অনুগত, শাহের পলায়নেও যে বিপ্লব থামেনি, সেটা প্রমাণ করাই হচ্ছে এর মূল উদ্দেশ্য। সামরিক বাহিনী আর শাহের অনুগত সামান্য কিছু লোক বাদে পুরো ইরান খোমেনির কথা মেনে চলতে থাকে নির্দ্বিধায়। তীব্র আন্দোলনের মুখে ফেব্রæয়ারি মাসের দশ তারিখে আর্মি আত্মসমর্পণ করে আন্দোলনরত জনগণের কাছে। পরের দিন আন্দোলনরত সব পক্ষকে ডিঙিয়ে আয়াতুল্লাহ খোমেনী মেহদী বাজারগানকে প্রধানমন্ত্রী করে অন্তর্র্বতী সরকার গঠন করেন।

ইরানের রাস্তায় রাস্তায় সশস্ত্র রিভোলুশনারি গার্ড এবং ইসলামি কমিটির সদস্যদের দেখা যেতে থাকে। এরা সবাইকে সন্দেহের চোখে দেখা শুরু করে। ইরানের গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্য ছিলো, এই অভিযোগ দিয়ে শত শত লোককে গ্রেফতার করা হয়। এদের জেলে ভরে তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। কাউকে কাউকে হত্যাও করা হয় । শাহের অনুগত সরকারী লোকেরা, যারা দেশ ছেড়ে যেতে পারেনি, তাদের কচুকাটা করে ফেলা হয়।

বিপ্লবের অল্প কিছুদিন পরেই ইরান নিজেকে ইসলামি প্রজাতন্ত্রে পরিবর্তন করে ফেলে। নাচ, গান-বাজনাসহ সমস্ত সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডকে হারাম ঘোষণা করা হয়। নারীদের জন্য হিজাব বাধ্যতামূলক করা হলো। বোরকা কিংবা চাদর ছাড়া মেয়েদের বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দেওয়া হলো। ইসলামিক সরকারের যারা বিরোধিতা কিংবা সমালোচনা করছিলো, সবাইকে নিষিদ্ধ করে দেওয়া হলো। টাই পরা, কোলন, পারফিউম, মেক আপ কিংবা নেইল পালিশ ব্যবহার করাকে শয়তানি কাজকর্ম বলে ঘোষণা দেওয়া হলো। এর জন্য কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করা হলো।

এই পরিবর্তনটা কীভাবে হলো, সেটার একটা চমৎকার বর্ণনা পাওয়া যায় মারিনা রিমাতের লেখা ‘প্রিজনার অব তেহরান’ বই থেকে। ইরানে যখন ইসলামি বিপ্লব ঘটে মারিনা তখন স্কুল ছাত্রী। তিনি লিখেছেন, এই বিপ্লবের ছাপ তাদের স্কুলে গিয়েও পড়েছিলো। তাদের প্রজ্ঞাবান অধ্যক্ষকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তার বদলে স্কুলে অধ্যক্ষ হিসাবে আসে মাত্র উনিশ বছরের এক ধর্মান্ধ এবং হিজাবি তরুণী। ইসলামি রিভলুশনারি গার্ডের সদস্য সে। অধ্যক্ষ হিসাবে যে যোগ্যতা তার থাকার কথা ছিলো, তার কিছুই ছিলো না তার। শুধু অধ্যক্ষ না, একের পর এক শিক্ষকেরও পরিবর্তন হতে লাগলো তাদের স্কুলে। স্কুলের অভিজ্ঞ শিক্ষকদের সরিয়ে দিয়ে অনভিজ্ঞ তরুণীরা সে জায়গাগুলো দখল করে নিতে শুরু করলো। এরা ছিলো ফ্যানাটিক, ইসলামিক রিভোলুশনারি গার্ডের সদস্য। কারোরই শিক্ষকতার কোনো অভিজ্ঞতা ছিলো না, ছিলো কোনো যোগ্যতাও। প্রতিদিন ক্লাসের আগে ছাত্র-ছাত্রীদের জমায়েত করা হতো এবং সেখানে আমেরিকা নিপাত যাক, ইজরায়েল নিপাত যাক, এই শ্লোগান দেওয়ানো হতো। স্কুলে হিজাব পরা বাধ্যতামূলক করা হয়। টাই পরা, পারফিউম এবং কোলন ব্যবহার করা, নেইল পালিশ করা এবং মেক আপ নেওয়া নিষিদ্ধ করা হয়।

এর প্রতিবাদে মারিনার নেতৃত্বে ছাত্রীরা স্কুলে ধর্মঘট করেছিল। কিন্তু, সেই ধর্মঘটকে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। শুরুতে প্রিন্সিপ্যাল ভয় দেখায়। সেটাতে কাজ না হওয়ায় আলোচনায় যায় ছাত্রীদের সাথে। কিন্তু, ছাত্রীরা তাদের দাবিতে অনড় থাকলে সেই অধ্যক্ষ রিভোলুশনারি গার্ডদের ডেকে আনবে বলে হুমকি দেয়। মারিনার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা স্কুল ধর্মঘটের অবসান ঘটে এক ঘণ্টার মধ্যেই। না ভেঙে উপায়ও ছিলো না। বিপদ শুধু রিভোলুশনারি গার্ডের দিক থেকেই যে ছিলো, তা নয়। এর বাইরে ছিলো হেজবুল্লাহ। ফ্যানাটিক লোকজনের দল ছিলো সেটা। এরা ছুরি-টুরি নিয়ে দলবেঁধে ঘোরাফেরা করতো। সরকারের বিরুদ্ধে যে কোনো ধরনের প্রতিবাদ সম্মেলন হলেই হেজবুল্লাহ-র সদস্যরা একত্রিত হয়ে সংঘবদ্ধভাবে হামলা চালাতো। মেয়েদের ক্ষেত্রে এদের সহিংসতা বেশি ছিলো। যে সব মেয়েরা ঠিকমতো হিজাব পরতো না, তাদেরকে এরা হামলা করতো। ঠোঁটে লিপস্টিক দেবার কারণে কিংবা স্কার্ফের ভিতর দিয়ে সামান্য ক’গোছা চুল বের হয়ে আছে, এইসব তুচ্ছ ঘটনাতেও এরা অনেক নারীকে আক্রমণ করেছে এবং অমানুষিকভাবে পিটিয়েছে।

সেই সময় থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত প্রায় তেতাল্লিশ বছর ধরে ইরানের মেয়েরা এই ফ্যানাটিকদের হাতে মার খেয়েই চলেছে। এর সর্বশেষ শিকার হচ্ছে মাসা আমিনি।
মাসার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অনেকটা বিনা প্রতিবাদেই ইরানের মানুষেরা মেনে নিচ্ছিলো এই অত্যাচার। অনেকের ধারণা থাকে নীরব থাকলে তার উপরে বিপদ আসবে না। এই ধারণাটা প্রচণ্ড রকমের ভুল একটা ধারণা। নীরবতা আসলে অত্যাচারকে গভীরতর করে, অত্যাচারীর সময়কালকে দীর্ঘস্থায়িত্ব দেয়। প্রতিবাদ করলে বিপদের ঝুঁকি থাকে, সেটা সত্যি কথা। কিন্তু, এটাও সত্যি যে সম্মিলিত প্রতিবাদ হলে অত্যাচারী ভয় পায়, অত্যাচার করার ক্ষেত্রে দ্বিতীয়বার চিন্তা করে সে। যে কারণে নীরব থাকা শুধু নিজেকে বাঁচানোর পর্যায়ে পড়ে না, অত্যাচারীর হাতকেও শক্তিশালী করে। আমরাও সেই অপরাধের অংশ হয়ে পড়ি। ইরানের একজন বিখ্যাত চিত্রপরিচালক আসগর ফরিদী যেমন লিখেছেন, “We are pretending to be asleep at the face of this never-ending oppression. We are all partners in this crime.”

মাসার মৃত্যু অবশ্য অনেককে ঘুম থেকে জাগিয়ে দিয়েছে। ইরানের মেয়েরা ঘর ছেড়ে বাইরে বের হয়ে এসেছে। রাস্তায় মিছিল করে তারা প্রতিবাদ জানাচ্ছে। হিজাব পুড়িয়ে হিজাবের মৃত্যু ঘণ্টা জানান দিচ্ছে তারা। অনেকেই তীব্র ক্ষোভে চুল কেটে ফেলছে। সেই চুল কাটার দৃশ্য সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করছে তারা। কাটা চুল দিয়ে পতাকা বানিয়ে সেটাকে ওড়াচ্ছে তারা। সহজ ভাষায়, মোল্লাতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমে গিয়েছে ইরানের মেয়েরা। সেই লড়াইয়ে মোল্লাতন্ত্রের বিরুদ্ধে তারা এই মুহূর্তেই জয়ী হবে কিনা, সেটা সময়ই বলে দেবে। তবে, একদিন যে তারা মোল্লাতন্ত্রের হাতের মুঠো থেকে বের হয়ে নিজেদের স্বাধীন জীবন ফিরে পাবে, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই আমার। কোনো অত্যাচারীই চিরকাল অত্যাচার চালিয়ে যেতে পারে না। একদিন না একদিন তার পতন ঘটেই।

আমি বরং শঙ্কিত আমার নিজের দেশ নিয়ে। আসগর ফরিদী যেমনটা বলেছেন, আমরাও ঠিক সেই রকম করেই ঘুমের ভান করে পড়ে আছি এখন। যেদিন আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠবো, দেখবো কোন ফাঁকে আমাদের সব সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে, যেমনটা একদিন হয়েছিলো ইরানের।